ইতিহাসে অম্লান শহীদ ড. শামসুজ্জোহা
শহীদ ড. শামসুজ্জোহা বাঙালির বীরত্বময় গৌরবগাঁথা ইতিহাসে অমর হয়ে আছেন। তার ফোটা ফোটা রক্তের পথ ধরেই পতন ঘটেছে লৌহমানব সামরিক জান্তা আইয়ুব খানের। এসেছে ১৯৬৯ সালের গণআন্দোলনে বাঙালির বিজয়, মুক্ত হয়েছেন বাঙালির অবিসংবাদিত মহান নেতা শেখ মুজিবুর রহমানসহ তার সহযোগীরা আগরতলা ষড়যন্ত্র অভিহিত মামলা থেকে। লক্ষ ছাত্র-জনতার ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে শেখ মজিব ভূষিত হন বঙ্গবন্ধু উপাধিতে। এ গণঅভ্যুত্থানের পথ ধরেই পাকিস্তান সরকার বাধ্য হয় ১৯৭০ সালে সাধারণ নির্বাচন দিতে যে নির্বাচনে আওয়ামী লীগ অভূতপূর্ব নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে বিজয়ী হয়েছিল। তাই বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের সঙ্গে শহীদ জোহার নামটি মিশে আছে একাকার হয়ে। কিন্তু এই মহৎ ব্যক্তি সম্পর্কে জাতি কতদূর জানে? আমরা তার আত্মত্যাগকে নতুন প্রজন্মের মধ্যে কতটা ছড়িয়ে দিতে পেরেছি?
সৈয়দ মুহম্মদ শামসুজ্জোহা ১৯৩৪ সালের ১ মে পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুড়ায় জন্মগ্রহণ করেন। জোহা ১৯৪০ সাল থেকে ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত বাঁকুড়া জেলা স্কুলে পড়াশুনা করে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় কৃতিত্বের সঙ্গে প্রথম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হন। ১৯৫০ সনে বাঁকুড়া ক্রিশ্চিয়ান কলেজ থেকে তিনি প্রথম শ্রেণিতে ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষায় পাস করেন। ১৯৫০ সালের প্রথম দিকেই পূর্ব ও পশ্চিমবঙ্গে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু হলে জোহার পরিবার পূর্ব-পাকিস্তানে আসার সিদ্ধান্ত নেয়। এরই অংশ হিসেবে ১৯৫০ সালে জোহা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়নে স্নাতক (সম্মান) শ্রেণিতে ভর্তি হন। এর অল্পপরই পুরো পরিবার ঢাকায় চলে আসে। জোহা ১৯৫৩ সালে স্নাতক (সম্মান) পরীক্ষায় দ্বিতীয় শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হন এবং ১৯৫৪ সালে কৃতিত্বের সঙ্গে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন।
১৯৫৫ সনের শেষের দিকে জোহা বেকারত্ব ঘুচিয়ে পাকিস্তান ordnance (অস্ত্র) কারখানায় সহযোগী কারখানা পরিচালক পদের জন্য শিক্ষানবীশ হিসেবে নির্বাচিত হন এবং ওই বছরই ১৪ ডিসেম্বর গ্রেট বৃটেনের সাউথ ওয়েলসে রাজকীয় ordnance (অস্ত্র) কারখানায় বিস্ফোরক দ্রব্যের উপর প্রশিক্ষণ লাভের জন্য যোগদান করেন। ১৯৫৬ থেকে ১৯৫৯ সন পর্যন্ত জোহা যুক্তরাজ্যের ইম্পেরিয়াল কলেজ অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি-তে পড়াশুনা করেন এবং লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ে বিএসসি (বিশেষ) ও ইম্পেরিয়াল কলেজের-এর Associateship of the Royal College of Science (ARCS) লাভ করেন। পরে ১৯৫৯ সালের ৪ আগস্ট পশ্চিম পাকিস্তানের ওয়াহ্ ক্যান্টনমেন্টে সহকারী পরিচালক পদে যোগদান করেন।
১৯৬১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে জোহা ordnance (অস্ত্র) কারখানার চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে প্রথমে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্নয়ন অফিসার এবং পরে ২৩ ফেব্রুয়ারি রসায়ন বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগদান করেন। এর কিছুদিনের মধ্যেই তিনি লন্ডনের ইম্পেরিয়াল কলেজে উচ্চতর ডিগ্রি লাভের জন্য একটি স্কলারশিপ পান এবং ১৯৬১ থেকে ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত তিনি যুক্তরাজ্যে থেকে তার গবেষণা কাজের মাধ্যমে পিএইচডি ও ডিইসি ডিগ্রি লাভ করে ফিরে আসেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে। ১৯৬৫ থেকে ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত জোহা শাহ মখদুম হলের আবাসিক শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন এবং এরপর নিযুক্ত হন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর হিসেবে।
৬ দফা ও বাঙালি জাতীয়তাবাদের আন্দোলনের তীব্রতা বৃদ্ধি পেলে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর পক্ষ থেকে ১৯৬৮ সালের ২১ এপ্রিল এক নোটিফিকেশনে স্পেশাল ট্রাইব্যুনাল অর্ডিনেন্স অনুযায়ী বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ মুজিবুর রহমানসহ তার সহযোগী ৩৫ জন সেনা কমকর্তা ও সিএসপি অফিসারকে আসামি করে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার উদ্যোগ নেওয়া হয় একটি প্রহসনের বিচারের জন্য।
‘রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিবুর রহমান ও অন্যান্য’ শিরোনামে মামলাটি দায়ের হলেও পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর পরিকল্পিত প্রচারণায় মামলাটি পরিচিতি পায় ইতিহাসে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা নামে। এই মামলার মূল লক্ষ্য ছিল যেকোনো মূল্যে শেখ মুজিবর রহমানসহ কয়েকজনের ফাঁসি নিশ্চিত করা যাতে বাঙালির স্বাধীনতা আন্দোলন স্তব্ধ হয়ে যায়। আনুষ্ঠানিকভাবে মামলাটি ১৯৬৮ সালে ১৯ জুন আদালতে তোলা হয়েছিল। ঢাকা কুর্মিটোলাস্থ সেনানিবাসের একটি পরিত্যক্ত বাংলোতে অতি সতকর্তামূলক ব্যবস্থার মধ্যে উক্ত মামলাটির বিচার কার্যক্রম শুরু হয়। কিন্তু দ্রুতই এই মামলা বুমেরাং হয়ে দাঁড়ায় পাকিস্তান সামরিক শাসকদের জন্য।
মামলার শুরুর দিন থেকেই ঢাকা শহরসহ সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানের সাধারণ মানুষ ও রাজনৈতিক মহল প্রহসনের এ বিচারের বিরুদ্ধে ফুঁসে উঠে। আন্দোলন, হরতাল-ধর্মঘট, মিছিল-মিটিং, ঘেরাও ইত্যাদির মাধ্যমে এই মামলার বিরুদ্ধে আন্দোলন আরও তীব্র আকার ধারণ করে। ১৯৬৮ সালের শেষ দিকে রাজনৈতিক অঙ্গন ও ছাত্র সমাজ উত্তপ্ত হয়ে ওঠে এবং গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আন্দোলন দানা বেঁধে ওঠে। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ১১ দফা কর্মসূচি নিয়ে আন্দোলন অবশেষে বাঁধভাঙা গণবিক্ষোভে রূপ নেয়।
১৯৬৯ সালের জানুয়ারি মাসে কারফিউসহ সকল দমননীতি উপেক্ষা করে হাজার হাজার বাঙালি ঢাকার রাজপথ প্রকম্পিত করে এবং আন্দোলনের দাবানল ছড়িয়ে দেয় সমগ্র পূর্ববাংলায়। এমনি অবস্থায় ১৯৬৯ এর ১৫ ফেব্রুয়ারি সার্জেন্ট জহুরুল হক ও ফ্লাইট সার্জেন্ট ফজলুল হককে সেনানিবাসের মধ্যে আটক অবস্থায় পাকিস্তানি সেনার একজন সদস্য ঠান্ডা মাথায় গুলি চালায়। রাত ১০টার দিকে গুরুতর আহত সার্জেন্ট জহুরুল হক সিএমএইচ এ শাহাদত বরণ করেন। এই ঘটনার পর ঢাকার রাজপথে লাখো জনতার বিস্ফোরণ ঘটে এবং আন্দোলনের ব্যপ্তি ছড়িয়ে পড়ে বাংলার আনাচে-কানাচে।
১৬ ফ্রেব্রুয়ারি ১৯৬৯ ড. জোহার দায়িত্বে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বার্ষিক ক্রীড়ানুষ্ঠান চলাকালীন সার্জেন্ট জহুরুল হকের হত্যার খবরটি পৌঁছালে সঙ্গে সঙ্গে জোহার নির্দেশে অনুষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়া হয়। সার্জেন্ট জহুরুল হক হত্যার বিচার চেয়ে, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার ও শেখ মুজিবের মুক্তি চেয়ে ছাত্ররা ওই দিনই সমগ্র ক্যাম্পাস মিছিলে প্রকম্পিত করে। পরদিন ১৭ ফেব্রুয়ারি বেলা ৩টায় পূর্ব সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ছাত্র-ছাত্রীদের বিশাল একটি মিছিল শহরেরর দিকে রওয়ানা হলে প্রথমে মিছিল থেকে তদানীন্তন পার্লামেন্টারি সেক্রেটারি ও মুসলিম লীগ নেতা আয়েন উদ্দিনের বাসায় আক্রমণ চালানো হয়। অতঃপর মিছিল সাহেব বাজার প্রদক্ষিণ শেষে রাজশাহী কলেজের তৎকালীন অধ্যক্ষ অধ্যাপক আব্দুল হাই-এর বাসায় আক্রমণ চালায়।
হাই সাহেবের বাসার সামনের রাস্তায় ছাত্রদের উপর পুলিশের অবাঙালি অতিরিক্ত এক পুলিশ সুপারের নেতৃত্বে পুলিশ ব্যাপক লাঠি চার্জ করলে ১০/১২ জন ছাত্র গুরুতর আহত হন। আহত ছাত্রদের চিকিৎসা দেওয়ার পরিবর্তে বোয়ালিয়া থানায় আনা হলে, বিপন্ন আহত ছাত্রদের উদ্ধারের জন্য প্রক্টর ড. জোহা তার ভক্সওয়াগন গাড়ি নিয়ে বোয়ালিয়া থানায় হাজির হন এবং ছাত্রদের দ্রুত চিকিৎসার ব্যবস্থা করার জোর দাবি জানাতে থাকেন। ফলে পুলিশ কর্তৃপক্ষ বাধ্য হয়ে আহতদের পুলিশ ভ্যানে তুলে হাসপাতালে নিয়ে যায়। ড. জোহা সেদিন নিজে পাঁজাকোলা করে আহত ছাত্রদের ভ্যানে তুলে দেন এবং এসময় তার গায়ের সাদা পোশাক ছাত্রদের রক্তে লাল হয়ে যায়।
ওই দিনই সন্ধ্যায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনের সামনে তৎকালীন শহীদ মিনারের পাদদেশে অনুষ্ঠিত ছাত্র-শিক্ষক প্রতিবাদ সভায় ড. জোহা বলেন, ‘সিরাজদ্দৌলাকে অন্ধকূপ হত্যার মিথ্যা দুর্নাম দেওয়া হয়েছিল। আজ অন্ধকূপ দেখে এসেছি। ছোট্ট একটা গাড়িতে বারো-চৌদ্দজন রক্তাক্তদেহী ছাত্রকে ঠাসাঠাসি করে তোলা হয়েছিল।’
তিনি আরও বলেছিলেন, ‘আমার ছেলের রক্তের দাগ আমার গায়ে লেগেছে, সেজন্য আমি গর্বিত। আমিও যদি একটু এমনি রক্ত দিতে পারতুম....’। সভায় ড. জোহা বজ্রকণ্ঠে ঘোষণা করেন, ‘এরপর আর যদি গুলি করা হয়, কোনো ছাত্রের গায়ে লাগার আগে সে গুলি আমার বুকে লাগবে।’ এরপর রাত ৯টার দিকে জিন্নাহ হলের (বর্তমানে শেরেবাংলা হল) সামনে নাটোর রোডে পাবলিসিটি অফিসের একটি জিপ গাড়ি থেকে পুলিশ পরদিন সকালে ১৪৪ ধারা জারির কথা মাইকে প্রচার করছিল। উত্তেজিত ছাত্ররা পুলিশের কাছ থেকে মাইকটি কেড়ে নিয়ে জিপে আগুন দিলে পুলিশ পালিয়ে যায়।
আর এদিকে গুজব ছড়ানো হয় জিন্নাহ হলের ছাত্ররা মাইকসহ একজন পুলিশকে ধরে হলে নিয়ে গেছে। ফলে রাত থেকেই ক্যাম্পাসে চরম উত্তেজনা বিরাজ করছিল। পরদিন ১৮ ফেব্রুয়ারি পূর্বরাত্রির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সকাল সাড়ে ৯টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের মেইন গেটে প্রায় হাজার দুয়েক ছাত্র-ছাত্রী বিভিন্ন হল থেকে এসে সমবেত হয় এবং চারজন করে লাইনে দাঁড়িয়ে শহরেরর দিকে অগ্রসর হওয়ার চেষ্টা করছিল। পুলিশ ও ইপিআর মিছিলে বাধা দেয়, সেনাবাহিনীর জোয়ানরাও মিছিল ঠেকাতে ছাত্রদের দিকে রাইফেল তাক করে প্রস্তুত।
ছাত্ররা যেকোনো মূল্যে মিছিল করতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ এবং তারা কর্মরত সেনা অফিসারের সঙ্গে তুমুল বিতর্কে লিপ্ত হন। মিছিল অগ্রসর হলে গুলি করার হুমকি দেওয়া হলে ছাত্ররা আরও উত্তেজিত হয়ে উঠে। ড. জোহা তার সহকর্মীদের নিয়ে একবার ছাত্রদের পরিস্থিতির ভয়াভহতা বোঝাচ্ছেন আবার কখনো কর্মরত সেনা কর্মকর্তা ও ম্যাজিস্ট্রেটকে বোঝাচ্ছিলেন। ড. জোহা সামরিক কর্মকর্তাকে বারবার বলছিলেন, ‘প্লিজ ডোন্ট ফায়ার, আমার ছাত্ররা এখনই চলে যাবে ক্যাম্পাসের দিকে।’ কিন্তু অবাঙালি সামরিক অফিসারটিকে প্রথম থেকেই উত্তেজিত মনে হচ্ছিল এবং তিনি বার বার জোয়ানদের গুলি করার জন্য প্রস্তুত হতে বলছিলেন।
ড. জোহা তার সহকর্মীদের নিয়ে অনেক কষ্টে একসময় ছাত্রদের বুঝিয়ে গেটের ভেতরে পাঠাতে সক্ষম হলেন এবং ছাত্রদের অধিকাংশই তখন গেটের ভেতর হকি গ্রাউন্ডে চলে এসেছে। পরিস্থিতি যখন শান্ত হওয়ার পথে তখনই হঠাৎ করে গুড়ুম গুড়ুম করে গুলির শব্দ। মুহূর্তের মধ্যেই আতঙ্ক ও উৎকণ্ঠা ছড়িয়ে পড়ে ছাত্র-শিক্ষকদেরে মাঝে। প্রথমে ছাত্ররা বুঝতে পারছিলেন না ড. জোহা ও তার সহকর্মীদের ভাগ্যে কী ঘটেছে।
দুপুর ১২টার দিকে ক্যাম্পাসে খবর আসে ড. জোহাকে প্রথমে কাছ থেকে গুলি ও পরে বেয়নেট চার্জ করে ক্ষত-বিক্ষত করা হয় এবং তিনি মরণাপন্ন অবস্থায় রাজশাহী পৌরসভার একটি পুলিশ ভ্যানে প্রায় দেড়ঘণ্টা ধরে পড়ে আছেন। পরে ডিসি সাহেবসহ কিছু সিভিল অফিসার সেখানে এলে তাদের নির্দেশে ড. জোহাকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। খবর পেয়ে ছাত্র-জনতা ভিড় জমায় হাসপাতালে। ইতোমধ্যেই অনেক দেরির কারণে প্রচুর রক্তক্ষরণ ঘটায় অপারেশন থিয়েটারে অনেক চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন ড. দত্ত। দুপুর ১টা ৪০ মিনিটে ড. জোহা ইন্তেকাল করেন এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে প্রথম শহীদ বুদ্ধিজীবী হিসেবে ইতিহাসের পাতায় নাম লিখান। এর পরের ইতিহাস তো সবার জানা। ড. শামসুজ্জোহার রক্তস্নাত পথ ধরে গণআন্দোলন গণঅভ্যুত্থানে পরিণত হয়।
ড. জোহা ’৬৯ সালে যখন শহীদ হন তখন ছোট্ট শিশুকন্যা ডালিয়া জোহা ও স্ত্রী নিলুফার জোহাকে রেখে যান। দীর্ঘ ৩৪ বছর পর ডালিয়া সাবরিনা জোহা তার মাসহ স্বামী ও দুসন্তান নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র থেকে বাংলাদেশে আসেন। ২৫ ডিসেম্বর ২০০৪ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে তার বাবার কবর জিয়ারত করে শহীদ স্মৃতি সংগ্রহশালা পরিদর্শন করেন। তার বাবার স্মৃতি চিহ্ন ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখেন। সে সময় তিনি বারবার আবেগে ভারাক্রান্ত হয়ে পড়ছিলেন।
আমার সঙ্গে জোহা স্যারের স্ত্রী ও কন্যার অনেক কথা হয়, তাদের হৃদয় জুড়ে জোহা স্যার উজ্জ্বল নক্ষত্রের মতো দীপ্যমান। তারা চায় জোহা স্যারের আত্মত্যাগের ইতিহাস ছড়িয়ে পড়ুক নতুন প্রজন্মের মাঝে। সংগ্রহশালা পরিদর্শনের পর ডালিয়া সাবরিনা জোহা মন্তব্য বইতে লিখেন- “This has been a long awaited visit to Rajshahi University and my father’s grave with mixed feeling of delight and sorrow. I am delighted to visit Rajshahi University Shaheed Smiriti Sangrashala. I am very pleased to see how my father, late Shamsujjoha’s memories and history has been present. My sincere thanks to all members and associates of this organization for their hard work, dedications and admiration for my father.”
২০০৪ সালে ২৫ ডিসেম্বর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ স্মৃতি সংগ্রহশালায় জোহা স্যারের স্ত্রী, মেয়ে, নাতি ও নাতনির সঙ্গে লেখক ও তার স্ত্রী দিলরুবা খানম প্রধান
ড. শহীদ জোহা দেশের জন্য প্রথম বুদ্ধিজীবী হিসেবে শহীদ হওয়ায় ১৮ ফ্রেব্রয়ারি তারিখটি বাঙালির স্বাধীনতা আন্দোলনের একটি উজ্জ্বল দিন। ড. জোহার স্মরণে ও তার প্রতি যথাযথ শ্রদ্ধা জানাতে দীর্ঘদিন থেকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় পরিবার এ দিনটিকে মহান শিক্ষক দিবস হিসেবে পালন করে আসছে। কিন্তু জোহার ঐতিহাসিক অবদানকে শুধু রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে পৌঁছে দিতে হবে দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়সহ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক ও ছাত্র-ছাত্রীদের মাঝে।
এ লেখা লিখতে গিয়ে আমি দেখলাম স্কুলের বিভিন্ন ক্লাসের পাঠ্যসূচিতে ড. জোহা সম্পর্কে কোনো আলোচনাই নেই। ১৮ ফেব্রুয়ারিতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ব্যতিত অন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কোনো কর্মসূচিও তেমন পালিত হয় না। ১৮ ফেব্রুয়ারিকে যদি জাতীয় শিক্ষক দিবস হিসেবে রাষ্ট্রীয়ভাবে পালনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়, তাহলে জোহা স্যারের অবদানের ব্যপ্তি ছড়িয়ে পড়বে দেশব্যাপী এবং শিক্ষার্থীরাও তাকে জানার ও চেনার সুযোগ পাবে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের বিভিন্ন মহল বিভিন্ন সময়ে ১৮ ফেব্রুয়ারিকে রাষ্ট্রীয়ভাবে জাতীয় শিক্ষক দিবস হিসেবে ঘোষণার দাবি জানিয়ে আসছে। ২০০৮ সালে ড. জোহাকে মরনোত্তর স্বাধীনতা পুরস্কার দিয়ে সম্মাননা জানানোয় জাতি খুশি হয়েছিল। আমরা আশা করি জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকারও ১৮ ফেব্রুয়ারিকে রাষ্ট্রীয়ভাবে জাতীয় শিক্ষক দিবস হিসেবে ঘোষণা দিয়ে ড. জোহার স্মৃতি ও আদর্শকে জাতির কাছে চির অম্লান করে রাখবে।
ড. মো. হাসিবুল আলম প্রধান: সভাপতি, আইন বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।
এসএন