জনগণের সেবাপ্রাপ্তিতে ডিসি সম্মেলন-২০২৩
প্রতি বছরের মতো এবারও তিন দিনব্যাপী ডিসি সম্মেলন শেষ হলো। ২৪ জানুয়ারি শুরু হওয়া এ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী ২৫টি নির্দেশনা দিয়েছেন। তিনি ডিসিদের স্মরণ করিয়ে দেন যে, জনগণের ট্যাক্সের টাকায় তাদের বেতন-ভাতা দেওয়া হয়। অতএব জনগণকে কাঙ্ক্ষিত সেবা প্রদান করা প্রতিটি সরকারি কর্মচারীর দায়িত্ব। সে জন্য সেবার মনোভাব নিয়ে সত্য ও ন্যায়ের পথে অবিচল থেকে দায়িত্ব পালন করার কথা তিনি তাদের স্মরণ করিয়ে দেন।
রাষ্ট্রের প্রধান নির্বাহী হিসেবে প্রধানমন্ত্রী অবশ্যই একথা তাদের বলবেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীকে সবিনয়ে আরও অনুরোধ করব যে, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোতে জনগণ কী ধরনের সেবা পাচ্ছে তার একটি সঠিক ও গোপন প্রতিবেদন যদি তিনি সংগ্রহ করতে পারেন এবং রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান থেকে জনগণের সেবাপ্রাপ্তির একটি নির্দিষ্ট সময়সীমা বেঁধে দিতে পারেন সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে তাহলে অনেক বেশি কাজ হবে। কারণ রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে প্রকৃতঅর্থে জনগণের সেবাপ্রাপ্তিতে হয়রানির পরিমাণ যে কত বেড়ে গেছে তা সম্ভবত তাদের কাছে পৌঁছায় না। জনকল্যাণমুখী কোনো সিস্টেমের ভেতর নিয়ে আসতে পারলে জনগণ সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের কাছ থেকে সেবা পাওয়ার আশা করতে পারেন।
জাতীয় সংসদের স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী বলেন, আধুনিক, তথ্যনির্ভর, জনসম্পৃক্ত এবং স্মার্ট বাংলাদেশ গঠনে জেলা প্রশাসকদের ভূমিকা অনন্য। তিনি বলেন, ’বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় জ্ঞান ও দক্ষতার বিকাশ ঘটিয়ে আইন অনুযায়ী জেলা প্রশাসকদের নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করে যেতে হবে। জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে নিয়ে জেলা প্রশাসকগণ মাদক সমস্যা রোধ, বাল্যবিবাহ দূরীকরণ ও দুর্নীতি প্রতিরোধে জিরো টলারেন্স নীতি অবলম্বন করলে দেশে অচিরেই আর্থ সামাজিক উন্নয়নে গতিশীলতা আসবে।
পরিবেশ বন ও জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক মন্ত্রী দেশের পরিবেশ ও বনের সুরক্ষা ও উন্নয়নে জেলা প্রশাসকসহ স্থানীয় প্রশাসনের সহায়তা চেয়েছেন। যত্রতত্র অবৈধ ইটভাটা স্থাপন, জ্বালানি হিসেবে বনজ কাঠের অবৈধ ব্যবহার, নিষিদ্ধ পলিথিন শপিং ব্যাগ, অবৈধভাবে পাহাড়-টিলা কর্তনকারী, অবৈধ করাতকল, বনভূমি ও নদী-খাল জলাশয় জবর দখলকারীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য জেলা প্রশাসকদের তিনি অনুরোধ জানিয়েছেন।
এ ছাড়া তিনি শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণ, বনায়ন কার্যক্রম, ইউক্যালিপটাসসহ ক্ষতিকারক বৃক্ষরোপন রোধ, বনভূমি বন্দোবস্ত না দেওয়া, অবৈধভাবে বন্যপ্রাণী ও পরিযায়ী পাখির নিধন প্রতিরোধ, সংরক্ষিত বন ঘোষণার কার্যক্রমে জেলা প্রশাসকদের সহায়তা কামনা করেন। তিনি সুন্দরবনের বাস্তুসংস্থান ও পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় নিষেধাজ্ঞাকালে মৌয়াল ও জেলেদের বিকল্প কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির পরিধিভুক্ত করার উদ্যোগ গ্রহণ বিষয়েও কথা বলেন। সেন্ট মার্টিনে যাতে কোনো অবস্থাতেই নতুন স্থাপনা গড়ে না উঠে সেদিকে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য কক্সবাজারের জেলা প্রশাসককে অনুরোধ করেছেন। জেলার পরিবেশ বন ও জলবায়ু পরিবর্তন কর্মকর্তার কী কাজ তা আমরা শুনতে পেলাম না।
স্বাস্থ্যসেবার মানোন্নয়নে জেলা প্রশাসকদের সহায়তা চেয়েছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী। তিনি বলেছেন স্বাস্থ্যখাতে অবকাঠামোগত উন্নয়ন হয়েছে, এখন প্রয়োজন এলাকায় স্বাস্থ্যসেবার মান উন্নত করা। মন্ত্রী বলেন, ’আমাদের জেলা পর্যায় পর্যন্ত মোটামুটি ঠিক আছে, কিন্তু উপজেলা পর্যায়ে স্বাস্থ্যসেবার মান এখনো উন্নত পর্যায়ে পৌঁছায়নি। আমাদের প্রত্যেক উপজেলা সরকারি হাসপাতালে এক্স-রে, আল্ট্রাসনোগ্রাফি মেশিন আছে। কোথাও কোথাও টেকনিশিয়ান না থাকায় সেগুলোতে একটু সমস্যা হচ্ছে। আবার কোথাও মেশিনে কারিগরি ত্রুটি থাকতে পারে। তবে মেশিন নেই, এ কথা ঠিক না--।’ তো এখানে ডিসি কী করবেন? জেলায় একজন সিভিল সার্জন আছেন, তার কাজ কী? শুধু বদলি করা? জনপ্রতিনিধির কাজ কী? সরকারি এসব বিষয় নিয়ে কথা বলতেও চাই না কারণ হতাশা আরও বাড়ে।
মন্ত্রী মহোদয় বলেছেন জেলা পর্যন্ত স্বাস্থ্য সেবা ঠিক আছে। মন্ত্রী মহোদয় সরকারের চিকিৎসা ও স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতেই পারেন। কিন্তু আমাদের প্রশ্ন দেশের সাধারণ মানুষের আসলে কি কোনো চিকিৎসা আছে? অসুস্থ হলে যাদের সঙ্গতি আছে তারা সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড আর ভারতে যান। বাকিরা দেশের উপজেলা থেকে শুরু করে রাজধানীর সব প্রাইভেট হাসপাতালে চিকিৎসা নেন। যাদের কোনো ধরনের সামর্থ্য নেই তারা সরকারি হাসাপাতালে যান চিকিৎসার জন্য। কিন্তু সেখানে কী চিকিৎসা হয়, তাদের কত কী অবস্থার সম্মুখীন হতে হয় তা ভুক্তভোগীরাই জানেন। সেখানে যারা চিকিৎসা করান না তারা জানবেন না।
আমার মনে আছে বাংলাদেশি এক প্রবাসী সরকারি হাসপাতাল দেখে এসে আমাকে বললেন’ এটা তো গরুর খোয়াড়ের চেয়েও খারাপ। ওখানে গেলে তো মানুষ আরও অসুস্থ হয়ে পড়বে।’ এটি কারুর একক দোষ নয় বা মন্ত্রী মহোদয়কেও বলছি না। এটি আমাদের কালচার। এই কালচার কবে পরিবর্তন হবে আমরা কেউ জানি না।
প্রতিটি জেলায় দায়িত্বপ্রাপ্ত কৃষি কর্মকর্তা, খাদ্য কর্মকর্তা, বন কর্মকর্তা রয়েছেন এবং এভাবে গুরুত্বপূর্ণ সব বিভাগেই প্রায় সমমর্যাদাসম্পন্ন কর্মকর্তা রয়েছেন, যারা নিজ নিজ মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা পালন করেন। তারপরেও প্রশাসনিক কর্মকর্তা হিসেবে জেলা প্রশাসকদেরই রাষ্ট্রের কেন্দ্র থেকে সরাসরি বিভিন্ন নির্দেশনা প্রদান করা হয়। এখানে আমরা কিছুটা হলেও ব্রিটিশ রাজপ্রবর্তিত সেই ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট যারা সাদা চামড়ার মানুষ পাক-ভারত উপমহাদেশকে কীভাবে শাসন করেছিল সেই প্রথাই যেন অনুসরণ করছি।
আমাদের জনপ্রতিনিধিরা যদি সঠিক ও নিরপেক্ষ আচরণ প্রদর্শন করে সে অনুযায়ী কাজ করার উদাহরণ সৃষ্টি করতে পারতেন তাহলে ডেপুটি সেক্রেটারি পদবির ডিসি নামক সরকারি একজন কর্মকর্তার উপর রাষ্ট্রীয় প্রশাসনকে এত নির্ভরশীল হতে হতো না। রাষ্ট্রের এমন কোনো কার্যাবলী নেই যার জন্য ডিসির উপর নির্ভর করতে না হয়। ব্রিটিশ যে কারণে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট পদটি বানিয়েছিল প্রায় আড়াইশ বছর পরেও তেমন কোনো পরিবর্তন হয়নি যদিও আমরা দু’বার স্বাধীন হয়েছি।
পূর্বের ডিসি সম্মেলনগুলোতে ডিসিরা বিভিন্ন বিষয়ে ক্ষমতা চাইতেন। প্রশাসন ক্যাডারের জন্য পৃথক ব্যাংক, স্পেশাল ফোর্স, দিবস উদযাপনে কোটি টাকা বরাদ্দ, জ্বালানি তেল ব্যবহারের সীমা তুলে দেওয়া এবং ইউনিয়ন পরিষদে প্রশাসক নিয়োগের ক্ষমতা চেয়েছিলেন। বিচারিক ক্ষমতা চেয়েছিলেন। এবার নাকি তারা এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীদের রাজনীতি বন্ধ করার কথা বলেছেন। এভাবে মোট ২৪৪টি প্রস্তাব তুলে ধরার কথা শোনা যাচ্ছে।
প্রতি বছর দেখি ’পুলিশ সপ্তাহ‘ পালন করা হয়। কেন করা হয় জানি না। তবে পত্রিকার পাতায় দেখি প্রচুর সুবিধা পাওয়ার জন্য মাঝে মাঝে দেখি সেনাবাহীর মতো কিংবা তারচেয়েও বেশি সুবিধা পাওয়ার জন্য ফিরিস্তি তুলে ধরা হয় এবং সেগুলোর মধ্যে অনেকগুলো পূরণও করা হয়। কিন্তু তাতে জনগণের কী? শান্তিপ্রিয় জনগণ কি কখনো পুলিশের শরণাপন্ন হওয়ার আশ্বাস পান, বা তারা কি প্রকৃত অর্থে পুলিশের সহায়তা পান কখনো?
ঘণ্টা দেড়েক জ্যামে বসে থেকে গাড়িটি যখন সামনে আগাচ্ছে হঠাৎ পুলিশ সার্জনের হাতের ইশারায় গাড়ি রাস্তার পাশে নিতে হলো। কেন? কাগজপত্র চেক করবেন। চেক করল, কোনো সমস্যাই পাওয়া গেল না, ড্রাইভারকে বলল, তোমার সিটবেল্ট ঠিকমতো পরা হয়নি। ড্রাইভার বলল, স্যার ঠিকইতো আছে। ধমক, আবার কথা বলছ। গাড়ি থেকে নেমে পরিচয় দেওয়ার পর বলল, ‘এই টাকাটা জমা দিয়ে গাড়িতে গিয়ে বসেন। আর কথা বললে আপনার বাসায় কাগজ চলে যাবে তিন হাজার বা তারচেয়েও বেশি।’
সাতশত টাকা দিতে হলো (অযথাই দেওয়া)। কী সুন্দর পুলিশ সেবা! আর একবার ’জিডি করতে গিয়ে যা দেখলাম, একজন এসে পকেটে কিছু টাকা ঢুকিয়ে দিয়ে কোনো এক চায়ের দোকানদারকে থানায় সবকিছুসহ তুলে আনতে বললেন। বিন্দুমাত্র দেরি না করে তাই করা হলো। চমৎকার সেবা! জনগণ যত সাধারণ, রাষ্ট্রীয় যন্ত্রের অত্যাচার তাদের উপর তত বেশি।
এ থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার কোনো পথই নেই বরং এই ওজন যেন আরও দিন দিন বাড়ছে। ঢাকার বাইরে কোথাও যাবেন, পথে পথে যেখানে পুলিশের সহায়তা প্রয়োজন সেখানে তারা নেই। তাদের দেখবেন খালি রাস্তায় গাছের নিচে দাঁড়িয়ে আছে, গাড়ির হেলপার, ড্রাইভার, ছোটখাট যারা তাদের সামনে দিয়ে ক্রস করার চেষ্টা করে তাদের ফাঁদে পড়ছে এবং তাদের সঙ্গে দফরফা চলছে। সামনে গাড়ির বড় লাইন, কিছু চলছে না, সেখানে তারা নেই। জনগণের জন্য রাষ্ট্রীয় সেবার নমুনা! পাসপোর্ট অফিসে গেলে কী মনে হয় আমরা স্বাধীন দেশে আছি?
আমরা যদি নির্দিষ্ট কিছু সিস্টেমে পরিবর্তন আনতে পারি তাহলে হয়তো জনগণ আশা করতে পারে যে, তারা রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে কিছুটা হলেও উপকার পাবে। তা নাহলে তাদের জিম্মি করে রেখে সব প্রতিষ্ঠানই সেবার পরিবর্তে হয়রানি উপহার দিয়ে যেতে থাকবে। জনগণের এইসব দুর্দশা দেখার আসলে কেউ আছে কি?
উন্নত বিশ্বসহ পৃথিবীর অনেক দেশেই আপনি ভাড়া করা গাড়ি বা ট্যাক্সিতে সরাসরি উঠবেন, কোনো ট্যাক্সি আপনাকে না বলতে পারবে না। তারা জিজ্ঞেসও করতে পারবে না আপনি কোথায় যাবেন। এটি আইনবিরোধী কাজ। যাত্রী আগে ট্যাক্সিতে উঠে ড্রাইভারকে বলবেন তিনি কোথায় যাবেন। উনি যেখানে যেতে চান, ড্রাইভার তাকে সেদিকে নিয়ে যেতে বাধ্য। এই সিস্টেম তারা করে নিয়েছে। আমাদের ঢাকায় কী হয়? কোনো সিএনজি কি আপনার গন্তব্যে যাবেন? যাবেন না। একজন যাত্রীকে বেশ কয়েকটি সিএসজিকে অনুরোধ করতে হবে, দর কষাকষি করতে হবে, তারপরে আপনাকে গাড়িতে উঠতে হবে।
বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো আন্তর্জাতিক উবার সেবা চালু করা হলো, সেখানেও সব উবার সব সময় সব জায়গায় যেতে চায় না। অর্থাৎ সেখানেও আমাদের কালচারের রং লেগে গেছে। এটিতো প্রাইভেট পর্যায়ে, সরকারি হলে তারা সব সরকারি কর্মকর্তা হয়ে যেত। পাবলিক ট্রান্সপোর্টের কী অবস্থা সেটি তো আমরা সবাই জানি। এসব অবস্থার পরিবর্তনের আশা কি জনগণ আসলেই করতে পারে?
মাছুম বিল্লাহ: প্রেসিডেন্ট, ইংলিশ টিচার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ইট্যাব)।
এসএন