পল্লিতে শেকড়ের স্বপ্ন

ছোটবেলা থেকেই গ্রামকে হৃদয়ে বেঁধে রেখেছি। ভীষণ রকমের স্বপ্নে বিভোর থাকি শেকড়কে নিয়ে। হৃদয় যেন গেঁথে আছে এক মায়াবী হরিণের সঙ্গে। পল্লি উন্নয়ন গবেষণা অনুসন্ধানে কাজ করেছি দীর্ঘ ১২ বছর। যখন আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করি— এমএসএস এ একটা কোর্স ছিল রুরাল ডেভেলপমেন্ট। শ্রদ্ধেয় প্রফেসর গিয়াস উদ্দীন স্যার আমাদের কোর্স টিচার ছিলেন। স্যার তখন বাংলাদেশ পল্লি উন্নয়ন একাডেমি নিয়ে অনেক গল্প করতেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়ার পূর্বে তিনি বগুড়া আরডিএতে চাকরি করতেন। তখনকার সময়ের অভিজ্ঞতা তিনি ক্লাসে শেয়ার করতেন। আমিও মনোযোগ দিয়ে শুনতাম আর ভাবতাম এই অপরুপ সৌন্দর্যের পল্লি কেন এভাবে অবহেলিত হবে। জল জমি জনতার প্রাণ পল্লিকে শ্রীহীন হতে দেওয়া যাবে না। এই সমাজের উন্নয়নে আমরা কী কিছুই করতে পারি না। এই ভাবনা থেকেই মনে হলো পল্লি উন্নয়ন নিয়ে গবেষণা করার।
গবেষণার কাজে যখন এক পল্লি থেকে আরেক পল্লিতে ঘুরেছি। লক্ষ্য করেছি একটা বিষয় তাহলো— বেকারত্ব, ঋণগ্রস্ততা, দারিদ্র্য ও নিম্নমানের জীবনযাত্রা, আয়স্বল্পতা, অধিক জনসংখ্যা, অনুন্নত কৃষি উৎপাদন ব্যবস্থা, অপুষ্টি, অশিক্ষা, কুসংস্কারাচ্ছন্ন ও অজ্ঞতা উন্নয়নকে অবরুদ্ধ করে রেখেছে এবং গলাচেপে ধরতে এগুলো সমানতালে শাসন করছে। সমস্যা সৃষ্টি এবং সমস্যা টিকিয়ে রাখার জন্য এগুলো প্রত্যক্ষভাবে প্রভাব বিস্তার করে চলছে পল্লি সমাজে। পল্লি সমাজে যেহেতু শিক্ষার হার কম সেকারণে যৌতুক প্রথা, নারী নির্যাতন, ধর্মীয় গোঁড়ামি ও ধর্মের অপব্যাখ্যা, চতুরমুখী ঠক প্রতারকদের সংখ্যাও কম নয়। এক ভাইয়ের সম্পদ লুণ্ঠন করছে আরেক ভাই অর্থাৎ সম্পদের মালিকানার অসম বণ্টনও ব্যাপকভাবে পরিলক্ষিত। পল্লির সমগ্র জনগোষ্ঠীর জীবনের সার্বিক মানোন্নয়ন ও জনশক্তিকে জনসম্পদে পরিণত করার লক্ষ্যে সরকার বিভিন্নমুখী পদক্ষেপ ইতোমধ্যে গ্রহণ করেছে।
‘আমার গ্রাম আমার শহর’ যেখানে গ্রামগুলো পাবে নগরের ছোঁয়া। বর্তমান বিশ্বায়নের যুগে গ্রাম পর্যায়ে আধুনিকতার ছোঁয়া লেগেছে। কর্দমাক্ত রাস্তার বদলে পিচঢালা রাস্তায় পথ পাড়ি দিতে পারছে, স্মার্ট ফোন ব্যবহার করে স্মার্ট হয়েছে। চার্লস মেটকাফের মতে, বাংলাদেশের গ্রামগুলো ছিল এক একটি ক্ষুদ্র প্রজাতন্ত্রের মতো। সবদিক দিয়ে এগুলো ছিল স্বয়ংসম্পূর্ণ। তেমন গ্রামই আমরা প্রত্যাশা করি।
ড. আখতার হামিদ খান পল্লি উন্নয়নের একজন পথিকৃৎ। এক্ষেত্রে এদেশে তার কর্মকাণ্ড সত্যিই প্রশংসনীয়। বার্ড প্রতিষ্ঠা করে তিনি পল্লি উন্নয়নের ঝাণ্ডা তুলে ধরেছেন। যার আলো বিচ্ছুরিত হয়েছে নিভৃত পল্লিতে। টেকসই পল্লি উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় যেসমস্ত কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে বেশিরভাগ তারই অবদান। কুমিল্লার দরিদ্র কিষাণ-কিষানীর পাশে থেকেছেন সুখ-দুঃখের বন্ধু হিসেবে। পল্লি উন্নয়ন জোয়ারের স্থপতি ছিলেন পল্লির গণমানুষের প্রাণপুরুষ ড. আখতার হামিদ খান। তার সৃজনশীল উদ্যোগেই একাডেমি কুমিল্লা সদর থানার ৩০০টি গ্রামের দৃষ্টান্তমূলক পরিবর্তন সাধন করেছিল, যা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ব্যাপকভাবে প্রশংসিত হয়। এর সফলতায় পরবর্তীতে বাংলাদেশে সবুজ বিপ্লবের পথ রচনা করে।
পল্লি উন্নয়নে এক অপরাজেয় শিল্পীর তুলিতে গ্রাম বাংলার বিচিত্র শোভা প্রস্ফুটিত হয়েছে। গ্রামের মাটি ও মানুষকে নিয়ে তিনি গড়ে তুলেছেন আত্মার বন্ধন শেকড়ের স্বপ্ন। বাংলাদেশের হাজার হাজার গ্রামের কৃষি ও ভূমিহীন পরিবারকে আশার আলো দেখিয়েছেন কুমিল্লা পদ্ধতির মাধ্যমে। পল্লি জনতার দেশে এই জনতা হলো বড় শক্তি। আখতার হামিদ খান একটি মসৃণ পথ সৃষ্টি করে রেখে গেছেন তাদের জন্য। তিনি পল্লি উন্নয়নের রূপকার, শিল্পী বা কারিগর। একটা শাশ্বত সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তোলার মানসে প্রান্তিক পর্যায়ে তার এক আশ্চর্য রকম চাহনি। শতাব্দীর শোষণ ও বঞ্চনায় ধসে যাওয়া পল্লি সমাজ ও অর্থনীতির কাঠামো ক্ষুধা, দারিদ্র্য, অশিক্ষার উপর ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
এ অবস্থায় পরিবর্তন ও বিনির্মাণ একটি জটিল প্রক্রিয়া। এজন্য প্রয়োজন মেধাদীপ্ত সৎ ও বলিষ্ঠ নেতৃত্ব। আধুনিক জ্ঞান ও প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহারের মাধ্যমে পল্লির শাশ্বত জীবনধারার সঙ্গে সংগতি রেখেই এমন নেতৃত্ব গড়া খুবই দরকার।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শিলাইদহতে বসে দরিদ্র অসহায় মানুষের কথা ভেবেছেন তার লেখনীতে যা প্রস্ফুটিত হয়েছে। ১০ মে ১৮৯৩ সালে শিলাইদহে লিখেছেন, এই দরিদ্র প্রজাগুলোকে দেখলে আমার ভারী মায়া করে। এরা যেন বিধাতার শিশু সন্তানের মতো নিরুপায়। তিনি এদের মুখে নিজে হাতে কিছু তুলে না দিলে এদের আর গতি নেই। পৃথিবীর স্তন যখন শুকিয়ে যায় তখন এরা কেবল কাঁদতে জানে, কোনোমতে একটুখানি ক্ষুধা ভাঙলেই আবার তখনই সমস্ত ভুলে যায়।’
আমরা স্বপ্ন দেখি পল্লির মানুষের উৎপাদন, আয়, বণ্টন, ভোগ, বাসস্থান, শিক্ষা, স্বাস্থ্য প্রভৃতির গুণগত ও পরিমাণগত উন্নয়নের। যেখানে মানুষ দুবেলা দুমুঠো খেয়ে পরে বাঁচতে পারবে, কৃষকেরা উৎপাদিত দ্রব্যের নায্যমূল্য পাবে। নাভিশ্বাসে জড়ানো অর্থনীতি চাই না, আমরা চাই নির্ভেজাল অর্থনীতি। আশার আলো খুঁজে পাবার প্রত্যাশায় আমরা এখন।
ড. সারিয়া সুলতানা: পল্লিউন্নয়ন গবেষক ও সহকারি সম্পাদক, ঢাকাপ্রকাশ২৪ডটকম
আরএ/
