আয়ই যদি না হয়, ব্যয় করবে কীভাবে
বর্তমান সময়ে আমরা একটি ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছি। এটি ঠিক যে, অবস্থা হয়তো আরও খারাপ অবস্থায় চলে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ঠিক সেটি হয়নি তবে সবকিছু মিলিয়ে অর্থনীতি ও বাজার ব্যবস্থাপনায় একটি অস্বস্তিকর অবস্থা বিরাজ করছে বেশ অনেকদিন ধরে। এমতাবস্থায় কিছু কিছু প্রতিষ্ঠান হয়তো তার কর্মীদের কিছু সুযোগ-সুবিধা দিয়ে থাকে; যেটি প্রয়োজনের তুলনায় যথেষ্ট নয়। তবুও এই প্রচেষ্টাকে আমাদের স্বাগত জানানো উচিত। তবে এক্ষেত্রে যারা নির্ধারিত আয়ের মানুষ তাদের জন্য বর্তমান সময় খুবই নাজুক। আমরা একথাটিও বলতে পারি যে, দ্রব্যমূল্য গতবছর যেভাবে উঠা শুরু করেছিল, গতবারের মতো যদি ৯ শতাংশ হারেও বাড়ত তাহলে সেটি আরও অনেক বেশি বেড়ে যেতে পারত। ফলে আরও বেশি ক্ষতির কারণ হতে পারত।
আমি মনে করি, স্বল্প আয়ের মানুষ যারা আছেন, তাদের দিকটি আমাদের অবশ্যই ভাবতে হবে। সরকারের সঙ্গে বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থাকেও এক্ষেত্রে এগিয়ে আসতে হবে। এখন যাদের আর্থিক সঙ্গতি আছে, আমি মনে করি যে, বেসরকারি খাতে থেকে প্রান্তিক মানুষের অর্থ সংস্থানের ব্যবস্থা করা দরকার। রমজানে আমরা যাকাত থেকে প্রাপ্ত অর্থ দিয়ে যাকাত বোর্ডের মাধ্যমে একটি রিলিফ ফান্ড গঠন করতে পারি। যেখানে সরাসরি যাকাতের টাকা চলে যাবে রিলিফ ফান্ডে এবং সেখান থেকে প্রান্তিক মানুষ উপকৃত হবেন।
আমার ব্যক্তিগত মতামত হচ্ছে, এই সব প্রান্তিক মানুষের জন্য সরকারি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান মিলে যদি সমন্বিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে বিশেষ করে আসন্ন রমজানকে ঘিরে একটি ভূমিকা রাখতে পারা যায় সেটি নিঃসন্দেহে একটি সফল উদ্যোগ হবে। আমাদের সাধারণ মানুষের মধ্যেও একটি সহযোগী মনোভাব থাকতে হবে। আমরা কোভিডের সময়েও অনেক অসহায় মানুষকে অনেক সহযোগিতা করেছি।
বর্তমান সময়ে মূল্যস্ফীতি ঊর্ধ্বগামীতার কারণে এমন কিছু পলিসি নেওয়া যাবে না অথবা এমন কিছু করা যাবেনা, যাতে এটি আরও বাড়ে। কারণ সাম্প্রতিক সময়ে মূল্যস্ফীতি যথেষ্ট বেড়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারে বিভিন্ন দ্রব্যের ঊর্ধ্বমূল্য থাকায় আমাদের এখানেও দ্রব্যমূল্য বেড়েছে। স্থানীয় বাজারে দাম বেড়েছে অপেক্ষাকৃত বেশি। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্যের উপরে আরও একটি চাপ আছে। আমাদের খেয়াল রাখতে হবে, এক্ষেত্রে আমাদের যেন এমনটি না হয়। একটি লাগামের মধ্যে যেন আমরা মূল্যস্ফীতি ধরে রাখতে পারি, সেই প্রচেষ্টা আমাদের থাকতে হবে।
আমরা যেহেতু অনেকাংশেই আন্তর্জাতিক বাজারের উপর নির্ভরশীল, সেজন্য জরুরি অবস্থা অথবা মূল্যস্ফীতি বেড়ে গেলে যাতে দরিদ্র মানুষের কষ্ট না হয়, সেখানে যাতে স্বল্পমূল্যে পণ্যসামগ্রী তাদের দেওয়া যায় সেটি খেয়াল করতে হবে। বর্তমান সময়কার ভিন্ন অবস্থার প্রেক্ষাপটে যে চ্যালেঞ্জগুলি আছে যেমন, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে একটু চাপ আছে, আমরা আন্তর্জাতিক বানিজ্যের ক্ষেত্রে দেখেছি, যেহেতু বাণিজ্যের ভারসাম্য অর্থাৎ আয় যতটা হচ্ছে, রপ্তানি যতটা হচ্ছে আমদানি তার চেয়ে অনেক বেশি। সেক্ষেত্রে আমাদের খেয়াল রাখতে হবে, আয় যদি না হয়, ব্যায়ের বিষয়টিই কীভাবে হবে? এখন পর্যন্ত আমাদের অনেক ঘাটতি আছে। অনেক বছর আমরা রেভিনিও টার্গেট পূরণ করতে পারিনি। এবছরও সরকার একটি রেভিনিও টার্গেট দিচ্ছে, সেই জায়গাতে এই রেভিনিও অর্জন করা সম্ভব তা নয়।
আমাদের যে সুশৃঙ্খল অবস্থা দরকার, প্রযুক্তির ব্যবহার করা দরকার কর আদায়ের ক্ষেত্রে, ভ্যাট ট্যাক্স আদায়ে, সেটিরও কিন্তু গতি খুব ধীর। আমরা আমাদের পলিসির যদি পরিবর্তন করতে না পারি, আমাদের অবকাঠামোগত পরিবর্তন না করতে পারি, তাহলে কিন্তু ব্যয়ের জায়গায় টাকা না থাকলে আমরা যতকিছুই চিন্তা করি না কেন, আমাদের কিন্তু ঋণ নির্ভর হতে হবে। আয় যদি বেশি হয়, তাহলেতো আমাকে ঋণ নির্ভর হতে হয় না। ভবিষ্যতে বৈদেশিক মুদ্রার যে চাপ সেটিও থাকে না। কাজেই আয়ের জায়গাটিতে পলিসিগত অবকাঠামোর পরিবর্তন খুবই জরুরি এবং সে বিষয়ে কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে পারলেই বর্তমান পরিস্থিতি কিছুটা হলেও আমরা সামাল দিতে সক্ষম হব।
নাজনীন আহমেদ: অর্থনীতিবিদ
এসএন