‘এ যেন আমার জীবনে আরও একটি বিজয়’
আমার কষ্টের দিনগুলো অনেক সংগ্রামের ছিল। আমাদের অল্প কিছু জমি ছিল, সেই সময় ধানের দাম খুব কম ছিল। অন্য আয়ের উৎস ছিল না। বুঝুন এতটা পথ কীভাবে পাড়ি দিলাম!! আমি বাসায় ছাত্র-ছাত্রীদের প্রাইভেট পড়াতাম। নিজ বাসায় মেয়েদের কাপড় তৈরি করার কাজ করতাম। আর, স্বামীর রেখে যাওয়া জমি-জমা দেখা শোনা করতাম।
এতে করে সংসার চালানো কঠিন হয়ে পড়ত। আমার স্বামীর গচ্ছিত টাকাগুলো দেবররা নিয়েছিল ব্যবসা করতে!! ১৯৯০ সালে স্বামী মারা যাবার পরে আমাদের সঙ্গে আমার দুইজন দেবর থাকত; আমাদের খরচ বেড়ে যায়, তারা দুইজনেই এক বছরের মাঝে চলে যায় অন্যত্র। তার পরে আমরা যে বাসায় থাকতাম সেই বাসা ভাড়া দিলাম এবং পাশের ফাঁকা জায়গায় ছনের ঘর তৈরি করে সেখানে থাকা আরম্ভ করলাম। এভাবেই চলতে থাকে সেই সময়ের দিনগুলো...। আমার যে টাকা তারা ব্যবসায়ের জন্য নিয়েছিল তার কোনো হদিস আর পেলাম না। আমার শ্বশুর তার সংসার থেকে আমাদেরকে আলাদা করে দিলেন। চারদিকে শূণ্যতা অনুভব করতে লাগলাম। আমার বড় মেয়ে তখন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম বর্ষে পড়ত। একদিন শুনলাম তার চাকরি হয়েছে প্রাইমারী স্কুলে। চারপাশের নিভে যাওয়া বাতিগুলোর মাঝেও এক অদৃশ্য আলোর ইঙ্গিত পেলাম।
বড় মেয়েটি লেখাপড়া করত এবং একই সাথে স্কুলেও শিক্ষকতা করত। আমার ছেলেটি তখন ক্লাস ফাইভে পড়ত। বড় মেয়েটিই তখন ছেলের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিল। এর ভেতরেই ছোট মেয়েটি রাজশাহী মেডিকেল কলেজে ভর্তি হয়েছিল। খুশি হয়েছিলাম কিন্তু, পরক্ষণেই চিন্তাগ্রস্ত হয়েছিলাম এই ভেবে, এত খরচ মেটাব কীভাবে? স্রষ্টা সহায়! কোনো কিছুই থেমে থাকেনি। জমি-জমাতে খুব ভালো ফসল হচ্ছিল আর আমার ভাইরাও সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। তারপর, এক সময় বড় মেয়েটির বিয়ে হয়ে গেল। ততদিনে ছোট মেয়েটিও মেডিকেল কলেজ থেকে পাশ করার পথে। ২০০৩ সালে ছেলেটি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন ও বিচার বিভাগে ভর্তি হয়েছে। ছোট মেয়েটি তখন ডাক্তারি পাশ করেছে এবং সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে পোস্টিং এর অপেক্ষায়। অবসাদ, বিষ্ণণ্ণতা, ক্লান্তি আর রইল না। মনে হয়েছিল স্বামীর রেখে যাওয়া দায়িত্ব বোধ করি যথাযথভাবেই পালন করা হয়েছে।
আমি ভাবতেই পারিনি এত দূর পর্যন্ত ভাগ্য আমাকে নিয়ে যাবে। আমার জীবন-সংগ্রামের ভিডিও চিত্র নিতে এসেছিলেন রাজশাহী বিভাগীয় কমিশনার অফিস থেকে একজন উপ-সচিবের নেতৃত্বে একজন ম্যাজিস্ট্রেট এবং নাটোরের গুরুদাসপুরের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা। এতেই ধারণা করেছিলাম কিছু একটা হবে। ফলাফল ঘোষণা হবার পরে যখন বুঝলাম মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীনে মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর কর্তৃক পরিচালিত জয়িতা অন্বেষণ কার্যক্রমের আওতায় ২০১৭ সালে রাজশাহী বিভাগের সফল জননী নারী ক্যাটাগরিতে আমাকে শ্রেষ্ঠ জয়িতা নির্বাচিত করা হলো।
আমি ভীষণ খুশি হয়েছিলাম। আমাকে বলা হল কিছু বলার জন্য, আমি বলেছিলাম এই রাজশাহী মেডিকেল কলেজের অডিটোরিয়ামে আগেও এসেছি, এখানে আমার মেয়ে এক সময় পড়ত। আজ এখানে আমাকে সম্মাননা দেওয়া হচ্ছে। এর চেয়ে বড় অর্জন কী হতে পারে? ঠিক সেই সময়ে আমার মনে হয়েছিল, এ যেন আমার জীবনে আরও একটি বিজয়!
বিশ্ব মা দিবস-২০২২ উপলক্ষে ১২ জন ‘স্বপ্নজয়ী মা’কে বিশেষ সম্মাননা দিয়েছে মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর । এর মধ্যে নাটোরের গুরুদাসপুর উপজেলার ‘স্বপ্নজয়ী মা’ আমি নার্গিস সুলতানা ছিলাম। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর আয়োজিত রাজধানীর নিজ অফিসে পুরস্কার প্রদানের অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রনালয়ের প্রতিমন্ত্রী ফজিলাতুন্নেছা ইন্দিরা।
আরও উপস্থিত ছিলেন সচিব ড. মো. আনোয়ার হোসেন হাওলাদার, বাংলাদেশ শিশু একাডমির মহাপরিচালক মো. শরিফুল ইসলাম, মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ফরিদা পারভীন প্রমুখ। আমি আমার মেয়ের বাসা অস্ট্রেলিয়ায় থাকার কারণে আমার পক্ষে পুরস্কার গ্রহণ করেন আমার পুত্র ফাত্তাহ তানভীর রানা।
আমার জন্ম ১৯৫৮ সালে নাটোর জেলার সিংড়া উপজেলার কালীনগর গ্রামে। দশম শ্রেণিতে অধ্যয়নকালীনই আমাকে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হতে হয়েছিল বেসরকারি কলেজের শিক্ষকের সঙ্গে। মাত্র ৪৪ বছর বয়সে আমার স্বামী হার্টএ্যাটাকে চলে যান না ফেরার দেশে। তখন আমি তিন সন্তানের জননী এবং বয়স মাত্র ৩৫ বছর। এরপর সম্পূর্ণ প্রতিকূল পরিবেশে অপ্রাপ্ত বয়স্ক তিন সন্তানকে আপন প্রত্যয়ে বড় করে তুলেছি। আমার অসীম ধৈর্য, সাহস, দৃঢ় মনোবল ও পরিশ্রমের ফসল এই তিন সন্তান। আমি সরকারের কাছে কৃতজ্ঞ কারণ, আমাকে জয়িতা অন্বেষণ কার্যক্রমের আওতায়ও ২০১৬ সালের গুরুদাসপুর উপজেলা এবং নাটোর জেলার শ্রেষ্ঠ জয়িতা (সফল জননী নারী ক্যাটাগরিতে) মনোনীত করেন। জয়িতা অন্বেষণ কার্যক্রম সরকারের খুবই ভালো উদ্যোগ। এই স্বীকৃতি শুধু আমার নয় সমস্ত মায়েদের যারা কঠোর সংগ্রামের মধ্য দিয়ে তাদের সন্তানদের মানুষের মত মানুষ করে গড়ে তোলে।
আমার বড় মেয়ে জান্নাতুন ফেরদৌস (লীনা) রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ থেকে বি.এ. (সম্মান), এম. এ সম্পন্ন করে স্কুলে শিক্ষকতা করছেন। আর বড় জামাতা ড. মো. রবিউল করিম, অধ্যাপক, রসায়ন বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত রয়েছেন। আমার ছোট মেয়ে ডা. নাদিরা পারভীন (রুনা) রাজশাহী মেডিকেল কলেজ থেকে এম.বি.বি.এস. সম্পন্ন করেছেন। ডাক্তার হবার পরে সে ২৪তম বিসিএস পরীক্ষায় (স্বাস্থ্য ক্যাডার) উত্তীর্ণ হয়। এফ.সি.পি.এস, পার্ট-১ সম্পন্ন হলে স্বামীর হাত ধরে চলে যান ঢাকায়। তারপর ২০০৮ সালে উচ্চ শিক্ষার্থে স্বামীর সঙ্গে বিদেশে (অস্ট্রেলিয়ায়) পাড়ি দেন। আমার ছোট মেয়ে ২০১৩ সালে অস্ট্রেলিয়ান মেডিকেল কাউন্সিল (AMC) এক্সামের দুই পর্ব কৃতিত্বের সঙ্গে সমাপ্ত করেছেন। এ ছাড়া, সে ফেলো অব রয়েল অস্ট্রেলিয়ান কলেজ অব জেনারেল প্রাকটিশনার্স (FELLOW OF ROYAL AUSTRALIAN COLLEGE OF GENERAL PRACTITIONERS) এর ৩য়/ চুড়ান্ত পর্ব কৃতিত্বের সঙ্গে সম্পন্ন করে। বর্তমানে তিনি অস্ট্রেলিয়ার সরকারি চিকিৎসক (জিপি) হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। আর ছোট জামাতা ডা. রাশেদুল হাসান, এম.বি.বি.এস. (ঢামেক), বি.সি.এস (স্বাস্থ্য), এফ.সি.পি.এস, এমডি ডিগ্রিধারী। ছোট জামাতাও বর্তমানে অস্ট্রেলিয়ার সরকারি চিকিৎসক হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। আমার একমাত্র পুত্র ফাত্তাহ তানভীর মো. ফয়সাল রানা, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন ও বিচার বিভাগ থেকে এলএল.বি (সস্মান), এলএল.এম সম্পন্ন করে বর্তমানে অগ্রণী ব্যাংক লিমিটেড, ঢাকা উত্তর অঞ্চলে প্রিন্সিপাল অফিসার হিসাবে কর্মরত রয়েছেন। আর বউমা আনজুমান আরা উপ-পরিচালক হিসেবে বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ, বনানী, ঢাকাতে কর্মরত আছেন।
নারী হয়েও আমার সংসারের হাল ধরা হয়তো অনেকে ভালো চোখে দেখত, তথাপি কেউ কেউ ভালো চোখে দেখত না। আমার স্বামী মারা গিয়েছেন, কোনো সঞ্চয়ও ছিল না। আমি সংসারের হাল না ধরলে কে ধরবে বলেন? এখনকার দিনের মতন হাট-বাজারে তখন মেয়েদের অবাধ বিচরণক্ষেত্র ছিল না। তারপরেও বাড়ি থেকে বের হতাম জীবনের প্রয়োজনে। অনুকূল পরিবেশ ছিল বলা যাবে না, তবে অনেকেই বিভিন্নভাবে সহযোগিতাও করতেন। আমি তাদের প্রতি কৃতজ্ঞ।
লেখক: নার্গিস সুলতানা, ২০২২ সালের স্বপ্নজয়ী মা বিজয়ী, ২০১৭ সালের রাজশাহী বিভাগের সফল জননী ক্যাটাগরিতে নির্বাচিত সেরা জয়িতা,পার্থ, অস্ট্রেলিয়া থেকে, nargisguru62@gmail.com