দুর্ঘটনা প্রতিরোধে সরকারি উদ্যোগ যথেষ্ট নয়
প্রতিবছর ঢাকা শহরে তিন হাজারের বেশি আগুন লাগার ঘটনা ঘটে এবং এসব অগ্নিকাণ্ডের কোনোটিতে জ্বালানি গ্যাস, এলপিজি অথবা দাহ্য কেমিক্যাল যুক্ত হলে আগুন বিস্ফোরণে রূপ নিতে পারে। দেশে পরপর তিনটি বিস্ফোরণ এবং প্রাণহানির ঘটনায় সাধারণ মানুষের মধ্যে এক ধরনের আতঙ্ক তৈরি হয়েছে।
আমাদের দেশে বাসাবাড়ীতে সব সময় গ্যাস সংযোগের লাইনে গ্যাসের সরবরাহ থাকে না। যে কারণে কেউ কেউ চুলা অন করে রাখেন। এর ফল হচ্ছে চুলায় গ্যাসের সরবরাহ আসার পর রান্নাঘরে গ্যাস জমে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। খোঁড়াখুঁড়ির কারণে মাটির নিচে গ্যাস পাইপলাইন ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে সুয়ারেজ অথবা পয়োবর্জ্য লাইনে গ্যাস চলে যেতে পারে।
এখন আমাদের যেটি করতে হবে, বাসাবাড়িতে গ্যাস লিকেজ হয়েছে, এমন সন্দেহ তৈরি হলে দ্রুত রাইজারের চাবি বন্ধ করে কর্তৃপক্ষকে জানাতে হবে। অত্যন্ত জরুরি পরিস্থিতি তৈরি হলে রাইজার বন্ধ করে গ্যাসের কাজ করেন, এমন দক্ষ কোনো মিস্ত্রিকে ডেকে লিকেজ মেরামতের ব্যবস্থা করতে হবে। লিকেজ মেরামত নিশ্চিত হয়েছে কি না, সেটি ভালভাবে দেখতে হবে। কারখানায় বড় বিস্ফোরণে প্রাণহানির ঘটনার সঙ্গে দেশের মানুষ পরিচিত। যেখানে বহু মানুষের যাতায়াত সেখানেও বিস্ফোরণ ঘটছে।
রাজধানীতে নতুন ও পুরোনো দুই ধরনের আবাসিক ও অনাবাসিক এলাকায় আমরা অগ্নিকাণ্ড এবং বিস্ফোরণ ঘটতে দেখেছি। এমতাবস্থায় বলব অগ্নিনির্বাপণ ও অগ্নিব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে জনসচেতনতার যথেষ্ট অভাব রয়েছে। অধিকাংশ বহুতল ভবনে অগ্নিনির্বাপণের মহড়া হয় না, অগ্নিনির্বাপণযন্ত্র থাকলেও ব্যবহারকারীর সংখ্যা নগণ্য। প্রায়ই দেখা যায় ফায়ার এক্সিট (জরুরি বহির্গমন পথ) ব্যবস্থা কার্যকর নয়। গৃহসজ্জার ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের দাহ্য বস্তুর ব্যবহার হয়। অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকি মোকাবিলায় মানুষকে সচেতন করার জন্য শুধু সরকারি তৎপরতা যথেষ্ট নয়। এমন পরিস্থিতিতে বেসরকারি সংস্থাগুলোকেও জনগণকে সচেতন করতে এগিয়ে আসতে হবে।
একটি দীর্ঘসূত্রতা থেকে এটি প্রতীয়মান হয় যে রাসায়নিক দুর্ঘটনা প্রতিরোধের বিষয়টি জাতীয়ভাবে অগ্রাধিকার তালিকায় নেই। রাসায়নিক দুর্ঘটনা প্রতিরোধে সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষগুলোর যেমন: বিস্ফোরক অধিদপ্তর, বাণিজ্য ও শিল্প মন্ত্রণালয়, সিটি করপোরেশন পাশাপাশি এ খাতের ব্যবসায়ীদের মধ্যে সমন্বয় ও উদ্যোগের যথেষ্ট ঘাটতি দেখা যাচ্ছে। সরকারি কর্তৃপক্ষ আংশিকভাবে রাসায়নিক নিরাপত্তার বিষয়টি দেখাশোনা করে, ফলে বড় কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে কেউ এর দায়ভার নিতে চায় না। এটি রাসায়নিকের আগুনের ক্ষেত্রে যেমন সত্য, অন্য বিস্ফোরণ বা অগ্নিকাণ্ডের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য।
এখানে একটা বিষয় জরুরি এবং তা হলো, রাসায়নিকের কারণে অগ্নিকাণ্ড বা বিস্ফোরণ হলে ক্ষয়ক্ষতি বেশি হওয়ার ঝুঁকি থাকে। তাই রাসায়নিক দুর্ঘটনা এড়াতে এবং এ খাতে শৃঙ্খলা ও সঠিক ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে দেশে একটি জাতীয় কমিটি গঠন করা অত্যন্ত জরুরি। যেটি সব সংশ্লিষ্ট সংস্থার সমন্বয় ঘটানোর পাশাপাশি নিরাপদ ব্যবস্থাপনার জন্য প্রয়োজনীয় বিধিমালা তৈরি করবে।
কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে ঘাটতি থেকে উত্তরণের প্রচেষ্টা আমরা দেখতে পাই না। আবার কোনো একটি দুর্ঘটনা ঘটলে আমরা দায়ী ব্যক্তি খুঁজে শাস্তি দেওয়ার জন্য বেশি ব্যস্ত হয়ে পড়ি কিন্তু দুর্ঘটনার মূল কারণ খুঁজে বের করে তা সমাধানের চেষ্টা করি না। ফলে একই ধরনের দুর্ঘটনা বারবার ঘটতেই থাকে।
ইকবাল হাবীব:নগর পরিকল্পনাবিদ ও স্থাপত্যবিদ