মাদকাসক্তদের নিয়ে গোপনীয়তা নয়, প্রয়োজন সুচিকিৎসা
বিভিন্ন ধরনের নেশাজাতীয় দ্রব্য গ্রহণ করার ফলে ব্যক্তির শারীরিক ও মানসিক পরিবর্তন ঘটে। নেশাগ্রস্ত ব্যক্তি কাঙ্ক্ষিত দ্রব্যের প্রতি ধীরে ধীরে বেশি মাত্রায় নির্ভরশীল হয়ে যায়; যা তার সামাজিক ও দৈনন্দিন কার্যাবলীতে ভীষণভাবে প্রভাব রাখে। এটিই হচ্ছে নেশাদ্রব্য অথবা মাদকদ্রব্য। বিভিন্ন প্রকার মাদক দ্রব্য হলো- মদ, সিগারেট, ফেনসিডিল, ইয়াবা, সিসা, গাঁজা, কোকেইন, হেরোইন, আফিম ইত্যাদি।
বিভিন্ন কারণে তরুণ প্রজন্ম এই ক্ষতিকর দ্রব্যগুলোর প্রতি ঝুঁকে পড়েছে। ধর্মীয় মূল্যবোধ, পরিবারিক বন্ধনের অভাব, সামাজিক বিছিন্নতা ইত্যাদি বিষয়গুলো নতুন প্রজন্মের মাদকাসক্তের জন্য দায়ী। এ ছাড়া, পশ্চিমা সংস্কৃতি অনুসরণ, আকাশ সংস্কৃতি, উচ্ছৃঙ্খল জীবনযাপন, হতাশা, যন্ত্রণা, কষ্ট, ব্যর্থতা, অবজ্ঞা, অসৎ সঙ্গও মাদকাসক্তের জন্য দায়ী।
প্রথমত কৌতূহল থেকে একটু ভালো লাগা, পরে আস্তে আস্তে এর মধ্যে তলিয়ে যাওয়া– ইত্যাদি হচ্ছে মাদক গ্রহণের পারিণাম। মাদকসেবী বন্ধুবান্ধবের প্ররোচনায়ই মাদক সেবনের প্রথম ধাপের সূচনা ঘটে। দেশে মাদকসেবীর ৮০ শতাংশ তরুণ-তরুণী; যাদের ৬০ শতাংশের বেশি বন্ধুবান্ধবের মাধ্যমে মাদকাসক্ত হয়ে পড়ছে। মাদকসেবীরা একজন নিরীহ বন্ধুকেও মাদকের সংস্পর্শে নিয়ে আসে। ইয়াবা, হেরোইন, ফেনসিডিল, গাঁজা, মদ, অন্যান্য নেশাদ্রব্য মাদকের কারণে বেড়ে যাচ্ছে সামজিক অবক্ষয়। তরুণ সমাজের নৈতিক মূল্যবোধ লোপ পাচ্ছে। ভেঙে পড়ছে পারিবারিক সদস্যদের মধ্যে আস্থা-বিশ্বাস, সমাজে তৈরি হচ্ছে আতঙ্ক। কাঁপন জাগছে সর্বস্তরের মানুষের মনে। ঘরে ঘরে মাদক কেড়ে নিচ্ছে তরুণের জীবন। মাদকের কারণে ভাই খুন করছে ভাইকে, বোনও নিরাপদ নয় মাদকাসক্ত ভাইয়ের কাছে। স্বামী খুন করছে স্ত্রীকে। ছেলে খুন করছে বাবাকে। মাও ভাড়াটিয়া খুনি দ্বারা খুন করছে তার সন্তানকে। মাদকাসক্তির কারণে বাড়ছে পারিবারিক সহিংসতা। বাড়ছে নারী নির্যাতনও বিবাহ বিচ্ছেদ। বাড়ছে আত্মহনন।
নতুন প্রজন্ম বা তরুণেরা কত বিপর্যয়ের মুখোমুখি তার নির্মম চিত্র সমাজের বিভিন্ন স্তরে। পরিবার ও সামাজিক জীবনের অস্তিত্বের শিকড় ধরে টান দেওয়ার মতো অঘটন সর্বত্র। ধ্বংসের দানব মাদক দেশের সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবেশ করছে। অভিজাত এলাকায় থেকে বস্তি সবখানেই মাদকের ছাড়াছড়ি। ইয়াবা-হেরোইন-প্যাথেড্রিন-গাজা নামক মাদকের ছোবলে আক্রান্ত নতুন প্রজন্ম। এটাতো ভেঙে দিচ্ছে আগামী তরুণদের জীবন। তাই আমাদের সবাইকে সচেতন হতে হবে।
আমাদের ছেলে মেয়েদের এই নেশাদ্রব্য থেকে দেশ, জাতি, সমাজ রক্ষা করতে এগিয়ে আসতে হবে। রাষ্ট্র, সমাজ মাদক মুক্ত হতে হলে নিজের ও পারিবারিক উদ্যোগ বিফল হলে মাদকাসক্ত চিকিৎসা বিশেষজ্ঞ, অভিজ্ঞ কোনো কাউন্সিলর, অভিজ্ঞ সাইকোলজিস্ট বা অভিজ্ঞ কোনো চিকিৎসকের সাহয্যে নিতে হবে। তাদের পেছনে লেগে থাকতে হবে। পরিস্থিতি গোপন করা চলবে না। ঘনিষ্ঠ স্বজনদের সঙ্গে খোলামেলা আলাপ করে সংকট উত্তরণের পথে এগোতে হবে।
সরকারসহ সব স্তরের মানুষকে এগিয়ে আসতে হবে আমাদের তরুণদের সাহায্য করতে। তারা যাতে ওই পথে না যেতে পারে। নেশার ভয়াবহতা সম্বন্ধে তাদের জানাতে হবে। নিজেও ছাড়তে হবে অপরকেও বোঝাতে হবে এবং পুনর্বাসন করতে হবে ভুক্তভোগীদের। বাবা মা, পরিবেশ, বন্ধু, শিক্ষক ও সামাজিক অসহযোগিতার কারণে অনেকেই বিষণ্ণতায় ভোগে। এতে করে নেশার কালো থাবার শিকার হচ্ছে আমার দেশের তরুণ-তরুণীরা। এই অবস্থা থেকে তাদের ফিরেয়ে আনতে হবে। তরুণদের সঙ্গে মিশতে হবে, তাদের বুঝতে হবে, সময় দিতে হবে।
আমরা সবাই মিলে একসঙ্গে উচ্চ কণ্ঠে উচ্চারণ করি মাদকদ্রব্য, নেশাকে না বলি। নেশা মুক্ত সমাজ, জাতি ও দেশ গড়ি। এটাই আমাদের সবার প্রত্যাশা ও কামনা।
ড. আনিসুজ্জামান: উপাচার্য, গ্লোবাল ইউনিভার্সিটি
এসএন