শেষ ট্রেন
ফতেহগঞ্জ রেলস্টেশনটা আকারে খুব বড় নয়। কয়েকটি অচল হয়ে যাওয়া বগি পড়ে রয়েছে পরিত্যক্ত রেললাইনের উপরে। এই স্টেশনে সব ট্রেন থামেও না। তবে রাত্রির শুরু থেকে বেশ কয়েকটি ট্রেন ছেড়ে যায় শহরমুখী। বেশিরভাগ ট্রেনই মালবাহী ট্রেন। ফতেহগঞ্জের আশেপাশে বেশিরভাগ শস্যক্ষেত। সরিয়া, আলু, গম, আখ এখানে ফলে বৃষ্টির মতো। অন্যান্য ফসলও খুব ভালো হয়। সেসব ফসলই বিক্রি হয় এই স্টেশনের পাশে। ফলে দিনের বেলা লোকজনের আনাগোনা না থাকলেও রাত্রিতেই যেন জমজমাট হয়ে উঠে স্টেনশটা। রাত্রির দেবতা যেন এখানে বসিয়ে দেয় রহস্যের পসরা।
স্টেশনের নতুন মাস্টার হিসেবে এসেছেন সাখওয়াত হোসেন। সদ্য স্নাতক পাস করেই সংসারের হাল ধরেছেন বাবা-মায়ের মুখে হাসি ফুটাতে। গ্রামের বাড়ি দেওয়ানগঞ্জ মহকুমায়, সেই গ্রাম থেকে সরকারি চাকরি করা যেন সোনার হরিণ ধরে আনা। স্টেশনের কাজের চাপে খুব একটা যাওয়া হয় না বাবা-মায়ের ঘরে।
সেই স্টেশনের পাশেই রয়েছে পতিতাদের আনাগোনা। রাত হলেই যেন সেখানে বাড়ে যৌনতার দেবতার ব্যস্ততা। মুখে সাদা মোটা প্রলেপের মেকাপ করে, লাল লিপস্টিক লাগিয়ে আকৃষ্ট করে খদ্দরদের। সেই বারাঙ্গনাদের অনেকেই স্টেশনের পাশের অব্যবহৃত রেলওয়ের কামরায় কাজ সেরে জীবিকা নির্বাহ করে। তাদের বেশিরভাগ খদ্দরই, শ্রমিক ও বাবু সাহেবরা।
স্টেশন মাস্টার সাখওয়াত বেশ নিরীহ প্রকৃতির লোক। কোনো দুর্নীতি কিংবা টাকার বিনিময়ে মালপত্র নেওয়ানোর অভিযোগও নেই তার বিরুদ্ধে। রাতে স্টেশনে কাজ করার পর দুপুর পর্যন্ত এক ঘুম দেয় সে। এরপর বিকেল হলে প্রতিদিনই হাটতে বের হয় গ্রামের মেঠোপথে। গ্রামের পথের দুই পাশে সারি সারি হলুদ সরিষার ক্ষেত। সেই সরিষার ক্ষেত যেন যেন ইশারা দিয়ে ডেকে যায় পথিকদের। তার সামনেই বয়ে গেছে উজান নদী। সেই নদীর ধারেই বসে বিকেলটা কাটায় শাখওয়াত। এই গ্রামে খুব একটা বন্ধু নেই তার, রয়েছে শুধু রফিক। যে শাখওয়াত মিয়াকে খাবারের ব্যবস্থা করে দেয়। এক কথায় মজিদ শফিকের কেয়ারটেকার।
উজান নদীর প্রকাণ্ড বটগাছটার নিচেই বসে সময় কাটায় আঞ্জুম। সঙ্গে বসে আড্ডা জমায় তার সাথীরা, কখনো বা নদীর পাশের সরিষা খেতে জুড়ে দৌড়ে দৌড়ে বাড়ি যায় সাদিয়া। দেখে যেন মনে হয় কোনো এক হলুদ বনের ধারে আকাশ নদীর নীলে উড়ে যাচ্ছে এক প্রজাপতি।
প্রায়ই স্টেশনে সেই পল্লির মেয়েদের দেখা পায় সাখওয়াত। কিন্ত কিছু করার নেই, সমাজটা এখানে এভাবেই চলছে, এখানে এই নিয়ম। এসব ভেবেই খুব বিষণ্ণ থাকে সে।
আজ স্টেশনে বেশ একটা জটলা বেধে গেল। গ্রামের হারুন সরদারের নাকি মালামাল নিয়ে ঝামেলা লেগেছে শহরের লিটন মালাকারের সাথে। সেই ঝামেলা মিটমাটের দায়িত্ব পড়েছে সাখওয়াতের উপর। সেই ঝামেলার দায়িত্ব শেষ করতে না করতেই স্টেশনে এসেছে ফতেহগঞ্জ থানার পুলিশ। স্টেশনের পাশেই মিলেছে পতিতা পল্লির সুমনা রানির লাশ। কে বা কারা যেন সুন্দর দেহের আকৃতিতে একে দিয়েছে মৃত্যুর যন্ত্রণা। গলায় কিসের যেন একটা দাগ, সাদা ধবধবে গলায় লাল রক্তবরণ ধারণ করেছে সেই দাগ।
স্টেশনের এসব ঝামেলা দিন দিন বেড়েই চলেছে। এই জায়গা থেকেই চেষ্টা তদবির করতে লাগল সাখওয়াত। কিন্ত উপায় খুব একটা হয়ে উঠছে না।
আজ নদীর ধারে আবার এসে বসেছে সাখওয়াত। হঠাৎ প্রকাণ্ড বটগাছটার নিচে চোখ পড়তেই দেখা মিলল আঞ্জুমের। ঠিক যেন দমকা একটা হাওয়া এসে নাড়িয়ে দিল সাখওয়াতের সমস্ত শরীর। যেন আমের বনের দমকা হাওয়া এসে নাড়িয়ে দেয় আমের মুকুল।
সাদা বর্ণের চেহারায় যেন লাল লাল আভা। চোখে যেন নেমে এসেছে নিশ্চুপ দিগন্তের রহস্য। ভ্রুকুটিতে যেন কাজল লেপেছে কালো মেঘের দেবতা। সদ্য ১৭ তে পাওয়া দেওয়া বালিকার যৌবন যেন উঁকি দেয় পোশাকের দেয়াল ভেদ করে। বান্ধবীর সাথে হাস্যরসে মেতে আছে আঞ্জুম। সেই আঞ্জুমের হাসি যেন উজান নদীর ঢেউ, উজান নদীর ঢেউ যেভাবে ভাঙছে দুই কূল সেভাবে সাখওয়াতের হৃদয় কূলে আছড়ে পড়ছে আঞ্জুমের হাসি।
সেদিন রাতে স্টেশনে আর মন বসছে না, আকাশে উকি দিচ্ছে শুক্লা দাদশীর চাঁদ। শীতের হিমেল হাওয়ায় দূর থেকে যেন ভেসে আসছে সরিষা ফুলের প্রজাপতিরা। তারই মাঝে সাখওয়াতের বুক জুড়ে যে নারীহৃদয় খেলা করছে সে আঞ্জুম। যাকে ভেবে আজ অফিসে খুব একটা কাজেই হাত দেওয়া হলো না সাখওয়াতের।
গ্রামের সকলেই স্টেশনের বড় বাবু বলে চেনেন সাখওয়াতকে। অনেকেই সম্মানও করে। মাঝেমধ্যেই গ্রামের ভালো ফল ফলাদি পাঠিয়ে দেয় সাখওয়াতের অফিসে।
পরদিন আবার সেই নদীতটে আঞ্জুমের সাথে দেখা সাখওয়াতের। সাখওয়াতের মনে যেন আবার দোলা দেয় প্রেমের প্রজাপ্রতি। আজ যে করেই হউক আঞ্জুমের সাথে কথা বলবে সাখওয়াত। দৃপ্তপায়ে এগিয়ে গিয়ে মনের একরাশ লজ্জাকে দূরে ঠেলে দিয়ে জিজ্ঞেস করল: তোমার নাম কী?
আঞ্জুম: আমার নাম আঞ্জুম আপনি ভালো আছেন বাবুসাহেব?
বাবুসাহেব নামটায় কেমন যেন খটকা বোধ করতে লাগে শাখওয়াত, সাখওয়াত বলে তুমি আমাকে বাবুসাহেব না ডাকলে খুশি হব।
এরপর এভাবেই চলতে থাকে তাদের কথোপকথন। সায়াহ্নের এক অবেলায় দুজন দুজনকে অবলীলায় সঁপে দেয় তাদের মন ও প্রাণ।
এভাবে প্রতি বেলায়ই প্রায় দেখা করত আঞ্জুম ও সাখওয়াত। আঞ্জুম-সাখওয়াতের প্রেম দেখে গোধূলি নিজেকে লুকিয়ে নিত আকাশের কালো বুকে। যৌবনের পুলক দীপ্তে কখন যে সাখওয়াতের ওষ্ঠাধারে আঞ্জুমের লাল লিপস্টিক জায়গা করে নিয়েছে সেটা সে বুঝেনি।
মাস ছয়েক পেরেল মায়ের চিঠি এল সাখওয়াতের। বাবার অসুখ করেছে। যেকোনোভাবেই ছুটি তাকে নিতেই হবে। বাড়ি তাকে আসতে হবে। মায়ের চিঠি পেয়ে ব্যাগ গুছিয়ে বাড়ি ফিরল সাখওয়াত।
অপরাহ্নে নদীতটে আঞ্জুম সাখওয়াতের আশায় বসে থাকলেও দেখা নেই তার। নদীর বুকে যেন কোথায় একটা চর জেগেছে। সরিষাফুলগুলোও নিজেদের লুকিয়ে নিয়েছে সরিষার দানার মাঝে। দিন যায়, রাত যায়, কেটে যায় সূর্যাস্ত থেকে রাত, মধ্যরাত। তবুও দেখা নেই সাখওয়াতের। এভাবেই মাসখানেক পার হয়ে যায় কিন্তু সাখওয়াতের দেখা মেলে না।
প্রতিদিনই প্রায় স্টেশনে সাখওয়াতকে খুঁজতে আসেন আঞ্জুম। রফিকের কাছে খোঁজ নিয়েও কিছু জানতে পারে না সে। এদিকে গায়ে গড়নে বেড়ে উঠায় পল্লিতে চাহিদা বেড়েছে আঞ্জুমের। বাবা-মা হারা আঞ্জুমের ছোটবেলায় ঠাঁই হয়েছিল এই পল্লির সুমি মাসির কাছে। সুমি মাসি তাকে মেয়ের মতোই বড় করেছে কিন্তু কখনো কাজে দেয়নি। এবার সুমি মাসিও যেন তাকে ধরে বসল কাজের জন্য।
সুমি মাসিকে মা বলেই ডাকে আঞ্জুম। আঞ্জুম সুমি মাসির কাছে তার ভালোবাসার কথা জানালে, সুমি মাসি অট্টহাসিতে লুটায়। সুমি মাসি বলে, যৌবনকালে এমন বহুত নাগর আমার পিছে আছিল, কাজ শেষে সব ব্যাটায় পালায়, আমাগো খালি মুখেই ভালোবাসে, মনে মনে আসলে এই শরীরের লোভ। সুমি মাসি সাফ জানিয়ে দিলেন ৭ দিন পর থেকে কাজ শুরু করবি।
এরপর সাত দিন পেরিয়ে গেলেও আর কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই আঞ্জুমের। আঞ্জুম আজ নিজেকে সাজিয়েছে চন্দন লেপে, মেখেছে সুগন্ধী, রেলস্টেশনের পাশের পতিতাপল্লিতে আজ বাবুদের ভিড়। নতুন বারাঙ্গনাকে পেতে সুমি মাসির কাছে ধরনা দিচ্ছেন অনেকেই। সবচেয়ে বেশি টাকায় বিনিময়ে আঞ্জুমের দেহের মাতাল স্বাদ নেওয়ার সুযোগ পেলেন হারুন সরদার।
মাস দুয়েক ফিরে এলেন সাখওয়াত। বাবার মৃত্যুর পর মায়ের মৃত্যু তাকে এই জীবনের মায়া থেকে দূরে নিয়ে এসেছিল। স্টেশনে ফিরতেই স্টেশনের গার্ড রফিক খবর দিলেন, বড়বাবু, পল্লির সরদারের মেয়ে আঞ্জুম আপনাকে খুঁজতে আসছিল। এখন স্টেশনে অনেক লোকজনের ভিড় হয় আঞ্জুমের জন্য।
এই কথা শোনামাত্র, আকাশ থেকে পড়ল সাখওয়াত। মন-প্রাণ দিয়ে যাকে ভালোবেসেছিল, যার রূপের তৃষ্ণায় খুঁজেছিল নিজের স্বর্গ; সেই আঞ্জুম আজ এই কাজ করছে। কোনোমতেই কথাটা মানতে পেরে উঠছে না সাখওয়াত।
রফিককে আসার খবর পাঠিয়ে স্টেশনের অবস্থা জানতে চাইলে রফিকও ঠিক একই কথা বললেন। রফিক জানালেন, স্টেশনের সব কাজের লোক আপনারে নিয়ে খারাপ কথা কয় বড়বাবু। পল্লির আঞ্জুমের সঙ্গে নাকি আপনার প্রেম আছে। আপনি নাকি আঞ্জুমের সবচেয়ে বড় খদ্দের। নইলে আপনাকে প্রতিদিন সে খুঁজতে আসে কেন?
ব্যাপারটা বেশ শক্তভাবে আঘাত করে সাখওয়াতকে। সাখওয়াত আজ অফিসে বসেছে। বিষন্ণ মনে কাজ করছে। রাত্রি বাড়ার সাথেই স্টেশন মাস্টারের বাইরের রুমে সেই চিরচেনা গলার সুর। যে গলার সুরে তৃষ্ণা মিটতো সাখওয়াতের। রুমে প্রবেশ করেই নির্বাক দাঁড়িয়ে গেলেন দুইজন। দুজন দুজনের সামনে দাঁড়িয়ে আছে মূর্তির মতো কারো কোনো কথা নেই। যেই মানবীকে ভালোবেসে সব সঁপেছিল সাখওয়াত। তার গড়নে, চললে আজ ব্যবধান। তার নরম গালে লেপেছে ইংরেজি মুখ রাঙানোর প্রসাধনী।
সাখওয়াতকে আঞ্জুম বলল, আমাদের মতো মেয়েদের আপনারা কী জন্য ভালোবাসার নামে রঙ তামাশা করেন বড়বাবু। আগে কইতেন, এই শরীরডা দিতাম। মনডা দিয়া তো কষ্টের নদীতে ডুবছি। কই, প্রতিদিন যে কত মাইনসেরে শরীর দিই মায়াতো লাগে না। আপনারে দিসি আমার মন এজন্যই এখন আমার এই অবস্থা।
আঞ্জুমকে সাখওয়াত বলল, তুমি এখন যাও, কাল বিকেলে আমি নদীতীরে আসব।
পরদিন নদীতটে এসে দুজন দুজনকে সব ঘটনা খুলে বললেন। চারপাশে কথা কানাঘুষা শুরু হয়েছে বড়বাবুকে নিয়ে। আঞ্জুমকে সাখওয়াত বলল, আমার জীবনে দুই মাসে কী হয়েছে জানি না, তুমি আমাকে বিয়ে করবে?
আঞ্জুম অট্টহাসিতে বলল, আপনি তামাশা করছেন বড়বাবু?
সাখওয়াত বললো, তামাশা নয় সত্যি, কাল রাত ১০টার ট্রেনে আমরা হাওড়া যাব। তুমি যেভাবেই হউক, আসবে। একটা বোরকা পড়ে আসবে।
রফিকের কাছে ঘটনাটা খুলো বলল সাখওয়াত। চাকরিটা সে আর করবে না। আজ রাতেই তারা অন্য একটা ট্রেনে হাওড়া যাবে। রফিককে সব ব্যবস্থা করতে বললেন।
মৃদুমধুর ঠান্ডার রাত্রিতে ট্রেন এসে দাঁড়ালো স্টেশনে। ফাস্ট ক্লাস কেবিনে দুজন দুজনার জীবনের সব ভুলে উঠে পড়ল। জানালার ফাঁক দিয়ে দুজন দেখে নিল চিরপরিচিত জীবনটাকে। হুইসেল বেজে উঠল, ট্রেন ধীরে ধীরে চলত লাগল। দুইপাশে সারি সারি ফসলের ক্ষেত, আকাশে পুর্ণিমার চাঁদ উঁকি দিচ্ছে। পুরো আকাশটাই অসংখ্য তারা। দুজন মুখোমুখি বসে আছে চুপচাপ। ট্রেন চলছে, কোথাও থামবে কি না তার প্রয়োজন বোধ করছে না কেউই। একটা ভালোবাসার দেবতা যেন সেই ট্রেনের কামরায় আশীর্বাদ দিয়েছেন। পৃথিবীর পথে অনন্তকাল চলছে তাদের ভালোবাসার ট্রেন।
এসএন