বেকার হোস্টেলে ‘বঙ্গবন্ধু স্মৃতিকক্ষ’
সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শিক্ষা ও রাজনৈতিক জীবনের প্রসঙ্গ এলেই কলকাতার ইসলামিয়া কলেজের বেকার হোস্টেলের কথা উচ্চারিত হবেই, কারণ এখান থেকেই বঙ্গবন্ধু তার রাজনৈতিক ধ্যান-ধারণা ও আদর্শবাদী রাজনীতি চর্চার মধ্য দিয়ে ভবিষ্যতের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করেছেন।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কলকাতার যে কলেজে পড়াশোনা করেছিলেন সেই কলেজের নাম ইসলামিয়া কলেজ। কলেজটির বর্তমান নাম মৌলানা আজাদ কলেজ।
কলেজটিতে ১৯৪২ সালে ইন্টারমিডিয়েটে ভর্তি হন বঙ্গবন্ধু। কলেজের স্মিথ স্ট্রিটের বেকার হোস্টেলের ২৪ নম্বর কক্ষের আবাসিক ছাত্র ছিলেন শেখ মুজিব। পরবর্তী সময়ে বঙ্গবন্ধু ১৯৪৬ সালে ইসলামিয়া কলেজ ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক (জিএস) নির্বাচিত হন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ইসলামিয়া কলেজ থেকে ১৯৪৭ সালে বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও ইতিহাসে ব্যাচেলর ডিগ্রি অর্জন করেন।
১৯৯৮ সালে বেকার হোস্টেলের ২৩ ও ২৪ নম্বর কক্ষকে একত্রিত করে পশ্চিমবঙ্গ সরকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সম্মানে ‘বঙ্গবন্ধু স্মৃতিকক্ষ’ তৈরি করে। ২০১১ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি এ কক্ষের সম্মুখে তার আবক্ষ মূর্তির ফলক উম্মোচন করেন বাংলাদেশ সরকারের তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও বর্তমান শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি এমপি। ২০১৯ সালের ৩ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর আবক্ষ ভাস্কর্যটি প্রতিস্থাপন করেন বাংলাদেশ সরকারের স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম এমপি।
বেকার হোস্টেলে যাওয়ার স্বপ্ন দীর্ঘদিনের, দেশে পত্র-পত্রিকায় জেনেছি বেকার হোস্টেলে বঙ্গবন্ধু স্মৃতি কক্ষ স্থাপিত হয়েছে। বেশ কয়েকবার ভারত যাত্রা করলেও বেকার হোস্টেলে যাওয়া হয়নি। এবার দেশ থেকে ভারতে রওনা হবার আগেই মনস্থির করেছিলাম যে, বেকার হোস্টেলে যাবই এবং বঙ্গবন্ধু স্মৃতিকক্ষ দেখবো। কলকাতায় এলে সাধারণত পার্কস্ট্রিট এলাকায় বেশি থাকা হয়। এবারও সেই এলাকাতেই হোটেলে উঠি।
গত ৩ জুন ২০২২ সকালেই সহকর্মী ড. রফিকুল ইসলামকে নিয়ে বেড়িয়ে পড়ি বেকার হোস্টেলের উদ্দেশে। লোকজনকে ইসলামিয়া কলেজের কথা জিজ্ঞেস করলে প্রথমে খুব একটা বুঝতে পারে না, পরে একজন বলল ইসলামিয়া কলেজের বর্তমান নাম মৌলানা আজাদ কলেজ যা পার্কস্ট্রিট এলাকাতেই অবস্থিত। বুঝলাম এখন মানুষ ইসলামিয়া কলেজের কথা অনেকটা ভুলে গেছে, নাম পরিবর্তনের কারণে তা এখন মৌলানা আজাদ কলেজ নামেই বেশি পরিচিত। যে হোটেলে উঠেছিলাম সেখান থেকে মৌলানা আজাদ কলেজ পায়ে হেঁটে যাওয়া যাবে। প্রায় দেড় কিলোমিটার হেঁটে প্রথমে মৌলানা আজাদ কলেজ গেলাম। সেখানে শুনলাম পার্কস্ট্রিট এলাকায় স্মিথ স্ট্রিটে বেকার হোস্টেল অবস্থিত। লোকজনকে জিজ্ঞেস করতেই দেখা গেল, সকলেই বেকার হোস্টেল চেনেন এবং সেখানে যে বঙ্গবন্ধু থাকতেন তা অনেকেই জানেন।
প্রচণ্ড গরমে ঘর্মাক্ত হয়ে যখন বেকার হোস্টেলে পৌঁছালাম তখন বেলা বারোটা। কলেজের একজন কর্মচারী বললেন বাংলাদেশ-কলকাতা দূতাবাসের অনুমতি ছাড়া বঙ্গবন্ধু স্মৃতিকক্ষ খোলা যাবে না। হোস্টেলের ওয়ার্ডে তাকেও পাওয়া গেল না, ফোন নম্বর সংগ্রহ করে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেও পাওয়া গেল না। অনকেটা হতাশ হয়েইে শুধু বেকার হোস্টেল দেখে হোটেলে ফিরে আসতে হলো। হোটেলে ফিরে আবার ওয়ার্ডেন মহোদয়কে ফোন দিলে তিনি ফোন ধরেন এবং তার কাছে বঙ্গবন্ধু স্মৃতিকক্ষ দেখার অনুমতি চাইলে প্রথমে বাংলাদেশ-কলকাতা দূতাবাসের অনুমতির কথা বলেন। পরে আমার পরিচয় দিয়ে সময় স্বল্পতার কথা বুঝিয়ে বললে তিনি অনুমতি দেন। অনুমতি পাওয়ার পর বিকাল ৪টায় আবার বেকার হোস্টেলে সহকর্মী ড. রফিকুল ইসলামকে নিয়ে পৌঁছালাম। সেই প্রাচীন সিঁড়ি বেয়ে হোস্টেলের তিন তলায় অবশেষে বঙ্গবন্ধু স্মৃতিকক্ষ পৌঁছালাম, একজন কর্মচারী খুলে দিলেন স্মৃতিকক্ষের তালা। তালা যখন খোলা হলো আবেগে থরথর করে কাঁপছিলাম, স্মৃতিকক্ষে ঢোকা যেন এক দীর্ঘদিনের স্বপ্ন পূরণের অনাবিল আনন্দ।
বঙ্গবন্ধুর স্মৃতি বিজড়িত বেকার হোস্টেলের ‘বঙ্গবন্ধু স্মৃতিকক্ষ’তে গিয়ে অনেকটা আবেগ তাড়িত হয়ে পড়ি, মনে পড়ে যায় বঙ্গবন্ধুর লেখা অসমাপ্ত আত্মজীবনীর কথা, মনে পড়ে যায় এই হোস্টেল থেকেই কতো কষ্ট ও ত্যাগ স্বীকার করে তিনি সততার সঙ্গে কলকাতায় ছাত্র রাজনীতি করেছেন, বাঙালি জাতির অধিকার আদায়ের কথা ভেবেছেন। ইতিহাসের পাতা উল্টালেই উপলব্ধি করা যায় নানা আন্দোলন-কর্মসূচির মধ্য দিয়ে হোস্টেলে বঙ্গবন্ধুর এই কক্ষটি কীভাবে বাঙালি ছাত্র-ছাত্রীদের প্রাণকেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু স্মৃতিকক্ষে তিনি যে চৌকিতে ঘুমাতেন, যে চেয়ারে বসে, যে টেবিলে পড়তেন তা অবিকল সেভাবে সংরক্ষিত রয়েছে। এগুলো স্পর্শ করলে বঙ্গবন্ধুর ঘ্রাণ পাওয়া যায়, এখানে দাঁড়িয়ে থেকে হৃদয়ের চোখ দিয়ে বঙ্গবন্ধুকে দেখা যায়, যতক্ষণ বঙ্গবন্ধু স্মৃতিকক্ষে ছিলাম যেন প্রতিটি মুহূর্ত বঙ্গবন্ধুর হৃদ স্পন্দন অনুভব করেছি। বঙ্গবন্ধু যে চৌকিতে শুয়ে খোলা জানালা দিয়ে নীল শুভ্র আকাশ দেখতে দেখতে হৃদয়ের মণিকোঠায় নীল শুভ্রতায় শান্তির পতাকা এঁকেছেন, আকাশের মত হৃদয়টাকে প্রসারিত করেছেন, এখনো সেই বন্ধ জানালা দিয়ে মনের চোখ দিয়ে দেখা যায় নীল শুভ্র আকাশ আর মেঘের ছুটোছুটি। মনে হয় সেই নীল শুভ্র আকাশ থেকে শেখ মুজিব দেখছেন অবলীলায় তার প্রিয় বেকার হোস্টেলকে।
কলকাতার ইসলামিয়া কলেজের (বর্তমানে মওলানা আজাদ কলেজ) বেকার গভর্নমেন্ট হোস্টেলে দীর্ঘ সময় কাটিয়েছেন বঙ্গবন্ধু। নেতা বঙ্গবন্ধুর উত্থান ওই কলেজ এবং হোস্টেল থেকেই। তাই বেকার হোস্টেল নামটির সঙ্গে জড়িয়ে আছে বাঙালির আবেগ আর অনুভূতি, বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা, বাঙালি জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের শিক্ষা ও রাজনৈতিক জীবন আলোচিত হলে অনায়াসেই বেকার হোস্টেলের নামটিও বাঙালি কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করে। বাংলাদেশ সরকারের কাছে অনুরোধ বেকার হোস্টেলে স্থাপিত বঙ্গবন্ধু স্মৃতি কক্ষ বাংলাদেশ থেকে আগত নাগরিকসহ ভারত ও অন্যান্য দেশের নাগরিকরা যেন সহজেই দেখতে পারেন তার একটা পাকাপোক্ত ব্যবস্থা করা।
মো. হাসিবুল আলম প্রধান: সভাপতি ও অধ্যাপক, আইন বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
আরএ/