ছেঁউড়িয়ায় শুরু হচ্ছে তিন দিনব্যাপী লালন স্মরণোৎসব
মহামারী করোনার কারণে সরকারি নিষেধাজ্ঞায় টানা দুই বছর কুষ্টিয়ার ছেঁউড়িয়ায় লালন সাঁইয়ের আখড়াবাড়িতে চারটি উৎসব বন্ধ থাকার পর লালনভক্ত সাধু-গুরু আশেকানসহ দেশের সংস্কৃতিমনা মানুষের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে এবার মহান সাধক, বাউল সম্রাট ফকির লালন সাঁইয়ের স্মরণোৎসব (দোলপূর্ণিমা) শুরু হচ্ছে।
মঙ্গলবার (১৫ মার্চ) থেকে লালন সাঁই স্মরণোৎসব শুরু হয়ে চলবে তিন দিনব্যাপী। করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ায় লালন সাঁইয়ের স্মরণোৎসবের ঘোষণায় সাধুদের অন্তরে স্বস্তি নেমে এসেছে। লালন ভক্ত সাধু-গুরু আশেকান, অনুরাগীদের মাঝে বইছে আনন্দের নবধারা।
লালন সাঁইজি বেঁচে থাকতে তিনি তার ভাব-শিষ্য অনুসারী সাধু, গুরু, ভক্ত অনুরাগীদের নিয়ে দোলপূর্ণিমার তিথিতে সাধু সঙ্গ করতেন। তার মৃত্যুর পর ভক্তরা এ দিনের তিথিতে সাঁইজিকে স্মরণ করতে প্রাণের স্মরণোৎসবের আয়োজন করে আসছে।
মরমী সাধক বাউল সম্রাট ফকির লালন সাঁই বাঙালির চেতনায় এক অবিস্মরণীয় কালপুরুষ। তার গানের মাঝেই লুকিয়ে আছে সৃষ্টির রহস্য। সৃষ্টিকর্তার সাথে আত্মিক সম্পর্ক তার গানের মূলমন্ত্র। জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষকে একই স্রোতধারায় আনার জন্য আমরণ কাজ করেছেন এই মরমী সাধক। বাউল সম্রাট ফকির লালন সাঁইয়ের সঙ্গীত আজও আমাদের অনুপ্রাণিত করে।
এবারের অনুষ্ঠানমালায় যথারীতি থাকছে আলোচনা সভা, লালন মেলা ও নির্ধারিত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। আয়োজনে মরমী সাধক বাউল সম্রাট ফকির লালন সাঁইজির অমর বাণী 'মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি' প্রতিপাদ্যে সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয় ও কুষ্টিয়া জেলা প্রশাসনের সহযোগিতায় লালন একাডেমির আয়োজনে এই স্মরণোৎসব অনুষ্ঠিত হবে।
সাঁইজির জীবদ্দশায় তার ভক্ত-অনুরাগী-শিষ্যরা দোল পূর্ণিমায় স্মরণোৎসবের অনুষ্ঠান খুব জাঁকজমকভাবে উদযাপন করতেন। এবারও তার কোনো ব্যতিক্রম হচ্ছে না।
স্মরণোৎসবের অনুষ্ঠানকে ঘিরে ইতোমধ্যে লালন একাডেমি নানা উদ্যোগসহ সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে। লালন সাঁইয়ের মাজারের সাজসজ্জা ও ধোয়া-মোছার কাজ শেষ করে সাঁইজীর পছন্দের সাদা ধূসর রং দিয়ে রাঙিয়ে দেওয়া হয়েছে তার মাজার।
মানবতার দীক্ষা নিতে আত্মার টানে দেশ-বিদেশের সাধু-গুরু ও ভক্তরা দলে দলে আসতে শুরু করেছেন সাঁইজির মাজারে।
করোনাকালীন ভয়কে জয় করেই মূল উৎসব শুরু হওয়ার ৭-৮ দিন আগে থেকেই আখড়ায় আসা বাউল সাধকরা মাজারের বিভিন্ন স্থানে অবস্থান নিয়ে আসন গেড়ে গেয়ে চলছেন সাঁইজির আধ্যাত্মিক ও ভেদ-তথ্যের গান।
জমজমাট এখন লালন শাহ’র আখড়াবাড়ি। কুষ্টিয়া পরিণত হয়েছে উৎসবের শহরে। আয়োজন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে নেওয়া হয়েছে ব্যাপক নিরাপত্তা ব্যবস্থা। পুলিশের পাশাপাশি অনুষ্ঠানস্থলে থাকছে র্যাব ও সাদা পোশাকে গোয়েন্দা পুলিশ।
স্মরণোৎসবের অনুষ্ঠানে আসা দেশ-বিদেশের লাখো ভক্ত অনুরাগী ও সাধু-গুরুদের চরণ ধূলায় সিক্ত হবে বাউল সম্রাটের ছেঁউড়িয়ার আখড়াবাড়ি।
জানা গেছে, মঙ্গলবার (১৫ মার্চ) কুষ্টিয়ার জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সাইদুল ইসলামের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে স্মরণোৎসবের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করবেন খুলনা বিভাগীয় কমিশনার মো. ইসমাইল হোসেন। বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন বাংলাদেশ পুলিশ খুলনা রেঞ্জের ডিআইজি ড. খ. মহিউদ্দিন, কুষ্টিয়া পুলিশ সুপার খাইরুল আলম, স্থানীয় সরকার কুষ্টিয়ার উপ-পরিচালক মৃণাল কান্তি দে, কুষ্টিয়া আদালতের জিপি অ্যাডভোকেট আখতারুজ্জামান মাসুম, জেলা জাসদের সভাপতি আলহাজ্ব গোলাম মহসিন, বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কুষ্টিয়া জেলা ইউনিটের সাবেক ডেপুটি কমান্ডার রফিকুল আলম টুকু, বিএমএ কুষ্টিয়া শাখার সাধারণ সম্পাদক ডা. এএফএম আমিনুল হক রতন, দিশার নির্বাহী পরিচালক রবিউল ইসলাম প্রমুখ।
প্রধান আলোচক হিসেবে থাকছেন- ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপ উপাচার্য ড. মো. শাহিনুর রহমান। আলোচক থাকছেন অ্যাডভোকেট লালিম হক।
শুভেচ্ছা বক্তব্য দেবেন- কুষ্টিয়ার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মো. সিরাজুল ইসলাম। স্বাগত বক্তব্য দেবেন- কুষ্টিয়া জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের এনডিসি ও লালন একাডেমির এডহক কমিটির সদস্য-সচিব মো. সবুজ হাসান।
প্রতিদিন সন্ধ্যায় উন্মুক্ত মঞ্চে বিশিষ্টজনদের মুক্ত আলোচনা শেষে গভীর রাত পর্যন্ত চলবে খ্যাতনামা শিল্পীদের পরিবেশনায় লালন সঙ্গীতানুষ্ঠান।
উল্লেখ্য, বৃটিশ শাসকগোষ্ঠীর নির্মম অত্যাচারে গ্রামের সাধারণ মানুষের জীবনকে যখন বিষিয়ে তুলেছিল, ঠিক সেই সময়ই সত্যের পথ ধরে, মানুষ গুরুর দীক্ষা দিতেই সেদিন মানবতার পথ প্রদর্শক হিসেবে বাউল সম্রাট ফকির লালন শাহ’র আবির্ভাব ঘটে কুষ্টিয়ার কুমারখালীর ছেঁউড়িয়াতে। লালনের জন্মস্থান নিয়ে নানাজনের নানা মত থাকলেও আজো অজানায় রয়ে গেছে তার জন্মরহস্য। তিনি ছিলেন নিঃসন্তান। আর্থিক অসংগতির কারণে তিনি প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নিতে পারেরনি। তবে তিনি ছিলেন স্ব-শিক্ষায় শিক্ষিত। যৌবনকালে পূণ্য লাভের আশায় লালন সাঁই তীর্থ ভ্রমণে বেরিয়েছিলেন। জনশ্রুতি আছে, তীর্থকালে তিনি বসন্ত রোগে আক্রান্ত হলে তার সঙ্গীরা তাকে ত্যাগ করে চলে যান। পরে মলম শাহ’র আশ্রয়ে জীবন ফিরে পাওয়ার পর সাধক সিরাজ সাঁইয়ের সান্নিধ্যে তিনি ফকিরি ধারার সাধনায় দীক্ষা নেন।
প্রথমে তিনি কুমারখালীর ছেঁউড়িয়া গ্রামের গভীর বনের মধ্যে একটি আমগাছের নীচে সাধনায় নিমগ্ন হন। পরে স্থানীয় কারিগর সম্প্রদায়ের সাহায্য লাভ করেন। মলম শাহ আখড়া তৈরির জন্য ষোল বিঘা জমি দান করেন। দানকৃত ওই জমিতেই ১৮২৩ সালে লালন আখড়া গড়ে ওঠে।
প্রথমে সেখানে লালনের বসবাস ও সাধনার জন্য বড় খড়ের ঘর তৈরি করা হয়। সেই ঘরেই তার সাধন-ভজন ও গানের আসর বসতো। ছেঁউড়িয়ার আখড়া স্থাপনের পর থেকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি শিষ্যভক্তদের নিয়ে পরিবৃত থাকতেন। তিনি প্রায় এক হাজার গান রচনা করে গেছেন। ১৮৯০ সালের ১৭ অক্টোবর ভোরে এই মরমী সাধক দেহত্যাগ করেন এবং তার সাধন-ভজনের ঘরের মধ্যেই তাকে সমাহিত করা হয়।
এমএসপি