পর্যটনে রাজনৈতিক অর্থনীতির প্রভাব
অর্থনীতি মূলত সামাজিক বিজ্ঞানের একটি শাখা- যা পণ্য ও সেবার উৎপাদন, সরবরাহ, বিনিময়, বিতরণ এবং ভোগ ও ভোক্তার আচরণ নিয়ে আলোচনা করে। এল রবিনসের মতে, অর্থনীতি মানুষের অসীম অভাব ও বিকল্প ব্যবহারযোগ্য সীমিত সম্পদের সম্পর্কবিষয়ক মানব আচরণ নিয়ে আলোচনা করে। অর্থনীতি শব্দটি গ্রিক শব্দ থেকে উদ্ভূত যার অর্থ গৃহস্থালী পরিচালনা। এ থেকে সহজেই বুঝা যায় যে, অর্থনীতি জীবনধারা সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত।
রাজনৈতিক অর্থনীতি অর্থ হলো রাজনৈতিক পদ্ধতি যথা- সরকার, আইন, প্রতিষ্ঠান ইত্যাদি। আর অর্থনৈতিক পদ্ধতি যথা- বাজার ও জাতীয় অর্থনীতি ইত্যাদির পারস্পরিক সম্পর্ক; যা অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক আচরণের আঙ্গিক নির্ধারণ করে। এই পারস্পরিক সম্পর্ক সমন্বিত ও প্রথাগত অর্থনীতিকে অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক চ্যালেঞ্জের হাত থেকে সুরক্ষা দেয় এবং নিজ আঙ্গিকে বিকশিত হতে সাহায্য করে। একটি ভূখণ্ডের শ্রমবাজার ও অর্থবাজার কাঙ্ক্ষিত অবস্থায় পরিচালনা করতে হলে প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে আইন প্রয়োগের জন্য সরকারকে এগিয়ে আসতে হয়। মূলত এটিই অর্থনীতির উপর রাষ্ট্র কর্তৃক প্রযোজ্য রাজনৈতিক প্রভাব। এই প্রভাব উৎপাদন ও বাজারের প্রবৃদ্ধি, আর্থিক অসমতা নিয়ন্ত্রণ এবং বাণিজ্যিক প্রসারে জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটায়।
ষোড়শ শতকে উদ্ভাবিত এই অর্থনীতির নবতর রূপ আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে উৎকর্ষ প্রদান করেছে। তাই রাজনৈতিক অর্থনীতির অপর নাম রাষ্ট্রীয় অর্থনীতি। রাষ্ট্র তার নিজস্ব ও আন্তর্জাতিক আইন, প্রচলিত পদ্ধতি, উৎপাদন ও ক্রয়-বিক্রয় ইত্যাদি নিয়ে জনগণের শাসনব্যবস্থা কায়েম করে থাকে। উল্লেখ্য, ঊনিশ শতকে রাজনৈতিক অর্থনীতি পরিভাষা সর্বজনীনতা লাভ করে।
পর্যটন অর্থনীতি হলো অর্থনীতির একটি প্রয়োগিক শাখা যা, পর্যটন কর্মকাণ্ড দ্বারা পরিচালিত ও প্রভাবিত। এইরূপ অর্থনীতিতে ব্যয় সিদ্ধান্ত, বিনিয়োগ সিদ্ধান্ত, বাজারের সাংগঠনিক অবয়ব, মূল্য, সেবা ও পণ্যের পরিমাণ, প্রতিযোগিতা, পর্যটন নীতি ও পরিকল্পনা এবং আন্তর্জাতিক পর্যটনের নানাবিধ ইস্যু অন্তর্ভুক্ত। গন্তব্যের প্রতি পর্যটকদের আকর্ষণ, গন্তব্যে গমনাগমন ও গন্তব্যে অবস্থানের দৈর্ঘ্য ইত্যাদি পর্যটন অর্থনীতির মুখ্য বিষয়; যা পর্যটন পণ্যসমূহের ভিন্নধর্ম ও বহুতা দ্বারা পরিচালিত। ভিন্নধর্ম হলো বিভিন্ন দ্রব্য ও সেবার তালিকা যাদের সমন্বয়ে পর্যটন পণ্য তৈরি হয় এবং বহুতা হলো পণ্যের তালিকার বৈচিত্র্য, যা পর্যটকরা ভ্রমণকালে ক্রয় করেন। পণ্যের এই দুটি বৈশিষ্ট্যের সমন্বয়ে পর্যটন ব্যয় সংগঠিত হয়। এ থেকে বুঝা যায় যে, পর্যটন অর্থনীতি মূলত গন্তব্য, সরবরাহকারী ও পর্যটক দ্বারা বেষ্টিত। বলা বাহুল্য, ব্যষ্টিক ও সামষ্টিক উভয় ধরনের অর্থনীতি পর্যটনকে প্রত্যক্ষ, পরোক্ষ ও আবেশিতভাবে রূপদান করে।
এবার পর্যটন অর্থনীতিতে রাজনৈতিক অর্থনীতির প্রভাব নিয়ে আলোচনা করা যাক। পর্যটন খাতের মোট ১২টি উপখাত রয়েছে। এগুলো হলো- পর্যটন যানবাহন, খাদ্য ও পানীয়, পর্যটন আবাসন, পর্যটন আকর্ষণ ও বিনোদন পার্ক, পর্যটন কার্যক্রম, মধ্যস্থতাকারী, পর্যটন শিক্ষা, পর্যটন মিডিয়া ও প্রকাশনা, পর্যটন প্রযুক্তি, পর্যটন ইভেন্ট, পর্যটন মার্কেটপ্লেস ও পর্যটনের বিবিধ কর্মকাণ্ড। প্রত্যেকটি উপখাত কোনো না কোনো ধরনের পর্যটন কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য ব্যবহার করা হয়। তাই পর্যটনের রাজনৈতিক অর্থনীতি বুঝতে হলে এর প্রত্যেকটি কর্মকাণ্ড সুস্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন। পর্যটনের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনায় অন্তত নিচের ৮টি বিষয় প্রত্যক্ষভাবে জড়িত। এদের সঙ্গে রাজনৈতিক পদ্ধতি কীভাবে সম্পৃক্ত, নিচে তা উপস্থাপন করা হলো:
প্রথমত, পর্যটনের সঙ্গে উৎসস্থল খাদ্য ও যানবাহন এবং গন্তব্যস্থল প্রত্যক্ষভাবে জড়িত। এদের একসঙ্গে পর্যটন পদ্ধতি হিসেবে অভিহিত করা হয়। পর্যটন পরিচালনায় এই ৩টি উপাদান অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। তাই এদের বাদ দিয়ে পর্যটন পরিচালনা করা সম্ভব নয়। গন্তব্যস্থল ভিন্ন দেশে হলে ভ্রমণে একজন পর্যটকের জন্য প্রয়োজনীয় ভিসা লাগবে। উভয় দেশে খাদ্য ও যানবাহন লাগবে এবং গন্তব্যস্থলে সব ধরনের পর্যটন সেবার আয়োজন থাকতে হবে। ফলে উৎসস্থল ও গন্তব্যস্থলের মধ্যে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক সম্পর্ক থাকা অপরিহার্য। মুদ্রা বিনিময়, উভয় দেশের কর ব্যবস্থা ও রাষ্ট্রীয় স্বার্থ সংরক্ষণ করেই পর্যটন পরিচালিত হয়। গন্তব্যস্থলের স্থানীয় সরকার কর্তৃক পর্যটনবান্ধব ব্যবস্থাপনা, বাজার ব্যবস্থা ও সুশাসন পরিচালিত হয়। অর্থাৎ পর্যটন পদ্ধতি পরিচালনায় উৎসস্থল ও গন্তব্যস্থলের মধ্যে বিধিবদ্ধ সম্পর্ক অপরিহার্য।
দ্বিতীয়ত, গন্তব্যে বিনিয়োগবান্ধব নীতি গ্রহণ করার মাধ্যমে দেশি ও বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করতে হবে। গন্তব্যস্থল গড়ে তোলার কোনো বিকল্প নেই। মালদ্বীপসহ অনেক দেশের পর্যটন ব্যবস্থা এইভাবে গড়ে উঠেছে। এই বিষয়ে গন্তব্যস্থলের সরকারকে অর্থনৈতিক স্বার্থে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হয়। এতে বিলম্ব, কমতি বা কার্পণ্য থাকলে সে দেশের গন্তব্যে পর্যটন বিকাশ লাভ করবে না। বিশেষত ক্যাপিটাল মেশিনারি আমদানি ক্ষেত্রে কর রেয়াত, কর অবকাশ, পর্যটন রপ্তানি ক্ষেত্রে ইনসেনটিভ প্রদান ইত্যাদি আর্থিক সুবিধা ঘোষণার মাধ্যমে পর্যটন গন্তব্যে ছোট বড় সব বিনিয়োগে গুরুত্ব দিতে হবে।
তৃতীয়ত, পর্যটন পণ্য ও সেবা উৎপাদন, সংরক্ষণ ও প্রদান করা পর্যটন পরিচালনায় প্রত্যক্ষ ভূমিকা রাখে। গন্তব্যে পর্যটকের ভোগ ব্যবস্থার সঙ্গে এইসব পণ্য ও সেবা ওতপ্রোতভাবে জড়িত। তাই রাষ্ট্র বা স্থানীয় সরকারের উচিত কাঁচামাল উৎপাদন বা আমদানির ক্ষেত্রে বিশেষ আর্থিক সুযোগ সৃষ্টি করা। এই উদ্দেশ্যে ঋণ ব্যবস্থা সহজীকরণ, জনবল তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ প্রদান ইত্যাদির জন্য স্বল্প ও মধ্যমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করা বাঞ্ছনীয়। বিশেষত পর্যটন পণ্যের মানোন্নয়ন ও উৎকর্ষ সাধনের জন্য প্রশিক্ষণ ও মনিটরিং করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। রাষ্ট্রের সকল নীতিকে পর্যটন সহায়ক করে প্রণয়ন করার ক্ষেত্রে মনযোগী হতে হবে।
চতুর্থত, গন্তব্যস্থলের সরকারকে পর্যটক কর্তৃক গন্তব্য বা আকর্ষণের প্রতি সিদ্ধান্ত গ্রহণে সহযোগিতা করতে হবে। পর্যটক সৃষ্টিকারী উৎসস্থলের সম্ভাব্য পর্যটকদের জীবনধারা, আচরণ ও সংস্কৃতি বিশ্লেষণ করে সে মতো প্রমোশনাল পরিকল্পনা করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নিজ গন্তব্যস্থল নিয়ে সরকারের প্রমোশনাল বিনিয়োগ মূলত ব্যয় নয়, বরং বিলম্বিত আয় হিসেবে বিবেচিত। কারণ এই অর্থ পর্যটকরা বহুগুণে ফিরিয়ে দেয়। পর্যটন অর্থনীতি গড়ে তোলার জন্য রাষ্ট্র কর্তৃক নানা উপাদানের সমন্বয়ে তৈরি প্রমোশনাল ম্যাটেরিয়াল গন্তব্যের প্রতি পর্যটকদের আকৃষ্ট করে। অধিকন্তু ভিসা ব্যবস্থা সহজীকরণ, আগমনী ভিসা প্রবর্তন, ভিসা ফি হ্রাস বা প্রয়োজনে মওকুফ করে দেওয়া পর্যটকদের গন্তব্য নির্বাচনের সিদ্ধান্ত গ্রহণে বিশেষ সহায়ক ভূমিকা পালন করে।
পঞ্চমত, ভ্রমণকালে পর্যটকরা নানাবিধ পর্যটন পণ্য ও সেবা ক্রয় করে থাকেন। এই ক্রয় পর্যটন ব্যয়ের একটি অন্যতম উপাদান। গবেষণায় দেখা যায় যে, একজন পর্যটক ভ্রমণকালে তার মোট ব্যয়ের ১৫-২০ শতাংশ খাদ্য ক্রয়ে ব্যয় করেন। উল্লেখ্য যে, গন্তব্যের প্রধান ক্রেতা হলো পর্যটক। কিন্তু উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ্য করা যায় যে, প্রায় প্রতিটি গন্তব্যেই পর্যটকদের স্বাভাবিকের চেয়ে অধিক মূল্যে পর্যটন পণ্য ক্রয় করতে হয়। ভোক্তা অধিকারের বিষয়টি সকল ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হলেও গন্তব্যে তা ব্যাপকভাবে লঙ্ঘন করা হচ্ছে। পণ্য ও সেবার মান ও মূল্য নিয়ন্ত্রণে স্থানীয় সরকারকে কঠোরভাবে মনিটরিং করা উচিত। কারণ কোনো গন্তব্যে পর্যটকদের সঙ্গে স্থানীয় জনগোষ্ঠীও বাস করে। ফলে অধিক ও অনিয়ন্ত্রত দ্রব্যমূল্য তাদের নিত্যদিনের জীবনধারায় ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। এই অবস্থা নিয়ন্ত্রণে রাখতে না পারলে পর্যটকরা গন্তব্যে সর্বনিম্ন ব্যয় করবে, যা গন্তব্যের অর্থনীতির প্রবৃদ্ধির হারকে স্থবির করে ফেলতে পারে। এতে প্রকারান্তরে বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান ও আয় সবই কমে যাবে।
ষষ্ঠত, পর্যটকদের সুরক্ষা ও নিরাপত্তা প্রদানের আয়োজন করা সরকারের অন্যতম দায়িত্ব। জাতিসংঘ বিশ্ব পর্যটন সংস্থা কর্তৃক বিশ্বব্যাপী পালনীয় পর্যটন নৈতিকতা অনুযায়ী পর্যটকদের জানমালের নিরাপত্তা প্রদান করা প্রত্যেকটি রাষ্ট্রের দায়িত্ব। এইজন্য অনেক দেশ ট্যুরিস্ট পুলিশ তৈরি করেছে। যারা পর্যটকদের মনে মূলত নিরাপত্তা ধারণা তৈরি করে। এ ছাড়াও হোটেল, রেস্টুরেন্ট, পরিবহন ইত্যাদি স্থানে সুরক্ষা নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি। স্থানীয় সরকার কর্তৃক পর্যটকদের মানসম্মত খাবার নিশ্চিতকরা ও জরুরি চিকিৎসা প্রদান অন্যতম সুরক্ষা কার্যক্রম। সুরক্ষা ও নিরাপত্তা কাজে ট্যুর অপারেটর, স্থানীয় জনগোষ্ঠী এবং স্থানীয় যৌথ উদ্যোগ সবচেয়ে বেশি কার্যকর। পর্যটনে রাজনৈতিক অর্থনীতি গড়ে তোলার ক্ষেত্রে রাষ্ট্র কর্তৃক নিরাপত্তা ব্যবস্থা ও ব্যয় প্রত্যক্ষ ভূমিকা রাখে। একটি দেশের পর্যটন ব্যবস্থাকে টেকসই করার জন্য এই পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
সপ্তমত, পর্যটন পরিচালনার শেষ কথা হলো পর্যটকদের সন্তুষ্টি অর্জন। একজন পর্যটক গন্তব্যে অর্থ, সময় ও শ্রম দিয়ে যান। বিনিময়ে কিছু অভিজ্ঞতা, স্মৃতি ও ধারণা নিয়ে যান। গন্তব্য পর্যটকের অন্তরে স্মরণীয় ইমেজ তৈরি করতে না পারলে পুরো পর্যটনই ব্যর্থ বলে পরিগণিত হবে। বিষয়টি খুবই স্পর্শকাতর, বিধায় পর্যটকদের সন্তুষ্ট করার প্রাথমিক দায়িত্ব ট্যুর অপারেটরদের উপর বর্তালেও ভৌতকাঠামো ও উপরিকাঠামো নির্মাণ, নিরুপদ্রপ পরিবেশ সৃষ্টি, স্বাধীনভাবে সময় কাটানোর ব্যবস্থা করা রাষ্ট্রের দায়। সংযোগ সড়ক, বিদ্যুৎ, পানি, গ্যাস, পাবলিক টয়লেট, প্রাকৃতিক বন, নদী বা জলাশয় ইত্যাদি তৈরি ও ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব রাষ্ট্রকে নিতে হবে। এইজন্য প্রয়োজনীয় পরিকল্পনা, বিনিয়োগ ও রক্ষণাবেক্ষণ কাজে সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে। বিশেষত পর্যটন গন্তব্যগুলোকে অগ্রাধিকারভিত্তিতে গড়ে তোলার পরিকল্পনা আধুনিক পর্যটনবান্ধব রাষ্ট্রের অন্যতম দায়িত্ব।
অষ্টমত, পর্যটক কর্তৃক একই গন্তব্যস্থান পুনঃভ্রমণের সিদ্ধান্ত গ্রহণে প্রভাবান্বিত করা পর্যটন পরিচালনার অন্যতম কাজ। পর্যটকের কাছে গন্তব্যের এমন আবেদন সৃষ্টি করতে হবে, যেন পর্যটক উক্ত গন্তব্যের প্রতি অনুরক্ত হয়ে পড়েন। এই আকর্ষণ একই গন্তব্যে পর্যটকদের দ্বিতীয়বার ভ্রমণে উদ্বুদ্ধ করে। অধিকন্তু ইনসেনটিভ হিসেবে ভ্রমণকর মওকুফ, উপহার সামগ্রী প্রদান, বিশেষ স্বীকৃতি ইত্যাদিও পর্যটককে পুনঃভ্রমণের সিদ্ধান্ত গ্রহণে প্রভাব সৃষ্টি করতে পারে। সরকারের উচিত এইসব প্রগতিশীল চিন্তা প্রসূত পদক্ষেপ গ্রহণ করা। অন্যদিকে গন্তব্যের আবাসন ও যানবাহনে দ্বিতীয়বার ভ্রমণকারীদের জন্য রেয়াতি হারে সেবামূল্য নির্ধারণ করা যেতে পারে। এই জাতীয় সিদ্ধান্ত পর্যটন অর্থনীতিতে বিশেষ রাজনৈতিক প্রভাব সৃষ্টি করবে, যা গন্তব্যের অর্থনীতি গড়ে তোলার ক্ষেত্রে অনেক বড় ভূমিকা পালন করবে।
উপরে বর্ণিত বিষয়গুলো ছাড়াও রাষ্ট্রকে পর্যটন প্রবাহ বিবেচনা করে কতিপয় রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে। পর্যটন প্রবাহের মধ্যে নিচের ৬টি উপাদান রয়েছে। এইসব উপাদান বিবেচনা করে নিম্নবর্ণিত পদক্ষেপগুলি গ্রহণ করা যেতে পারে।
ক. পর্যটকদের আগমন পর্যটকরা গন্তব্যে যেকোনো সময় আসতে পারে এবং যতক্ষণ খুশি অবস্থানের জন্য আসতে পারে। অবস্থানের সময় যা-ই হোক, আগমনকে গুরুত্ব দিয়ে তাদের প্রত্যেকের জন্য প্রয়োজনীয় প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সেবার ব্যবস্থা করতে হবে। এই ক্ষেত্রে বিনিয়োগকারী ও স্থানীয় সরকারকে যৌথভাবে অগ্রগামী ভূমিকা গ্রহণ করতে হবে। বিশেষত নারী, শিশু, প্রতিবন্ধী এবং বিদেশি পর্যটকদের আগমনে অত্যন্ত গুরুত্ব দিতে হবে।
খ. রাত্রিযাপনের সংখ্যা গন্তব্যে ভ্রমণকারী কর্তৃক রাত্রিযাপনের সংখ্যা পর্যটন অর্থনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক। গন্তব্যের ব্যষ্টিক অর্থনীতির আয়তন বাড়াতে হলে পর্যটকদের রাত্রিযাপনের সংখ্যা বাড়াতে হবে। এই উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্য গন্তব্যের উপকরণ কার্যকলাপ বিনোদন, নাইট লাইফ ইত্যাদি বৃদ্ধি করতে হবে। এই জাতীয় পদক্ষেপ গ্রহণে সরকারের নীতি ও পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হবে। একই সঙ্গে দেশি ও বিদেশি বিনিয়োগকে ব্যাপকভাবে উৎসাহিত করতে হবে।
গ. গন্তব্যে গড় অবস্থান গন্তব্যে ভ্রমণকারী কর্তৃক রাত্রিযাপনের গড় সংখ্যা বৃদ্ধি করা গন্তব্য পরিকল্পনা অন্যতম বিষয়। পর্যটকদের গড় অবস্থান বৃদ্ধির অর্থ পর্যটক কর্তৃক সেবা ও পণ্য ভোগ এবং অভিজ্ঞতা গ্রহণের নিবিড়তা বেড়েছে। পর্যটকদের রাত্রিযাপনের গড় বাড়লে গন্তব্যের আয় বাড়ে। এই ক্ষেত্রে সমন্বিত কারিগরি ও মার্কেটিং পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। উল্লেখ্য যে, মালদ্বীপের ২০২১ সালে ভ্রমণকারীদের গড় রাত্রিযাপন ছিল ৯.৮ দিন। একে বাড়িয়ে ১০.৫ করার জন্য ওই দেশের সরকার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে।
ঘ. পরিপৃত্তি সূচক পর্যটক কর্তৃক রাত্রিযাপনের সংখ্যা ও স্থানীয়ভাবে বসবাসকারী জনগোষ্ঠীর মধ্যকার অনুপাতকে পর্যটকদের অবস্থানকালের সংখ্যা দিয়ে গুণ করলে একে পরিপৃত্তি সূচক বলে। এই সূচক নির্ণয়ের মাধ্যমে গন্তব্যের ধারণ ক্ষমতার সঙ্গে তুলনা করা হয়। পরিপৃত্তি সূচক ধারণ ক্ষমতার কাছাকাছি চলে গেলে পর্যটকদের আগমন নিয়ন্ত্রণ করতে হয়। অন্যথায় ওভারট্যুরিজম সংঘটিত হবে এবং তা গন্তব্যে বহুমাত্রিক নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। বিশেষত স্থানীয় মানুষের বসবাস ও জীবনযাপনের উপর ব্যাপক নেতিবাচক চাপ পড়ে। একই সঙ্গে গন্তব্যের পর্যটন সম্পদ রক্ষা করা কঠিন হয়ে পড়ে।
ঙ. ভ্রমণ প্রবণতা উৎস্থলের জনগোষ্ঠীর মধ্যে ভ্রমণের প্রবণতা সৃষ্টির জন্য নানা ধরনের প্রমোশনাল কার্যক্রম পরিচালনা করতে হয়। পর্যটক বৃদ্ধির জন্য একটি মৌলিক পদক্ষেপ। সম্ভাব্য উৎস্থলে অনুষ্ঠিত পর্যটন মেলায় অংশগ্রহণ, সিঙ্গেল কান্ট্রি ট্যুরিজম ফেয়ার অনুষ্ঠান, বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ট্যুর অপারেটর, রাজনৈতিক ও সরকারি প্রতিনিধি দলের গমন বিশেষ কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারে। গন্তব্যের পর্যটন অর্থনীতির কলেবর বৃদ্ধি করতে হলে গন্তব্য রাষ্ট্রকে উদ্বুদ্ধকরণে নানাবিধ কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে উৎস্থলে অবস্থিত দূতাবাসগুলো এই ক্ষেত্রে মূখ্য ভূমিকা পালন করতে পারে।
চ. ভ্রমণ সংখ্যা পর্যটক কর্তৃক সম্পাদিত ট্রিপের গড় বৃদ্ধির পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত। ভ্রমণের ট্রিপ সংখ্যা বাড়াতে হলে ভ্রমণ প্রবণতা সৃষ্টি করা একান্ত আবশ্যক। এই ক্ষেত্রে গন্তব্যস্থলের দূতাবাসগুলো উৎসস্থলের ট্যুর অপারেটরদের নিয়ে নিয়মিতভাবে সভা অনুষ্ঠান, দূতাবাসের নানা ধরনের জাতীয় অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানানো গেলে তা কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারে।
উপরের আলোচনা থেকে প্রতীয়মান হয় যে, পর্যটন অর্থনীতি সম্পূর্ণরূপে রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক আবরণে আবৃত। রাষ্ট্রের আইন ও নীতির মধ্য থেকেই রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠান দ্বারা পর্যটন কার্যক্রম পরিচালিত হয়। সঙ্গে সামাজিক প্রক্রিয়া, সাংস্কৃতিক প্রভাব ও মানুষের জীবনধারা পর্যটনের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক। আজ কোনো অর্থনীতিই কেবল অর্থনীতির তত্ত্ব ও মোড়কে বন্দি নয়। বরং সময়ের চাহিদা ও বহমানতার সঙ্গে বহুমাত্রিকতা দিয়ে সমৃদ্ধ হয়েছে। পর্যটন পৃথিবীতে সমকালীন বিকাশমান একটি উল্লেখযোগ্য কর্মযজ্ঞ। তাই পর্যটন অর্থনীতির প্রতি সব রাষ্ট্রেরই বিশেষ নজর দেওয়ার সময় এসেছে। মর্যাদা ও বিকাশের নিমিত্তে আমাদের মতো উন্নয়নশীল রাষ্ট্রকে উদীয়মান পর্যটন অর্থনীতির প্রতি সযত্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
মোখলেছুর রহমান: রেক্টর, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ট্যুরিজম স্টাডিজ, ঢাকা
এসএন