বেগম রোকেয়া ছিলেন একজন ইসলামি চিন্তাবিদ
আজকের যুগে অবস্থান করে বেগম রোকেয়ার অবদানকে উপলব্ধি করতে হলে এখন থেকে একশ বছরেরও বেশি সময় আগের সমাজব্যবস্থায় নারীর অবস্থান কোথায় ছিল— তা ভালো করে বুঝতে হবে।
বেগম রোকেয়ার জন্ম হয় এমন এক সময় যখন গোটা ভারতীয় উপমহাদেশ ছিল নানা প্রকার কুসংস্কারে আচ্ছন্ন। আর এ সব কুসংস্কারের বিরাট অংশ ছিল নারী সমাজকে ঘিরে। নারী শিক্ষা, নারীদের ঘর থেকে প্রয়োজনে বের হওয়া ও সমাজের নানা কর্মকাণ্ডে নারীদের অংশগ্রহণ ইত্যাদিকে পাপ মনে করা হতো। অথচ ইসলাম নারী-পুরুষ সবার জন্যে জ্ঞানার্জনকে অত্যাবশ্যকীয় করেছে এবং শালিনতা বজায় রেখে প্রয়োজনে সামাজিক ও পেশাগত কর্মকাণ্ডে নারীর অংশগ্রহণকে সম্পূর্ণ অনুমোদন করেছে। মূলত সামাজিক কুসংস্কার ও ইসলামি শিক্ষার সার্বিক অনুপস্থিতির কারণেই সমাজে নারীকে ঘিরে এতসব বাড়াবাড়ি ও ভুল বুঝাবুঝি ছিল যা আজকের সমাজেও স্বল্প বিস্তার পরিলক্ষিত হয়। বেগম রোকেয়া ছিলেন এ সব কুসংস্কার ও বাড়াবাড়ির বিরুদ্ধে সদা সোচ্চার। তিনি তার লেখায়, বক্তৃতায় ও কর্মকাণ্ডে এ সব কুসংস্কার দূর করার জন্য আজীবন সংগ্রাম করে গেছেন।
আমাদের সমাজে বেগম রোকেয়াকে নিয়ে দু’ধরনের ভুল বুঝাবুঝি বিদ্যমান। প্রথমত, যারা ইসলাম ও ইসলামি পুনর্জাগরণকে সহ্য করতে পারেন না তারা রোকেয়াকে ইসলাম ও ইসলামি হিজাবের বিরুদ্ধে একটি প্রতীক হিসেবে দাঁড় করাতে চান। তারা ভুলে যান যে, বেগম রোকেয়ার আন্দোলন ইসলামের বিরুদ্ধে ছিল না। বরং তিনি মূলত সারাজীবন ইসলামের পক্ষে কাজ করে গেছেন এবং ইসলামকে ঘিরে যেসব কুসংস্কার ও বাড়াবাড়ি বিদ্যমান ছিল এগুলো দূর করার চেষ্টা করেছেন। তিনি ভালো করেই জানতেন যে, ইসলাম নারীর স্বাধীন সত্তাকে স্বীকার করে এবং ইসলাম নারী-পুরুষের মাঝে সহমর্মিতা ও সহযোগিতার সম্পর্ক সৃষ্টি করেছে। কিন্তু আমাদের সমাজে তা সঠিকভাবে প্রতিফলিত হচ্ছে না। তাই সমাজে ইসলাম প্রদত্ত নারীর অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠাই ছিল বেগম রোকেয়ার মূল লক্ষ্য এবং এ সত্যটি তার লিখায় বারবার প্রতিভাত হয়েছে। সেদিক থেকে বিচার করলে বেগম রোকেয়াকে একজন সমাজ সংস্কারক বলা যায়।
বেগম রোকেয়াকে নিয়ে দ্বিতীয় ভুল বুঝাবুঝিটি লক্ষ্য করা যায় ইসলামপন্থীদের মধ্যে। এর কারণ হলো বেগম রোকেয়াকে ঘিরে ব্যাপক অপপ্রচার। তাকে অনেক সময় নারীবাদী রমনী হিসেবে চিহিৃত করা হয় এবং তার লেখাকে ইসলাম বিদ্বেষী প্রচার করা হয়। অপপ্রচারে বিভ্রান্ত হয়ে অনেক ইসলামপন্থী ভাবেন যে, রোকেয়া ইসলামি আদর্শ ও শালীনতার বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন— যা একেবারেই অসত্য। তারা ভুলে যান যে, বেগম রোকেয়া ছিলেন ইসলামের ইতিহাসের বিখ্যাত সম্মানিতা মহিলাদের অন্যতম। তিনি সারাজীবন নিজে শালীনতা বজায় রেখে চলাফেরা করেছেন, শালীনতার পক্ষে বলিষ্ঠ কণ্ঠে কথা বলেছেন। পর্দা বা শালীনতায় থেকে যেকোনো শালীন কাজ করা অন্যায় নয় বরং প্রয়োজনে নির্দ্বিধায় তা করা উচিত।
মতিচূর প্রথম খণ্ডে বোরকা প্রবন্ধে তিনি বলেন, ‘আমরা অন্যায় পর্দা ছেড়ে আবশ্যকীয় পর্দা রাখব। প্রয়োজন হলে অবগুণ্ঠন (ওরফে বোরকা) সহমাঠে বেড়াতে আমাদের আপত্তি নেই। স্বাস্থ্যের উন্নতির জন্য শৈলবিহারে বাহির হইলেও বোরকা সঙ্গে থাকিতে পারে। বোরকা পরিয়া চলাফেরায় কোনো অসুবিধা হয় না। তবে সে জন্য সামান্য রকমের একটু অভ্যাস চাই, বিনা অভ্যাসে কোন কাজটা হয়?’
লজ্জা নারীর ভূষণ। লজ্জাকে বিসর্জন দিলে নারীর নারীত্ব লাঞ্চিত হয়। উন্নতির নামে নারী তার সহজাত বৈশিষ্ট্য লজ্জাকে বিসর্জন দেবে এটা মানব সভ্যতার জন্য কখনোই কাম্য হতে পারে না। উন্নতি সকলেই চায়। উন্নতি লেখিকারও কাম্য নিঃসন্দেহে। কিন্তু উন্নতির নামে সুরুচি ও শালীনতা বিসর্জন লেখিকার কাম্য নয়। বেগম রোকেয়া পর্দা অর্থে সুরুচিতে শালীনতাকে বুঝিয়েছেন। সমাজের সার্বিক কল্যাণের স্বার্থে তিনি অবরোধ প্রথার উচ্ছেদ চেয়েছেন। বহু প্রবন্ধে তিনি বলেছেন পর্দা ও অবরোধ প্রথা এক জিনিস নয়। অতি আধুনিকতার নামে নগ্নতা, উচ্ছৃঙ্খলতা, শালীনতা বর্জন ও বেলেল্লাপনাকে তাই তিনি মোটেও সমর্থন করতে পারেননি।
রোকেয়া রচনাবলীর সম্পাদক আব্দুল কাদির সঙ্গত কারণেই বলেছেন, ‘রোকেয়া অবরোধ প্রথার উচ্ছেদ চেয়েছিলেন; কিন্তু নারী পর্দা অর্থাৎ সুরুচি ও শালীনতা বিসর্জন দেবে, এটা তিনি কোনোদিনও কাম্য মনে করেননি। অতি আধুনিক রীতির বেলেল্লাপনা তার কাছে কীরূপ শ্লেষের বিষয় ছিল, তার উন্নতির পথে শীর্ষক রম্যরচনাটিতে ও তার অভিব্যক্তি ইঙ্গিতবহ ও তাৎপর্যময়।
বেগম রোকেয়া সারা জীবন নিজে শালীনতা বজায় রেখে চলাফেরা করেছেন, শালীনতার পক্ষে বলিষ্ঠ কণ্ঠে কথা বলেছেন। সর্বোপরি তিনি ছিলেন ইসলামি আদর্শে গভীরভাবে অনুরাগী এক মহীয়সী রমণী।
মুসলমান নারীর পশ্চাদপদতা তার শিল্প মানসকে প্রবলভাবে আলোচিত করেছিল। তার সার্বক্ষণিক চিন্তা ও চেষ্টা ছিল নারীমুক্তি সাধন এ জন্যে তিনি প্রবন্ধকে তার লেখনীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ মাধ্যম হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন। তাই যে কেউ পূর্ণ মনোযোগ দিয়ে তার সমগ্র রচনাবলী পাঠ করলে তারা খুঁজে পাবে একটি ধার্মিক মমতাময়ী নারী হৃদয়কে। আর তার রচনার কোনো খণ্ড বা অংশকে পূর্বাপর প্রসঙ্গ ব্যতিরেকে উদ্ধৃত করলে তার সম্পর্কে এরূপ বিভ্রান্তি আসা অস্বাভাবিক নয়।
বেগম রোকেয়া ছিলেন নারী-শিক্ষার অগ্রদূত। তবে তৎকালীন মুসলিম সমাজে নারী- শিক্ষার পক্ষে কথা বলা ছিল রীতিমতো ভয়াবহ ব্যাপার। তবুও তিনি নারী শিক্ষার জন্য আজীবন সংগ্রাম করে গেছেন ‘তার বঙ্গীয় নারী-শিক্ষা সমিতি’র প্রবন্ধে সভানেত্রীর অভিভাষণে তিনি বলেন, ‘স্ত্রী-শিক্ষার কথা বলিতে গেলেই আমাদের সামাজিক অবস্থার আলোচনা অনিবার্য হইয়া পড়ে। আর সামাজিক অবস্থার কথা বলিতে গেলে, নারীর প্রতি মুসলমান ভ্রাতৃবৃন্দের অবহেলা, ঔদাস্য এবং অনুদার ব্যবহারের প্রতি কটাক্ষপাত অনিবার্য হয়। প্রবাদ আছে—বলিতে আপন দুঃখ পরনিন্দা হয়। এখন প্রশ্ন এই যে মুসলমান বালিকাদের সুশিক্ষার উপায় কি? উপায় তা আল্লাহর কৃপায় অনেকই আছে, কিন্তু অভাগিনীগণ তাহার ফলভোগ করিতে পায় কই?’
‘যাহারা ইতিহাস পাঠ করিয়াছেন, তাহারা জানেন যে, মূর্খতার অন্ধকার যুগে আরবগণ কন্যা বধ করিত। যদিও ইসলাম ধর্ম কন্যাদের শারীরিক হত্যা নিবারণ করিয়াছি, তথাপি মুসলিমগণ অম্লান বদনে কন্যাদের মন, মস্তিস্ক এবং বুদ্ধিবৃত্তি অদ্যাপি অবাধে বধ করিতেছেন। কন্যাকে মূর্খ রাখা এবং চতুষ্প্রাচীরের অভ্যন্তরে আবদ্ধ রাখিয়া জ্ঞান ও বিবেক হইতে বঞ্চিত রাখা অনেকে কৌলিন্যের লক্ষণ মনে করেন। কিছুকাল পর্যন্ত মিসর এবং তুরস্ক স্ত্রী শিক্ষার বিরোধী ছিলেন। কিন্তু তাহারা ঠকিয়া নিজেদের ভ্রম বুঝিতে পারিয়া এখন সুপথে আসিয়াছেন।’
‘সম্প্রতি তুরস্ক এবং মিসর, ইউরোপ ও আমেরিকার ন্যায় পুত্র ও কন্যাকে সমভাবে শিক্ষা দিবার জন্য বাধ্যতামূলক আইন করিয়াছেন। কিন্তু তুরস্ক আমেরিকার পদাঙ্ক অনুসরণে সোজা পথ অবলম্বন করেন নাই; বরং আমাদের ধর্ম শাস্ত্রের একটি অলঙ্ঘনীয় আদেশ পালন করিয়াছেন। যেহেতু পৃথিবীতে যিনি সর্ব প্রথমে পুরুষ স্ত্রীলোককে সমভাবে সুশিক্ষা দান করা কর্তব্য বলিয়া নির্দেশ করিয়াছেন, তিনি আমাদের রসুল মকবুল (অর্থাৎ পয়গাম্বর সাহেব)। তিনি আদেশ করিয়াছেন যে, শিক্ষালাভ করা সমস্ত নরনারীর অবশ্যকর্তব্য। তের শত বৎসর পূর্বেই আমাদের জন্য এই শিক্ষা দানের বাধ্যতামূলক আইন পাশ হইয়া গিয়াছে। কিন্তু আমাদের সমাজ তাহা পালন করে নাই, বরং ওই আদেশের বিরুদ্ধাচরণ করিয়াছে এবং তদ্রুপ বিরুদ্ধাচরণকেই বংশ গৌরব মনে করিতেছে। এখনো আমার সম্মুখে আমাদের স্কুলের কয়েকটি ছাত্রীর অভিভাবকের পত্র মজুদ আছে—যাহাতে তাহারা লিখিয়াছেন যে, তাহাদের মেয়েদের যেন সামান্য উর্দু ও কোরান শরীফ পাঠ ছাড়া আর কিছু— বিশেষতঃ ইংরাজী শিক্ষা দেওয়া না হয়। এই তো আমাদের সামাজিক ব্যবস্থা।’
‘ভারতবর্ষে যখন স্ত্রীশিক্ষার বাধ্যতামূলক আইন পাশ হইবে, তখন দেখা যাইবে। কিন্তু প্রশ্ন এই যে, মুসলমান-যাহারা স্বীয় পয়গাম্বরের নামে (কিংবা ভগ্ন মসজিদের একখণ্ড ইষ্টকের অবমাননায়) প্রাণ দানে প্রস্তুত হন, তাহারা পয়গাম্বরের সত্য আদেশ পালনে বিমুখ কেন? গত অন্ধকার যুগে যাহা হইবার হইয়া গিয়াছে, তাহারা যে ভ্রম করিয়াছেন, তাহাও ক্ষমা করা যাইতে পারে; কিন্তু এই বিংশ শতাব্দীতে যখন বারংবার স্ত্রী-শিক্ষার দিকে তাহাদের মনোযোগ আকর্ষণ করা যাইতেছে যে, কন্যাকে শিক্ষা দেওয়া আমাদের প্রিয় নবী ‘ফরয’ ( অবশ্য পালনীয় কর্তব্য) বলিয়াছেন, তবু কেন তাহারা কন্যার শিক্ষায় উদাসীন?’
ইসলামে নির্দেশ থাকা সত্ত্বেও মুসলিম নারীদের শিক্ষা থেকে বঞ্চিত করা হয়। তাই বেগম রোকেয়া বলেন ‘স্ত্রীশিক্ষার বিরোধীরা বলে যে, শিক্ষা পাইলে স্ত্রীলোকেরা অশিষ্ট ও অনম্যা হয়। ধিক! ইহারা নিজেকে মুসলমান বলেন, অথচ ইসলামের মূল সূত্রের এমন বিরুদ্ধাচরণ করেন। যদি শিক্ষা পাইয়া পুরুষগণ বিপথগামী না হয়, তবে স্ত্রীলোকেরা কেন বিপথগামিনী হইবে? এমন জাতি, যাহারা নিজেদের অর্ধেক লোককে মূর্খতা ও ‘পর্দা’ রূপ কারাগারে আবদ্ধ রাখে, তাহারা অন্যান্য জাতির-যাহারা সমানে সমানে স্ত্রীশিক্ষার প্রচলন করিয়াছে, তাহাদের সহিত জীবন-সংগ্রামে কীরূপ প্রতিযোগিতা করিবে?’
এই কারণে নারী শিক্ষার প্রয়োজন সম্পর্কে বেগম রোকেয়া তার সুবহে সাদেক প্রবন্ধে বলেন, ‘আমার অভাগিনী ভগিনীগণ! আপনারা কি ইহাতে অপমান বোধ করেন না? যদি করেন, তবে এই নির্মম অবমাননা নীরবে হজম করেন কেন?
'ভগিনীগণ! চক্ষু রগড়াইয়া জাগিয়া উঠুন- অগ্রসর হউন! বুক ঠুকিয়া বল মা! আমরা পশু নই; বল ভগিনী! আমরা আসবাব নই; বল কন্যে! আমরা জড়াউ অলঙ্কার-রূপে লোহার সিন্দুকে আবদ্ধ থাকিবার ব্যবস্থা নেই; সকলে সমস্বরে বল, আমরা মানুষ! আর কার্যতঃ দেখাও যে, আমরা সৃষ্টি জগতের শ্রেষ্ঠ অংশের অর্ধেক। বাস্তবিক পক্ষে আমরাই সৃষ্টি জগতের মাতা। তোমরা নিজের দাবি-দাওয়া রক্ষা করিবার জন্য নিজেরাই বিবিধ সমিতি গঠন কর। শিক্ষা বিস্তারই এইসব অত্যাচার নির্বারণের একমাত্র মহোষধ। অন্ততঃ পক্ষে বালিকাদিগকে প্রাথমিক শিক্ষা দিতেই হইবে। শিক্ষা অর্থে আমি প্রকৃত সুশিক্ষার কথাই বলি; গোটা কত পুস্তক পাঠ করিতে বা দু’ছত্র কবিতা লিখিতে পারা শিক্ষা নয়। আমি চাই সেই শিক্ষা-যাহা তাহাদিগকে নাগরিক অধিকার লাভে সক্ষম করিবে, তাহাদিগকে আদর্শ কন্যা, আদর্শ ভগিনী, আদর্শ গৃহিনী এবং আদর্শ মাতা রূপে গঠিত করিবে! শিক্ষা মানসিক এবং শারীরিক উভয়বিধ হওয়া চাই। তাহাদের জানা উচিত যে, তাহারা ইহজগতে কেবল সুদৃশ্য শাড়ি, ক্লিপ ও বহুমূল্য রত্নালস্কার পরিয়া পুতুল সাজিবার জন্য আইসে নাই; বরং তাহারা বিশেষ কর্তব্য সাধনের নিমিত্ত নারীরূপে জন্মলাভ করিয়াছে। তাহাদের জীবন শুধু পতি-দেবতার মনোরঞ্জনের নিমিত্ত উৎসর্গ হইবার ব্যবস্থা নহে। তাহারা যেন অন্নবস্ত্রের জন্য কাহারও গলগ্রহ না হয়।’
শিক্ষার উপর গুরুত্বারোপ করে মতিচূর প্রথম খণ্ডে ‘স্ত্রী জাতির অবনতি’ প্রবন্ধে তিনি বলেন, ‘যাহা হউক শিক্ষার অর্থ কোনো সম্প্রদায় বা জাতি বিশেষের অন্ধ অনুকরণ নহে। ঈশ্বর যে স্বাভাবিক জ্ঞান বা ক্ষমতা দিয়াছেন, সেই ক্ষমতাকে অনুশীলন দ্বারা বৃদ্ধি করাই শিক্ষা। ওই গুণের সদ্ব্যবহার করা কর্তব্য এবং অপব্যবহার করা দোষ।.... যেখানে অশিক্ষিত চক্ষু ধূলি, কর্দম ব্যতীত আর কিছুই দেখিতে পায় না, সেখানে (বিজ্ঞানের) শিক্ষিত চক্ষু অনেক মনোরম চমৎকার বস্তু দেখিতে পায়। আমাদের পদদলিত যে কাদাকে আমরা কেবল মাটি, বালি, কয়লার কালি ও জলমিশ্রিত পদার্থ বলিয়া তুচ্ছ জ্ঞান করি, বিজ্ঞানবিদ তাই বিশ্লিষ্ট করিলে নিম্নলিখিত বস্তু চতুষ্টায় প্রাপ্ত হইবেন। যথা........ বালুকা বিশ্লেষণ করিলে সাদা পাথর বিশেষ (Opal); কর্দম পৃথক করিলে চিনে বামন প্রস্তুত করোনপযোগী মৃত্তিকা, অথবা নীলকান্তমনি; পাথর কয়লার কালি দ্বারা হীরক এবং জল দ্বারা একবিন্দু নীহার দেখিলেন ভাগিনি! যেখানে অশিক্ষিত চক্ষু কর্দম দেখে, সেখানে শিক্ষিত চক্ষু হীরা মানিক দেখে! আমরা যে এহেন চক্ষুকে চির অন্ধ করিয়া রাখি, এ জন্য খোদার নিকট কি উত্তর দিব?’
বেগম রোকেয়ার মতে নৈতিক ও সামাজিক অধঃপতন থেকে মানবমণ্ডলীকে রক্ষার জন্য ধর্ম শিক্ষা অপরিহার্য। সাধারণ শিক্ষার পাঠ্যতালিকায় ধর্মীয় শিক্ষাকেও অঙ্গীভূত করতে হবে বলে বেগম রোকেয়া দৃঢ় অভিমত পোষণ করতেন। তাই ‘বঙ্গীয় নারী-শিক্ষা সমিতি’ প্রবন্ধে তিনি বলেন, ‘মুসলমান বালিকাদের প্রাথমিক শিক্ষার সঙ্গে কোরান শিক্ষাদান করা সর্বাপেক্ষা অধিক প্রয়োজন! কোরান শিক্ষা অর্থে শুধু টিয়া পাখির মত আরবি শব্দ আবৃত্তি করা আমার উদ্দেশ্য নহে। বিভিন্ন প্রাদেশিক ভাষায় কোরানের অনুবাদ শিক্ষা দিতে হইবে। সম্ভবতঃ এজন্য গর্ভমেন্ট বাধ্যতামূলক আইন পাশ না করিলে আমাদের সমাজ মেয়েদের কোরান শিক্ষাও দিবে না! যদি কেহ ডাক্তার ডাকিয়া ব্যবস্থাপত্র লয়, কিন্তু তাহাতে লিখিত ওষুধ পথ্য ব্যবহার না করিয়া সে ব্যবস্থা-পত্রখানাকে মাদুলী রূপে গলায় পরিয়া থাকে, আর দৈনিক তিনবার করিয়া পাঠ করে, তাহাতে কি সে উপকার পাইবে? আমরা পবিত্র কোরান শরীফের লিখিত ব্যবস্থা অনুযায়ী কোনো কার্যকরি না, শুধু তাহা পাখির মত পাঠ করি আর কাপড়ের থলিতে (জুযদানে) পুরিয়া অতি যন্ত্রে উচ্চ স্থানে রাখি। কিছুদিন হইল, মিসর হইতে আগতা বিদুষী মহিলা মিস্ যাকিয়া সুলেমান এলাহাবাদে এক বিরাট মুসলিম সভায় বক্তৃতাদান কালে বলিয়াছিলেন, ‘উপস্থিত যে যে ভদ্রলোক কুরানের অর্থ বুঝেন, তাহারা হাত তুলুন। তাহাতে মাত্র তিন জন ভদ্রলোক হাত তুলিয়াছিলেন। কোরান-জ্ঞানে যখন পুরুষদের এইরূপ দৈন্য, তখন আমাদের দৈন্য যে কত ভীষণ, তাহা না বলাই ভাল। সুতরাং কোরানের বিধিব্যবস্থা কিছুই আমরা অবগত নহি। যাহা হউক, তথাপি উর্দূ এবং বাঙ্গালা উভয় অনুবাদই শিক্ষা দিতে হইবে। আমার অমুসলমান ভগিনীগণ! আপনারা কেহ মনে করিবেন না যে, প্রাথমিক শিক্ষার সঙ্গে সঙ্গে কোরান শিক্ষা দিতে বলিয়া আমি গেঁড়ামীর পরিচয় দিলাম। তাহা নহে আমি গোঁড়ামী হইতে বহুদূরে । প্রকৃত কথা এই যে, প্রাথমিক শিক্ষা বলিতে যাহা কিছু শিক্ষা দেওয়া হয়, সে সমস্ত ব্যবস্থাই কোরানে পাওয়া যায়। আমাদের ধর্ম ও সমাজ অক্ষুণ্ন রাখিবার জন্য কোরান শিক্ষা একান্ত প্রয়োজন।’
অপরদিকে, ‘ধ্বংসের পথে বঙ্গীয় মুসলিম’ প্রবন্ধে বেগম রোকেয়া বলেন ‘এই বিংশ শতাব্দীতে যৎকালে অন্যান্য জাতি নিজেদের প্রাচীন প্রথাকে নানা রকমে সংস্কৃত, সংশোধিত ও সুমার্জিত করে আঁকড়ে ধরে আছেন; আমাদেরই উত্তরাধিকার, ‘তালাক’ ‘খোলা’ প্রভৃতি সামাজিক প্রথা নিজেদের মধ্যে সংযোগ করে ‘পিতার সম্পত্তিতে কন্যার উত্তরাধিকার বিল,’ ‘পত্মী-ত্যাগ বিল’ ইত্যাদি নানা রকমের বিল পাশ করিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছেন, তৎকালে আমরা নিজেদের অতি সুন্দর ধর্ম, অতি সুন্দর সামাজিক আচার-প্রথা বিসর্জন দিয়ে এক অদ্ভুত জানোয়ার সাজতে বসেছি। সুরেন্দ্র সলিমুল্লা, স্যামুয়েল খাঁ গোছের নাম শুনতে কেমন লাগবে?
ফল কথা, উপরোক্ত দুরবস্থার একমাত্র ওষুধ- একটি আদর্শ মোসলেম বালিকা বিদ্যালয়, যেখানে আমাদের মেয়েরা আধুনিক জগতের অন্যান্য সম্প্রদায় এবং প্রদেশের লোকের সঙ্গে তাল রেখে চলবার মত উচ্চশিক্ষা লাভ করতে পারে। অন্যান্য সুসভ্য সম্প্রদায়ের এবং এই ভারতবর্ষেই অন্যান্য প্রদেশের মুসলমান মেয়েরা ডাক্তার,ব্যারিস্টার, কাউন্সিলার এবং গোল-টেবিল বৈঠকের সদস্য হচ্ছেন; আমাদের মেয়েরা কোন পাপে ওই সব সমৃদ্ধি থেকে বঞ্চিত থাকবে? আদর্শ মোসলেম বালিকা বিদ্যালয়ে আদর্শ মোসলেম নারী গঠিত হবে, যাদের সন্তান-সন্ততি হবে হজরত ওমর ফারুক, হজরত ফাতেমা জোহরার মত। এর জন্য কোরআন শরীফ শিক্ষার বহুল বিস্তার দরকার। কোরআন শরীফ, অর্থাৎ তার উর্দু এবং বাংলা অনুবাদের বহুল প্রচার একান্ত আবশ্যক।
ছেলে-বেলায় আমি মার মুখে শুনতুম, ‘কোরআন শরীফ ঢাল হয়ে আমাদের রক্ষা করবে।’ সে কথা অতি সত্য। অবশ্য তার মানে এ নয় যে, খুব বড় আকারের সুন্দর জেলদ বাঁধা কোরআন খানা আমার পিঠে ঢালের মত করে বেঁধে নিতে হবে। বরং আমার ক্ষুদ্র বুদ্ধিতে আমি এই বুঝি যে, কোরআন শরীফের সার্বজনীন শিক্ষা আমাদের নানাপ্রকার কুসংস্কারের বিপদ থেকে রক্ষা করবে। কোরআন শরীফের বিধান অনুযায়ী ধর্ম-কর্ম আমাদের নৈতিক ও সামাজিক অধঃপতন থেকে রক্ষা করবে।’
সব শেষে বলতে চাই সর্বোপরি বেগম রোকেয়া ছিলেন ইসলামি আদর্শে নারী শিক্ষার অগ্রদূত এবং একজন ইসলামি চিন্তাবিদ।
ড. মাহবুবা রহমান: সাবেক বিভাগীয় প্রধান, ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, লালমাটিয়া মহিলা কলেজ, ঢাকা।
আরএ/