বিশেষ নিবন্ধ
অর্থপাচার রোধে যা যা করতে হবে
যে কোন দেশের অর্থপাচার সেই দেশের জন্য একটি মারাত্নক সমস্যা। আমরা দেখছি হাল নাগাদ প্রচুর অর্থ দেশ থেকে পাচার হয়ে গেছে। এটি অত্যন্ত দুশ্চিন্তার বিষয়। অর্থপাচারের দুটি দিক আছে। এই যে পাচারকৃত অর্থ এটা আসলে কোন দিক থেকে আসে? এটা অনার্জিত অথবা সুদ, ঘুষ, মানবপাচার, মাদক,নারীপাচার সহ সকল প্রকার বেআইনি ব্যবসা, এসবই হলো এর উৎস। এছাড়া দুর্নীতি, নানারকম অব্যবস্থাপনার ফলেও এই অপকর্মগুলি হচ্ছে। দ্বিতীয়ত যখন অর্থ বাংলাদেশ থেকে চলে যাচ্ছে তার প্রভাব কি পড়ছে আমাদের দেশের উপর? আমাদের আয় কম,আমাদের সঞ্চয় কম,বাইরের থেকে ধার দেনা করতে হয়। এর মধ্যে অর্থগুলো যদি বাইরে চলে যায়,আমাদের বিনিয়োগ,কর্মসংস্থান,সবদিক থেকেই এটি একটা বিরাট ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। যারা এই অর্থগুলো পাচার করছে এরা বিদেশে বিলাস বহুল জীবনের পাশাপাশি দেশেও কিন্তু একটা আমেজি আয়েশি জীবন যাপন করছে। অন্যদিকে যারা সত্যিকারের ব্যবসায়ী,যারা ব্যবসা করতে চায়,তারা কিন্তু এদের সাথে পেরে উঠে না এবং একসময় ব্যবসা গুটিয়ে নিতে বাধ্য হয়।
বাংলাদেশ ব্যাংক প্রথম ২০০৫সালে এন্টি মানি লন্ডারিং ডিপার্টমেন্ট খুলেছিল। তাদের কাজ ছিল এ বিষয়ে মনিটরিং করা, ব্যাংকের কাজগুলো সঠিকভাবে হচ্ছে কি না দেখা, অর্থ অন্যায়ভাবে বাইরে চলে যাচ্ছে কি না ইত্যাদি সহ বিষয়গুলো তদারকি করা। আমি মনে করি প্রকৃতপক্ষে সেই কাজটি যথাযথভাবে হচ্ছেনা। তাছাড়া অনিয়ম দেখা গেলে সেক্ষেত্রে সেটা দুর্নীতি দমন কমিশন ও সি.আই.ডির দায়িত্বে পড়ে। তারা তদন্ত করে আইনি পদক্ষেপগুলো নেয়। এখানে আমি দেখেছি এরা বহু সময় নিয়ে, বলা যায় এরা অনেক বেশি কালক্ষেপণ করে এবং দায়সারা একটা তদন্ত রিপোর্ট দিয়ে দেয়। কখনো কখনো আমরা তা দেখতেও পাই না। তাছড়া বিষয়টি তখন দুর্নীতি দমন কমিশন এবং সি আই ডি র কাছে ন্যস্ত হয় বলে সেটি আর সরাসরি বাংলাদেশ ব্যাংকের আওতাধীন থাকেনা। দায়িত্বটি তখন সরকার সহ বেশ কয়েকটি সংস্থার উপর বর্তায়।
আমরা জানি,বিভিন্ন দেশে অর্থ পাচার হচ্ছে। সুইজারল্যন্ড,মালয়েশিয়া সহ বিভিন্ন দেশে এসব অন্যায়গুলি হচ্ছে।এগুলো সনাক্ত করা খুব যে কঠিন তা কিন্তু না। এটা কমাতে হলে বাংলাদেশকে আরও অনেক বেশি সাহসী পদক্ষেপ নিতে হবে। যেমন, তাদের ব্যাংক একাউন্ট জব্দ করা, ব্যক্তিগত সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা সহ তাদেরকে কঠোরভাবে আইনের আওয়ায় নিয়ে আসতে হবে।
আমেরিকাতেও অর্থ পাচার হয়। কিন্তু ওদের ক্ষেত্রে আইন বেশ কড়াকড়ি। ভারতেও দুর্নীতি হয় কিন্তু ওরা খুব দ্রুত পদক্ষেপগুলি নেয়। যেমন,অপরাধীদের বিদেশ থেকে ফে্রত নিয়ে আসা। ওদের ওখানে কেস হচ্ছে। ওরা সুইজারল্যান্ডে যোগাযোগ করছে, ইংল্যান্ডে যোগাযোগ করছে,আমাদের দেশে আমি দেখি,একটা চিঠি দিচ্ছে তারপর সব চুপচাপ।কর্তৃপক্ষ বলছে,আমরা দেখবো,দেখছি,হবে তারপর সব কিছুই আড়ালে চলে যায়। এ ধরণের আপ্তবাক্য অর্থাৎ ধরাছোঁয়ার বাইরে কথাবার্তা যেগুলি প্রকৃতপক্ষে কোন কাজেই আসেনা।।দুই একটি কেস যদি দৃষ্টান্তমূলকভাবে ধরা যেত দুর্নীতিটা কিছুটা হলেও কমতো।
বাংলাদেশ এগমন্ট গ্রুপের সদস্য। বিভিন্ন দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলি এর সদস্য। এখানেও আমরা একেবারেই তৎপর নই। আমরা নেপাল,মালয়শিয়া,ফিলিপিনের সাথেও একটি চুক্তি করেছিলাম। অর্থপাচারের ক্ষেত্রে এরা আমাদের জানাবে,আমরা তাদের জানাবো এবং একইসাথে এর সমাধানে বিভিন্নরকম পদক্ষেপ নিব। সেগুলোও যথাযথভাবে কিছুই হচ্ছেনা।
অতএব আইনি পদক্ষেপ নেয়া, দেশে এবং বিদেশে বিশেষ করে এ ধরণের বেআইনি অর্থগুলি যেন না জেনারেট হয় সেদিকে নজরদারি বাড়ানো উচিত। কারণ এভাবে যদি অর্থ বাইরে যেতেই থাকে তাহলে এক্ষেত্রে অপরাধিরা আরো অনেক বেশি উৎসাহিত হবে।ফলে দুর্নীতি হতেই থাকবে।
এই অনার্জিত অর্থ দিয়ে এরা বাড়ি কিনে, ফ্ল্যাট কিনে, জমিজমা কিনে,সেগুলো রোধ করতে হবে।অর্থাৎ সুশাসনের দরকার আছে। স্ব স্ব ক্ষেত্রে জবাবদিহিতারও দরকার আছে। এই জবাবদিহিতা না থাকাতে, সঠিকভাবে আইনের শাসন না থাকাতে এবং এর পিছনে তদন্ত করে পদক্ষেপ নেয়া,সেগুলি সঠিকভাবে হচ্ছেনা দেখেই এরা নেতিবাচকভাবে উৎসাহিত হয়ে উঠছে। ফলে এটা দেশের জন্য ক্ষতির কারণ হচ্ছে। দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন শুধু বলবো না সার্বিক উন্নয়নের ক্ষেত্রেও বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ব্যাপকভাবে নষ্ট হচ্ছে। কিছুদিন পর পর এ সংক্রান্ত দুর্নীতিগুলি খবরের কাগজে উঠে আসে এবং পরিসংখ্যান অনুযায়ী এত অর্থ পাচার কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য না।
যে কোন মুল্যে দেশ থেকে এভাবে অর্থ পাচার রোধ করতেই হবে এবং এটা করা না গেলে দেশের ভাবমূর্তি যেমন নষ্ট হবে একইসাথে দেশের এগিয়ে যাওয়া অনেক বেশি কঠিন হবে।
লেখক: বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর
অনুলিখন: শেহনাজ পূর্ণা