ব্যাংক নিয়ে বিপন্ন বিস্ময়
সত্য নাকি বিস্ময়ের চেয়েও শক্তিশালী। তাই কিছু কিছু বিষয় যেন বিস্ময়কেও হার মানায়। যেমন সাধারণ মানুষ ধারণা করতে পারবেন, তিরিশ হাজার কোটি টাকা মানে কত টাকা? মাসে যদি কেউ এক লাখ টাকা করে সঞ্চয় করেন তাহলে এক কোটি টাকা সঞ্চয় করতে লাগবে ৮ বছর। এক লাখ টাকা আয় করতে পারেন এরকম মানুষ কতজন আছে দেশে আর এক লাখ টাকা মাসে সঞ্চয় করতে পারেন এরকম আয়ের মানুষ কতজন? তারপরও যদি তারা সঞ্চয় করতে থাকেন তাহলে ব্যাংকের মুনাফা পেয়ে কমপক্ষে ২ লাখ বছর লাগবে তিরিশ হাজার কোটি টাকা ব্যাংকে জমাতে। আর তিরিশ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়ে গেল ব্যাংক থেকে তেমন কোন কাগজ পত্র না দেখিয়ে বা ভুয়া কাগজপত্র দেখিয়ে! এও সম্ভব?
এই টাকা জনগণের জন্য ব্যয় করা হলে বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে ৮ হাজার কোটি টাকার বাড়তি বোঝা জনগণের কাঁধে চাপানো, সারের দাম বাড়ানো, তেলের দাম বাড়ানোর প্রয়োজন হতো না। আর ডলারের অঙ্কের পরিমাণ প্রায় তিন বিলিয়ন ডলার। সাড়ে তিন বছরে অর্থাৎ ৪২ মাসে সাড়ে চার বিলিয়ন ডলার ঋণের জন্য আইএমএফ এর প্রতিনিধি দলের কতই না জবাবদিহি আর শর্ত আমরা দেখলাম। আবার পদ্মা সেতু নিয়ে আবেগ, অহংকার ও গর্ব করে শাসক দল, তাদের সমর্থক এবং পদ্মা পাড়ের জনগণের সেটাও আমরা লক্ষ্য করেছি। সেই সময়েই খবর এলো এস আলম গ্রুপ নাকি ইসলামী ব্যাংক থেকে তিরিশ হাজার কোটি টাকা নিয়ে গিয়েছে। এস আলমের এই টাকা প্রায় পদ্মা সেতু নির্মাণের মোট খরচের সমান। পদ্মা সেতু করা নিয়ে শাসক দল ও তার সমর্থকদের যত আনন্দ-উল্লাস কিন্তু সেই একই পরিমাণ অর্থের লুটপাট নিয়ে কোন দুঃখ-বেদনা-লজ্জা-গ্লানি নেই! কেন এমন হলো বা হচ্ছে?
ব্যাংক থেকে টাকা নিয়ে ফেরত না দেওয়া বাংলাদেশে কি খুব সহজ? একের পর এক ঘটনায় প্রমাণিত হচ্ছে যে ব্যাংক থেকে ঋণের নামে টাকা বের করে নেওয়ার পদ্ধতি খুবই সহজ। এ জন্য প্রথম কাজ হলো ক্ষমতার সঙ্গে থাকা। রাজনৈতিক সম্পর্ক ব্যবহার করার দক্ষতা লাগবে। সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের মালিকপক্ষ ও ব্যবস্থাপনার সঙ্গে জড়িতদের সঙ্গে নিবিড় সংযোগ রক্ষা করে ভুয়া ঠিকানায় কাগুজে প্রতিষ্ঠান তৈরি করে ঋণ নেওয়া। এক্ষেত্রে রাজনৈতিক সম্পর্কগুলো যত প্রভাবশালী হবে নিয়ন্ত্রক সংস্থা ততই চুপচাপ থাকবে। নিশ্চয়ই মনে আছে কীভাবে প্রশান্ত কুমার (পি কে) হালদার নামে-বেনামে অনেকগুলো কোম্পানি খুলে তারপরই দখল করেছিলেন একাধিক আর্থিক প্রতিষ্ঠান। প্রশান্ত হালদার কিন্তু এই পদ্ধতির জনক ছিলেন না।
২০১১ সালে ব্যাপক আলোচনায় এসেছিল হল মার্ক কেলেঙ্কারি। কেলেঙ্কারির দায় না নিয়ে সমালোচনার জবাব দিতে গিয়ে তৎকালীন অর্থমন্ত্রী বলেছিলেন, বাংলাদেশের অর্থনীতির বিবেচনায় ৪ হাজার কোটি টাকা কিছুই নয়। সে সময় দেখা গিয়েছিল হল মার্ক গ্রুপ সোনালী ব্যাংক থেকে টাকা আত্মসাৎ করতে যেসব কোম্পানির নাম ব্যবহার করে, তার কয়েকটি ছিল কাগজ নির্ভর। অর্থাৎ এসব কোম্পানির কোনো অস্তিত্ব ছিল না। এর ফলে সোনালী ব্যাংকের লোকসান হয় প্রায় তিন হাজার কোটি টাকা। যার পুরোটাই এখন খেলাপি। সোনালি ব্যাংক কি সেই ধাক্কা এখনো কাটিয়ে উঠতে পেরেছে?
এর পর খবর বের হয় ২০১৪-১৫ সালে অ্যাননটেক্স গ্রুপ জনতা ব্যাংক থেকে প্রায় সাড়ে ৫ হাজার কোটি টাকা ঋণের নামে নিয়ে গিয়েছে। এই পরিমাণ ঋণ নেওয়ার জন্য ২২টি প্রতিষ্ঠানের নাম ব্যবহার করে গ্রুপটি। পরবর্তীকালে বাংলাদেশ ব্যাংকের তদন্ত কিংবা পরিদর্শনে দেখা যায়, এদের মধ্যে মাত্র চারটি কোম্পানি ছিল পূর্ণাঙ্গ। অনেকগুলোই কাগুজে। আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো এসব কোম্পানির মালিক বানানো হয়েছিল প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের। কী কারবার! ফলে যা হবার তাই হলো। এসব ঋণের বড় অংশ এখন খেলাপি। আর এই ঋণের কারণে জনতা ব্যাংক এখন ঋণখেলাপিতে শীর্ষ।
শুধু সরকারি ব্যাংক নয়, বেসরকারি খাতের ব্যাংক ইউনিয়ন ব্যাংকে ভল্ট কেলেঙ্কারির ঋণেও বড় অনিয়ম ধরা পড়ে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক পরিদর্শনে দেখতে পায় যে, শুধু ট্রেড লাইসেন্সের ভিত্তিতে কোম্পানি খুলে ঋণের বড় অংশই নিয়ে নিয়েছে প্রায় ৩০০ প্রতিষ্ঠান।
ইউনিয়ন ব্যাংকের বিতরণ করা ঋণের ১৮ হাজার ৩৪৬ কোটি টাকা খেলাপি হওয়ার যোগ্য বলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনে উঠে এসেছিল, যা ছিল ব্যাংকটির মোট ঋণের ৯৫ শতাংশ। একইভাবে সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকেও বড় অনিয়ম পেয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে ব্যাংক দুটি এখনো এসব ঋণ খেলাপি বলে ঘোষণা করেনি। ঋণ পরিশোধের মেয়াদ বাড়িয়ে ও পুনঃতফসিল করে ঋণগুলো নিয়মিত দেখাচ্ছে ব্যাংক দুটি। তাতে ব্যাংকের ইমেজ ও আমানত কোনোটাই কি রক্ষা পাবে?
একই ধরনের ঘটনা ধরা পড়ল এবার ইসলামী ব্যাংকে। ব্যাংক থেকে যেসব প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দেওয়া হয়েছে, তার খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। তবে ঘটনাটা একদিনে ঘটেনি। এমন ঋণ দেওয়া শুরু করেছিল চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জ শাখা থেকে। দেখা গেছে ব্যাংকটির যেসব কর্মকর্তা এই ঋণ প্রদানে সহায়তা করেছেন তাদের দ্রুত পদোন্নতি হয়েছে। এবং তাদেরকেই দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে ঋণসংক্রান্ত বিভাগগুলোতে। ফলে সহজেই বণ্টন করা হয়েছে ভুয়া ঋণ। এসব ঋণের মেয়াদ দেওয়া হয়েছে বেশি, যাতে সহজেই ঋণ খেলাপি না হয়। ভুয়া কোম্পানি খুলে শুধু ঋণ দেওয়া নেওয়া নয়, দেশের কয়েকটি ব্যাংক দখলের সময়ও এমন কিছু কোম্পানির নাম ব্যবহার হয়েছিল, যাদের সঠিক পরিচয় ছিল না।
বাংলাদেশ ব্যাংক যদি উদাসিন বা নিষ্ক্রিয় থাকে, তখন ভালো ব্যাংকগুলো, যাদের আমানত বেশি সেগুলো আক্রান্ত হবে এবং এটাই ঘটছে। পত্র পত্রিকায় নাম আসছে যে, একজন ব্যক্তি ও তাঁর পরিবার ব্যাংক খাতকে বড় ঝুঁকিতে ফেলে দিচ্ছে। এটা যে অর্থনীতির জন্য কত বড় বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে সরকার কি তা বুঝে না? তাহলে কেন চুপ করে ছিল, প্রতিরোধের কোনো লক্ষণ দেখা গেল না কেন? নিয়ন্ত্রক সংস্থা ও দুর্নীতি দমন সংস্থা আর কতদিন চোখ বন্ধ রাখবে বা দেখতে চাইবে না? রেমিটেন্সের মাধ্যমে যে ডলার আয় হয়, তা ব্যাংক মালিকদের কোম্পানির আমদানিতে খরচ করতেই যদি শেষ হয়ে যায়, অন্য কেউ যদি ব্যবসা করার সুযোগ না পায় তাহলে কি অবস্থা দাঁড়াবে? পুরো ভোগ্যপণ্যের বাজার যদি এইসব প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণে চলে যায় তাহলে দেশটা জিম্মি হয়ে পড়বে এদের হাতে। যার বিষময় ফল ইতিমধ্যে হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন দেশবাসী।
ইসলামী ব্যাংক থেকে এস আলমের ৩০ হাজার কোটি টাকার অধিক লোপাটের এই চাঞ্চল্যকর ঘটনার পর ঋণ কেলেঙ্কারি অনুসন্ধানের নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। এর শেষ দেখার আশায় আছে দেশবাসী।
লেখক: সদস্য, কেন্দ্রীয় কমিটি, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ)