অতসী
ইসলামপুর থেকে সদরঘাটের দিকে ১০ মিনিট হেঁটে এলে বাঁয়ে যে মোড় আছে সেটা ধরে একদম সোজা হাঁটলে নাক বরাবর যে তিন তলা বাড়ি, সেটায় মাসখানেক হলো আমি উঠেছি। সেই বাড়িতে ওঠার আলাদা হেতু বলতে টিউশন মাস্টার হিসেবে বাড়িতে ডুকেছি। বাড়ির বাইরের দেয়াল যতটা শ্যাওলার দখলে পড়েছে, ভেতরকার দিকটা ততটাই পরিচ্ছন্ন রাখার চেষ্টা চলছে। তাই আমার শোবার জন্য যে কক্ষ দেওয়া হয়েছে তা যথেষ্ট ভালো বলাই যায়। বেলকনি নেই, কিন্তু একটা জানালা আছে।
রুমে একটা জায়গা আমার ভাববার জন্য বরাদ্দ রেখেছি। এখানে আরাম কেদারা পেতে বসে কখনো ঝিমুই, কখনো পুস্তকের পৃষ্ঠাগুলো গলাধকরণ করি। আজ নতুন সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। চেয়ারটা হঠাৎ খটখট শব্দ শুরু করেছে। এরপরও আরামে বসছি শক্ত করে। হঠাৎই মনে পড়ল, অতসী আজ দুদিন ধরে আমার কাছে কোনো চিঠি লিখছে না। অতসী হলো আমার ছাত্র নিলয়ের বড় আপু। ভার্সিটিতে এবার পা দিয়েছে। আমার অবশ্য পড়াশোনা শেষ মাস ছয়েক আগে। কিন্তু আমার জানালার ওপারে দালানঘরটি আজ দুদিন ধরে অন্ধকার। আমার যখন ক্লান্তি পায় ওই ঘরের বাচ্চাদের নাচানাচি দেখি। এই পনেরো-ষোলো বছর বয়সী একটা যুবতী মেয়েও আছে তাদের সাথে। আমাকে দূর থেকে দেখলেই ধপাস করে জানালা বন্ধ করে দেয়।
ভাবতে ভাবতেই নিলয় এসে হাজির।
- স্লামুলেকুম... নিরব ভাইয়া, ও ভাইয়া।
- হ্যা হ্যা, নিলয়। খবর কী। তোমার আপু কোথায়?
- কেন ভাইয়া, হঠাৎ আপুর কথা কেন?
আমি ভ্রু কুঁচকে নিজের উপরই বিরক্ত হয়ে বললাম, ‘উহু, ওর মনে হয় একটা চ্যাপ্টার আমার থেকে বুঝে নেওয়ার কথা ছিল।’
- আপু আছে তো। ডাকব এখন?
- না না, ওর আসার হলে আসবে।
হঠাৎ ভাবলাম, অতসী তো আছে। তাহলে চিঠির জবাব কেন আসছে না! আজ ঘুমানোর আগে আরেকটি চিরকুট লিখে ফেললাম।
‘তোমার প্রতি উত্তরের অপেক্ষায় বেশ কয়েক প্রহর কাটিয়ে দিয়েছি। কতশত দীর্ঘ শ্বাস পড়েছে আক্ষেপের কবলে পড়ে। উত্তর দিতে কুণ্ঠাবোধ কি জেগেছে মনে?’
প্রতিবারের মতো সাদা সুতোয় আবারও ভাঁজ করে ঝুলিয়ে দিলাম জানালার ঠিক নিচের দিকে দুটো পিলারের ফাঁকে।
আজ মনটা খারাপ। নিলয়কে আটচল্লিশ ঘণ্টার জন্য ছুটি দিয়েছি। হঠাৎ জানালা দিয়ে ওপারে তাকাতেই দেখি বাচ্চাগুলোর নাচানাচিতে ঘরটি আবার মেতেছে। বেশ কিছুক্ষণ দেখে মন ভালো হয়ে গেল। তবুও ওই পাজি মেয়েটা আবারও জানালা বন্ধ করে দেওয়ায় আর দেখতে পেলাম না। ধপাস করে আরাম করতে বসে গেলাম।
বুঝলাম না, অতসীর প্রতি কেন এত ঝোঁক তৈরি হয়ে গেল। মেয়েটির রূপ আসলে বর্ণনা করার মতোই সুন্দর। বিশেষ করে ওর চোখ। আমার এ বয়সে এত সুন্দর নয়নের মেয়ে আমি একটা দেখিনি। প্রথমদিন হাত-পাখা দিয়ে যেতে আসার পরই হলো আমার দৃষ্টিবদল। শরীরের গঠন স্বাভাবিক। চোখে কাজল দিতে আমি দেখিনি। কিন্তু কল্পনায় বহুবার কাজল আমি লেপ্টে দিয়েছি তার চোখে। এই ভাবতে ভাবতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছি খেয়াল নেই।
পরদিন দুপুর দুটোর দিকে দেখলাম আমার বেঁধে দেওয়া চিঠির জায়গায় হলুদ কাগজের আরেকটি চিরকুট। কিছু বুঝে ওঠার আগেই আমি সুতোয় টান দিয়ে চিঠিটি লুপে নিই। বেশ আগ্রহ, মনের আজান্তেই প্রকাশ পাচ্ছে। হাত কাঁপছে কেন জানি। প্রথম দৃষ্টিতে চিরকুটের বর্ণগুলো অস্পষ্ট লাগছে। চোখ কচলাতে কচলাতে চিরকুট পড়া শুরু করলাম-
‘বহু দিন নয়, সহস্র দিনের জন্য আপনাকে চাই। আপনাকে আপন করে চাই শেষ সীমানা অব্দি। বাবাকে বলেছি। আর দেরি সয় না। আমাদের ঘর বাঁধার দিন ঘনিয়ে এসেছে। বাবা আগামীকাল আসবে। কাল সন্ধ্যায় আপনি আমাদের ঘরে আসুন। বাবাকে সব দুজন এক সঙ্গে বলব। সমাজ-সংস্কৃতি আর ভালো লাগছে না। এবার মুখ খুলব।’
চিরকুট পড়ে আমার গায়ের কাঁপুনী আরও বেড়ে গেছে। আটাশ বছরের জীবনে এমন হয়েছে কি না তো আমার মনে পড়ে না। হঠাৎ হলো কী? আমার মনে হলো বোধশক্তি হারিয়ে ফেলব আর কিছুক্ষণ হলেই। কিছু না বুঝেই পরের দিন রইচ আঙ্কেলের রুমে হাজির হলাম।
কিছু জানিও না, বুঝতে পারছিও না আসলে আমাকে দিয়ে কী হচ্ছে। না বুঝেই আঙ্কেলের সাথে সাক্ষাৎ করতে চলে গেলাম।
- কেমন আছেন আঙ্কেল?
- ভালো বাবা, বোসো। তারপর বল, নিলয়ের খবর কী?
- আসলে আঙ্কেল, আমি আজ একটু ভিন্ন প্রসঙ্গে কথা বলতে চাই।
- হ্যা বাবা বল।
- কীভাবে যে বলি।
(ইতস্তত করতে করতে পেছনে খেয়াল করলাম নিলয় আর অতসী ও হাজির)
- হ্যা বলো, লজ্জা পাচ্ছ কেন।
- আঙ্কেল, আসলে আমি আর অতসী একে অপরকে...
কথা শেষ হওয়ার আগেই অতসী আর রইচ আঙ্কেল একসাথে বলে উঠল ‘কী’! রইচ আঙ্কেল সাথে সাথে উঠে চলে গেলেন।
অতসী আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল-
- আপনার কাছে অ্যাসাইনমেন্ট করতে যাই, তাই বলে এতদূর আপনি গেলেন কী করে!
- আসলে...
- প্লিজ ভাইয়া।
হনহন করে বের হয়ে গেলাম। রুমে গিয়ে আর স্থির থাকতে পারলাম না। কেবল ভাবনায় বুদ্বুদ উঠে, কীভাবে পারল হুট করেই এত পরিবর্তন হতে মেয়েটা! লজ্জা আর আত্মসম্মানের যুদ্ধে আত্মসমর্পণ করলাম। পরদিন বাসা ছাড়ার প্রস্তুতি নিয়ে ঘুমিয়ে পড়ি। কিছু বই, ডায়েরি, আর সকল সার্টিফিকেট ছাড়া কিছুই নিইনি। দুপুর একটার দিকে কাউকে না জানিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। পথে ষোলো বছর বয়সী ওই মেয়েটি পথ আটকে বলে উঠল- ‘এসব কিছু আমার জন্য, আমায় ক্ষমা করবেন প্লিজ’
হঠাৎ করেই ট্রেনের হুইসেল বাজল...
এসএন