খ্রিস্টপূর্বকালের পর্যটন
সূচনা
পর্যটন কখন বা কোন দেশে জন্ম নিয়েছে তা নিশ্চিত করে বলা কঠিন। মানব জাতির সঙ্গে কালের পরিক্রমায় এটি কীভাবে মিশে গেছে, তা নির্ধারণ করাও কঠিন। তবে প্রত্নতত্ত্ব, প্রাচীন ইতিকথা ও ইতিহাস পর্যালোচনা থেকে কতগুলো স্পষ্ট আভাস পাওয়া যায়। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যায় যে, হিজরি সাল গণনা শুরু হয় ৬২২ খ্রিস্টাব্দ থেকে। সফর এই সালের দ্বিতীয় মাস। এই মাসে আরবে খরা হতো এবং খাদ্যসংকট দেখা দিত। মাঠঘাট শুকিয়ে চৌচির, বিবর্ণ ও তামাটে হয়ে যেত। ফলে আর্থিক সংকট মোকাবিলার উদ্দেশ্যে ব্যবসায় বাণিজ্য করার জন্য অন্যত্র গমন করত। আরবের মুসলিম বণিকরা ব্যবসায়িক কাজের জন্য বাইরে যেত। পাশাপাশি তারা পূর্ববর্তীদের কীর্তি ও পরিণতি সম্বন্ধে জানা ও শিক্ষা গ্রহণ করত। সুরা আলে ইমরানের আয়াত ১৩৭, সুরা আনআমের আয়াত ১১, সুরা নাহলের আয়াত ৩৬, সুরা নমলের আয়াত ৬৯, সুরা মুমিনের আয়াত ২১ এবং সুরা রুমের আয়াত ৪২-এর মাধ্যমে পৃথিবী ভ্রমণ করে পূর্ববর্তীদের কর্মকাণ্ড, শক্তি ও কীর্তির প্রাবল্য ও পরিণতি দর্শন করার তাগিদ রয়েছে। এ ছাড়াও সৃষ্টি-রহস্য অবলোকনের মাধ্যমে জ্ঞানার্জন করা এবং পৃথিবীর জনপদ দর্শন করার গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে।
উইকিপিডিয়ার তথ্য মতে, Tourist শব্দটির প্রথম প্রয়োগ হয় ১৭৭২ সালে এবং Tourism শব্দের ব্যবহার শুরু হয় ১৮১১ সালে। ১৯৩৬ সালে জাতিসংঘ বিদেশি পর্যটকের সংজ্ঞা নির্ধারিত করে। এতে বলা হয় যে, বাইরের দেশে কমপক্ষে ২৪ ঘণ্টা অবস্থান করবেন তারা পর্যটকরূপে বিবেচিত হবেন। জাতিসংঘ বিশ্ব পর্যটন সংস্থা কর্তৃক প্রণীত Glossary of Tourism Terms-এ বলা হয়েছে যে, পর্যটন হলো একটি সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক প্রপঞ্চ; যা ব্যক্তিগত বা ব্যবসায়িক ও পেশাগত উদ্দেশ্যে তাদের স্বাভাবিক পরিবেশের বাইরের দেশ বা স্থানে চলাচলকে বাধ্য করে। এ সবের মাধ্যমে পর্যটনের হাল আমলের কতিপয় তথ্য পাওয়া যায়। কিন্তু পর্যটন অতি প্রাচীনকাল থেকে জীবনমুখী কর্মকাণ্ড হিসেবে অনুশীলিত হয়ে আসছে।
পৃথিবীতে পর্যটনের সূচনাভিত্তি
অনাদিকাল থেকেই অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা ও পেশাগত উৎকর্ষতার জন্য মানুষ এক স্থান থেকে অন্য স্থানে গমনাগমন করছে। প্রকৃতির কাছ থেকে শেখা বেঁচে থাকার কৌশল প্রয়োগ করে নিজেদের এবং পারিপার্শ্বিক উন্নয়ন সাধন করছে। দীর্ঘ সময়ের এই প্রচেষ্টায় তৈরি হয়েছে পরিবার, সমাজ, সংসার, গ্রাম, নগর ও দেশ। প্রবর্তন করেছে গোত্র কিংবা জাতির। জীবন পরিচালনার জন্য আহরণ করতে হয়েছে সম্পদ, গোষ্ঠীগত স্বার্থ রক্ষার্থে গোত্রে-গোত্রে হয়েছে বিবাদ কিংবা লড়াই, আবার নতুন করে শান্তির সম্পর্কও তৈরি হয়েছে। চিরন্তন এই কর্মকাণ্ডের ভেতর দিয়ে নিজের অজান্তেই মানুষ উদ্ভাবন করেছে পর্যটনকে। স্মরণাতীত কাল থেকে ভূ-প্রকৃতি ও সম্পদের টানে অভিযাত্রী হিসেবে মানুষের গমনাগমন সভ্যতা ও সম্পদ আহরণে তার চালিকা শক্তি হিসেবে কাজ করেছে।
এক সময় শিকার কিংবা জীবিকার জন্য মানুষ বনে-জঙ্গলে কিংবা নানা স্থানে ঘুরে বেড়িয়েছে এবং প্রকৃতির কাছ থেকে শিখেছে জীবনধারণের বহুমুখীকৌশল। যেমন বাসস্থান নির্মাণ ও দলবদ্ধভাবে বসবাসের উপায়। সন্ধান পেয়েছে সুস্বাদু খাদ্য, পানীয় ও পথ্যের। রোগ মুক্তির জন্য প্রাণপণে উদ্ভাবন করেছে স্বাস্থ্য ও বিনোদনের। মানুষ শিখেছে কৃষি ও জীবনযাপনের উপায়। গড়ে তুলেছে সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল এবং পরিবেশ রক্ষার বিজ্ঞান। এভাবেই পা রেখেছে সভ্যতার উচ্চতর সোপানে। মানুষ তখন হয়তো বুঝতেই পারে নাই যে, এ সকল কাজের সঙ্গে গোড়াপত্তন ঘটিয়েছে পর্যটনের।
প্রাচীনকালে পর্যটনের জন্মসূত্র
খ্রিস্টপূর্ব ৩,০০০ বছর সময়কালে টাইগ্রিস ও ইউফ্রেটিস নদীর মধ্যবর্তী এলাকায় মেসোপটেমিয়া সভ্যতা গড়ে উঠে। এ সময় গ্রামগুলোর পাশাপাশি নগর সভ্যতারও বিকাশ লাভ করতে শুরু করে। শহরগুলোতে তৈরি হয় ভবন ও মন্দির। গড়ে উঠে পরিবার, ধর্ম ও রাজনীতি। মানুষ ব্যক্তিগত সম্পদ আহরণের তাগিদ অনুভব করে এবং সামাজিক সভ্যতা আরেক ধাপ অগ্রসর হয়। এই সময়ে শিল্প ও প্রযুক্তিগত প্রয়োগ উৎকর্ষ পরিলক্ষিত হয়। এ সব উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে পর্যটনেরও উন্নয়ন ঘটতে থাকে। সভ্য মানুষ এক স্থান থেকে অন্য স্থানে বিশেষ বিশেষ উদ্দেশ্যে ভ্রমণ করতে শুরু করে। তাদের মধ্যে নানাবিধ ভ্রমণ চাহিদাও তৈরি হয়। খ্রিস্টপূর্ব ২,০০০ সালের পূর্বে মধ্যপ্রাচ্যে বসবাসকারী মানুষ খাদ্যবস্তু ও অন্যান্য দ্রব্য বেচা-কেনার জন্য দীর্ঘ পথ পাড়ি দিত। ব্যবসা সৃজনে পর্যটনের এই অবদান সর্বপ্রাচীন বলে গবেষকগণ মনে করেন।
তাম্রযুগে (খ্রিস্টপূর্ব ৩,১০০ থেকে ১,২০০ সাল) মেসোপটেমিয়া ছিল সভ্যতা বিকাশের সুতিকাগার। আধুনিক বাগদাদের উত্তরাংশ থেকে বেবিলন পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল এই এলাকা। খ্রিস্টপূর্ব ৩,০০০ বছর পূর্বে উরুকের সুমেরিয় নগরী ছিল তৎকালীন পৃথিবীর বৃহত্তম নগরী। সুতরাং বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, ঐ সময় এই নগরী অনেক ভ্রমণকারীদের আকর্ষণ করত। প্রাচীন মিশরীয় সংস্কৃতি ও সভ্যতা ছিল উল্লেখ করার মতো। তারা জ্যোতির্বিদ্যা, স্থাপত্যবিদ্যা, প্রকৌশল, কৃষি ও নির্মাণবিদ্যা জানত। এই সভ্যতা খ্রিস্টপূর্ব ৫,০০০ বছর থেকে রোমান যুগ পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। এ থেকে বুঝা যায় যে, প্রাচীন মিশরিয়রা সমৃদ্ধ জীবনযাপন করত। শিক্ষা ও বিনোদনে তারা ছিল অগ্রগামী জাতি। সংগীত, নাটক ও নৃত্যশিল্প ছিল তাদের সামাজিক বিনোদনের মাধ্যম।
মিশরের মতো প্রাচীন সিরিয়া ও বেবিলনিয় সভ্যতা খ্রিস্টপূর্ব ২,৯০০ বছর পূর্ব পর্যন্ত সমহিমায় গড়ে উঠে। বক্সিং, কুস্তি, তীর ছোঁড়া ও নানাবিধ টেবিলগেম ছিল বিনোদনের বিষয়। এ ছাড়া তারা নৃত্য ও সংগীতও উপভোগ করত। খ্রিস্টপূর্ব ৯০০ থেকে পরবর্তী সময়ে বেবিলনে পৃথিবীর আশ্চর্যতম ঝুলন্ত বাগান স্থাপিত হয়।
প্রাচীন ভারতে পর্যটনের ইতিহাস
প্রত্নতত্ত্ববিদদের মতে, সিন্ধু সভ্যতা খ্রিস্টপূর্ব ৩,৩০০ থেকে খ্রিস্টপূর্ব ১,৪০০ সাল পর্যন্ত বিরাজমান ছিল। অতঃপর পরে আসে বৈদিক সভ্যতা (খ্রিস্টপূর্ব ১,৬০০ থেকে খ্রিস্টপূর্ব ৮০০ সাল)। সিন্ধু নদীর পাড় ধরে হরপ্পা ও মহেনজো দারো নামক দুটি বৃহত্তম নগরী গড়ে উঠে যা ‘হরপ্পীয় সভ্যতা’ বলে পরিচিত। হরপ্পার অর্থনীতি কর্তৃক মেসোপটেমিয়ার অর্থনীতিতে অবদান রাখার প্রমাণ পেয়েছেন প্রত্নতত্ত্ববিদেরা। এ থেকে প্রতীয়মান হয় যে, হরপ্পার মানুষেরা মেসোপটেমিয়াতে গমনাগমন করতো। উল্লেখ্য যে, হরপ্পীয় সভ্যতা বর্তমান পাকিস্তানে অবস্থিত।
দার্জিলিংয়ে অবস্থিত ‘অ্যাসোসিয়েশন ফর কনজারভেশন অ্যান্ড ট্যুরিজম’ নামক একটি বেসরকারি উন্নয়ন ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান সম্প্রতিকালে এই নিয়ে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য প্রদান করেছে। ঋকবেদের (খ্রিস্টপূর্ব ১৫ শতক) শ্লোকে ‘ভ্রম’ শব্দটি পাওয়া যায়, যার অর্থ উদ্দেশ্যহীনভাবে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে আসা যাওয়া। এই ভ্রম থেকে ‘ভ্রমণ’ শব্দের উৎপত্তি হয়েছে। অতপর খ্রিষ্টপূর্ব চতুর্থ শতকে পাণিনি নামক একজন সংস্কৃত ব্যায়াকরণবিদ বলেন যে, ‘পর্যটন’ শব্দটি পরি + অট্ + অন (ল্যুট) থেকে উদ্ভব হয়েছে। সংস্কৃত শব্দ ‘পারিয়া’ থেকে ‘পরি’ অর্থাৎ উদ্দেশ্য এবং অট্ + অন অর্থাৎ এক স্থান থেকে অন্য স্থানে গমনাগমন। এখান থেকে সৃষ্ট ‘পর্যটন’ শব্দের অর্থ হলো উদ্দেশ্য সম্বলিত গমনাগমন।
এরপর খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতকে রচিত উপনিষদে চারটি ধাপে মানব মনের ‘তুরীয়’ অনুশীলন পরিলক্ষিত হয়। এই অনুশীলনের প্রথম ধাপে মানবমন জাগ্রত হয়, দ্বিতীয় ধাপে স্বপ্ন দেখে, তৃতীয় ধাপে গভীর নিদ্রামগ্ন হয় এবং চতুর্থ ধাপে সমাধিপ্রাপ্ত হয়। ৪ ধাপের এই অনুশীলনের মাধ্যমে একজন মানুষ সহজেই এক স্থানে বসে মনের ভ্রমণ করতে পারতেন। দেহের ও মনের উৎকর্ষ সাধনের জন্য তুরীয় অনুশীলন ছিল খুব কার্যকর। যিনি ‘তুরীয়’ অনুশীলন করেন তাকে ‘ট্যুরিস্ট’ বলা হয়। তুরীয় শব্দের সঙ্গে ‘ইজম’ যোগ করে আধুনিক ‘ট্যুরিজম’ শব্দের উদ্ভব ঘটেছে বলে অনুমান করা হয়। সতেরো ও আঠারো শতকে বৌদ্ধগুরু মহাযানি মতাবলম্বীরা তাদের জীবনধারা ও ধর্মানুশীলনে বিভিন্ন স্থানে ভ্রমণের মাধ্যমে জ্ঞান অর্জনকে অত্যন্ত গুরুত্ব প্রদান করেন। ফলে এরা তুরীয় অনুশীলনের মাধ্যমে জীবন গড়ে তুলতেন। অর্থাৎ পর্যটন ছিল তাদের জীবন গড়ে তোলার এবং জ্ঞান অর্জনের প্রধান অবলম্বন।
ইতিহাস বলছে, তৃতীয় মৌর্য সম্রাট অশোকের শাসনামলে (খ্রিস্টপূর্ব ২৬৯ থেকে ২৩২ সাল) পর্যটন বিষয়ক এই শব্দগুলির ব্যবহার পরিলক্ষিত হয়। তিনি শুধু বর্তমান ভারত ও পার্শ্ববর্তী দেশগুলি শাসনই করেননি। বরং এসব অঞ্চলের সংস্কৃতিতে গভীর প্রভাব ফেলতে সক্ষম হয়েছিলেন। উপর্যুক্ত ব্যুৎপত্তিগত দিক বিশ্লেষণ করলে সহজেই প্রতীয়মান হয় যে, ‘ভ্রমণ’, ‘ট্যুরিজম’ ও ‘পর্যটন’ এই ৩টি শব্দের উৎপত্তিস্থল ভারত উপমহাদেশ।
প্রাচীন বাংলায় পর্যটনের সূচনা
ইতিহাসে স্পষ্ট যে, বঙ্গ রাজ্যটি বাংলা অঞ্চলের অন্যতম নাম। এটি বর্তমান ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের ভূখণ্ডকে বুঝায়। প্রাচীন ভারতের মহাকাব্য ও কাহিনীতে এবং শ্রীলঙ্কার ইতিহাসে বঙ্গের বৈশিষ্ট্য রয়েছে। বঙ্গ সম্ভবত গঙ্গারিডি সাম্রাজ্যের কেন্দ্র ছিল যা অসংখ্য গ্রিক-রোমান লেখক দ্বারা উল্লেখ করা হয়েছে। গুপ্ত সাম্রাজ্যের শাসনের পর প্রাচীন বাংলা গৌড় রাজ্য ও বঙ্গ রাজ্য নামে বিভক্ত হয়। প্রাচীন বাংলায় ৩টি রাজ্য ছিল: অঙ্গ, বঙ্গ ও মগধ। খ্রিস্টপূর্ব দশম শতকে অঙ্গ, বঙ্গ ও মগধ রাজ্য গঠিত হয়। এই রাজ্যগুলো বাংলা এবং বাংলার আশেপাশে স্থাপিত হয়েছিল। আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ১২০০ - ১০০০ সালে রচিত অথর্ববেদে এইসব রাজ্যের বিবরণ পাওয়া যায়। মহাভারতের আমলে বঙ্গদেশ এবং তৎসংলগ্ন জনপদগুলির মধ্যে প্রত্নতত্ত্ববিদগণ তিনটি জনপদকে আদি জনপদ হিসেবে নির্দেশ করে থাকেন। এরা হলো অঙ্গ (রাজশাহী ও ভাগলপুর অঞ্চল), কলিঙ্গ (উত্তরে ভাগীরথী থেকে দক্ষিণে গোদাবরী নদী পর্যন্ত) এবং বঙ্গ (অঙ্গ ও কলিঙ্গের পূর্বাঞ্চল)।
বাংলাপিডিয়া বলছে, বাংলা সুদূর অতীত থেকেই পর্যটকদের আকৃষ্ট করে এসেছে। বিশ্বের নানা অংশ থেকে পর্যটকরা নানা কারণে বাংলা ভ্রমণ করেছেন। কেউ এসেছেন ধর্ম প্রচারে, কেউ ব্যবসায়ের উদ্দেশ্যে, কেউ প্রাচীন বাংলার নানা জ্ঞানপীঠ থেকে বিদ্যার সন্ধানে আবার কেউ বা শুধুই কৌতূহল মেটাতে। প্রফেসর ড. শাহনাজ হুসনে জাহান তার ‘প্রাচীন বাংলায় ব্যবসায়ী এবং তাদের কাজের পরিবেশ: শিলালিপির মাধ্যমে অনুসন্ধান’ শীর্ষক প্রবন্ধে উল্লেখ খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতক থেকে তৃতীয় শতক অর্থাৎ ৬০০ বছরে প্রাচীন বাংলায় ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনার জন্য বিদেশিদের গমনাগমনকে দালিলিক প্রমাণসহ উল্লেখ করেছেন।
তিনি তার গবেষণা প্রবন্ধে বলেন যে, খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতকের শেষের দিকে প্রাচীন বাংলায় নগরানের সূচনা হয়। ফলে সঙ্গত কারণেই ব্যবসারও সূচনা হয়। বলা বাহুল্য যে, নগরায়ণের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো বাণিজ্য পরিচালনা ও বাণিজ্য কেন্দ্র গড়ে তোলা। প্রফেসর শাহনাজ তার প্রবন্ধে রায়চৌধুরি (১৯৪৩) ও রায় (১৯৯৪) নামক দুইজন গবেষকের উদ্ধৃতি দিয়ে মহাস্থানের শিলালিপি থেকে নিশ্চিত করেছেন যে, উত্তর ও ব-দ্বীপ বাংলায় মৌর্যদের কর্তৃত্ব স্বীকৃত ছিল। মৌর্যদের শাসনামলে (খ্রিস্টপূর্ব ৩২৪ থেকে খ্রিস্টপূর্ব ১৮৭ সাল) পুণ্ড্রবর্ধন, রাধা, শুহ্মা ও বঙ্গে অঙ্কিত মুদ্রার প্রচলনের প্রমাণ মিলে। উল্লেখ্য যে, খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতকের শেষের দিকে পূণ্ড্রনগর, গঞ্জ ও তাম্রলিপি নামক বাণিজ্য কেন্দ্রগুলো গড়ে উঠ। এইসব তথ্য থেকে প্রমাণিত হয় যে, প্রাচীন বাংলায় এবং বাংলার (বঙ্গ) সঙ্গে অন্যান্য স্থানের নানা ধরনের ব্যবসা পরিচালিত হতো।
প্রফেসর ড. শাহনাজ হুসনে জাহানের ‘বাংলার সামুদ্রিক বন্দর: খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতক থেকে ষোড়শ শতক’ থেকে প্রতীয়মান হয় যে, ওয়ারী-বটেশ্বর, গাঙ্গে ও তাম্রলিপি প্রভৃতি নাগরিক কেন্দ্রগুলি খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতকে সমুদ্রবন্দরের মাধ্যমে ভারত মহাসাগরের সঙ্গে যুক্ত ছিল। এ থেকে বাংলার সঙ্গে বিশ্ব বাণিজ্যেও সম্পৃক্ততা সহজেই বুঝা যায়। উপযুক্ত তথ্যাবলির আলোকে এ কথা সহজেই বলতে পারা যায় যে, খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতক থেকে প্রাচীন বাংলায় ব্যবসায়িক পর্যটনের সূচনা হয় এবং তা ১৬ শতক পর্যন্ত অত্যন্ত গুরুত্বসহকারে পরিচালিত হয়।
উপসংহার
পর্যটনের প্রাচীনতা নিয়ে প্রত্ননিদর্শনগুলি নানাভাবে তথ্য প্রদান করেছে। উপযুক্ত ৩,০০০ বছরে মানুষের ইতিহাস ও জীবনধারা থেকে প্রতীয়মান হয় যে, জীবন নির্বাহ ও আর্থিক প্রয়োজনে মানুষকে পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে গমন করতে হয়েছে। ফলে গড়ে উঠেছে নগর ও ব্যবসায় বাণিজ্য। আর এখান থেকেই পর্যটনের সূচনাও হয়েছে। অতঃপর সময় ও চাহিদার প্রেক্ষিতে পর্যটনের সহস্রাধিক শাখা সৃষ্টি হয়েছে। তবে প্রাচীন বাংলায় খ্রিস্টপূর্ব ৬০০ বছর থেকে যেভাবে ব্যবসায় পর্যটন গড়ে উঠেছিলো তা সত্যিই অবাক করার মতো। খ্রিস্টপূর্ব ৩০০ বছর আগে মৌর্য শাসনামলে ব্যবসায়ে দোকানদার, খুচরা বিক্রেতা, বিনিয়োগকারী ইত্যাদি ধরনের মানুষেরা ব্যবসায়ে জড়িত ছিল বলে পালি ও সংস্কৃত সাহিত্যে প্রমাণ মিলে। এ থেকে আরও পরিষ্কারভাবে অনুমিত হয় যে, পুরো মৌর্য রাজ্যে ব্যবসায়ী পর্যটকরা ঘুরে বেড়িয়েছেন।
মোখলছেুর রহমান: রেক্টর, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ট্যুরিজম স্টাডিজ, ঢাকা
এসএন