জাতির পিতার মহানায়কোচিত স্বদেশ প্রত্যাবর্তন
১০ জানুয়ারি ১৯৭২ বাঙালি জাতির ইতিহাসে একটি অবিস্মরণীয় দিন, বাঙালির আনন্দাশ্রু মিশ্রিত এক আলোকিত অভিযাত্রার গর্বময় ইতিহাস। এদিন দুপুর ১টা ৪১ মিনিটে পাকিস্তানের কারাগারে দীর্ঘ সাড়ে ৯ মাস দুঃসহ কারাবরণের পর বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলার মাটি স্পর্শ করেন এবং লক্ষ লক্ষ অনুরাগীর ভালবাসায় সিক্ত হন। বাংলাদেশের জনগণ এদিনই প্রাণভরে বিজয়ের পূর্ণ স্বাদ উপভোগ করেন।
১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীন হলেও বাংলার মানুষ তখনও জানত না তাদের নয়নের মণি ইতিহাসের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব জীবিত আছেন কি না? তাই বিজয়ের মধ্যেও মানুষের মনে ছিল শঙ্কা ও বিষাদের ছাপ। এছাড়াও যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি দেশের পুনর্গঠন ও প্রশাসনিক কাঠামো তৈরির মাধ্যমে জাতিকে ঐক্যবদ্ধ রাখতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শারীরিক উপস্থিতি ছিল অনিবার্য। ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ বাংলাদেশ আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীন হলেও প্রকৃতপক্ষে ১০ জানুয়ারি ১৯৭২ এদিনটি ছিল বাঙালির জন্য পরিপূর্ণভাবে স্বাধীনতা অর্জনের দিন। কারণ যদি পাকিস্তানের কারাগারে থাকাকালীন সামরিক আদালতে প্রহসনের বিচারের রায়ে জনপ্রতিনিধি শেখ মুজিবুর রহমানের মৃত্যুদণ্ডাদেশ কার্যকর করা হত তাহলে বিজয় লাভের পরেও বাংলার ভাগ্যাকাশে নেমে আসত দুর্যোগের ঘনঘটা ও বিপন্ন হতো স্বাধীনতা। ৮ জানুয়ারির প্রথম প্রহরে পাকিস্তানি বন্দিদশা থেকে মুক্তিলাভের পর লন্ডন হয়ে দিল্লীর যাত্রাবিরতি শেষে ১০ জানুয়ারি বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুর প্রত্যাবর্তন বাঙালি জাতির স্বাধীনতা সংগ্রামের আরেকটি আলোকিত অধ্যায়।
বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের মধ্য দিয়েই স্বাধীন বাংলাদেশের স্বতঃস্ফূর্ত গণতান্ত্রিক যাত্রা শুরু হয়েছিল। তরুণ প্রজন্মের জানা উচিত স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পূর্বে লন্ডনে ও দিল্লীতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে কিরকম বীরোচিত সম্বর্ধনা দেওয়া হয়েছিল এবং তার জবাবে বঙ্গবন্ধুর প্রতিক্রিয়া কি ছিল? তরুণ প্রজন্মের জানা উচিত দিল্লীর প্যারেড গ্রাউন্ডের সম্বর্ধনা জনসভায় এবং পরে একই দিনে ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) বঙ্গবন্ধু যে ঐতিহাসিক ভাষণ দিয়েছিলেন সেখানে তিনি কতোটা প্রখর দূরদর্শিতার মাধ্যমে বাংলাদেশের একটি রাষ্ট্রীয় কাঠামোর ভিত্তি দর্শন উপস্থাপন করেছিলেন। রেসকোর্স ময়দান বঙ্গবন্ধু যে ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ দিয়েছেন তা যেমন বাঙালির একটি অমর কাব্যগাঁথা তেমনি ১০ জানুয়ারি একই জায়গায় বঙ্গবন্ধুর আবেগ-আপ্লুত ভাষণটি বাঙালির মুক্তির একটি অনন্য দলিল।
১৯৭১-এর ২৫ মার্চ রাত ১২টা ২০ মিনিটে বঙ্গবন্ধু কর্তৃক বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা দেওয়ার পর পরই পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী গ্রেফতার করেছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। ২৯০ দিন তিনি বন্দি ছিলেন পাকিস্তানে। কারাগারে বন্দি থাকা অবস্থায় আগস্টে তার গোপন বিচারের উদ্যোগ নিয়েছিলেন পাকিস্তানের সামরিক জান্তার প্রধান জেনারেল আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খান। প্রহসনের বিচারের আগে একটি শ্বেতপত্র প্রকাশ করে বঙ্গবন্ধুকে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপরাধে অভিযুক্ত করা হয়েছিল। বন্দি অবস্থায় প্রহসনের বিচার করে তাঁকে হত্যার সব রকম আয়োজন সম্পন্ন করা হয়েছিল। বিশ্ববাসী বুঝতে পেরেছিল পাকিস্তান সরকার যে কোনো কায়দায় বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে বাংলাদেশের মুক্তিকামী মানুষের মনোবলে চিড় ধরাতে চায়। ১০ আগস্ট বিচার শুরু হয়। জাতিসংঘের মহাসচিব উ থান্ট তাঁর প্রতিক্রিয়ায় বলেন, ‘এই বিচার কী অভিঘাত সৃষ্টি করে, তা নিয়ে জাতিসংঘ উদ্বিগ্ন।’ প্রহসনের বিচার শেষ হয় ডিসেম্বরের ৪ তারিখে এবং নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি শেখ মুজিবুর রহমানকে সামরিক আদালতে মৃত্যুদণ্ডাদেশ প্রদান করা হয়। জেলে থাকাকালীন বঙ্গবন্ধু ছিলেন সম্পূর্ণভাবে পরিবার ও জগৎ বিচ্ছিন্ন, ছিলেন সম্পূর্ণ অন্ধকারে। বঙ্গবন্ধু জানতেন না তাঁর অনুপস্থিতিতে তাঁকে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত করে একদিকে প্রবাসী সরকার চালিয়ে যাচ্ছে কূটনৈতিক যুদ্ধ, অন্যদিকে বাঙালিরা প্রশিক্ষণ নিয়ে রয়েছে যুদ্ধের মাঠে। এমনকি তিনি জানতেন না গণহত্যা ও মা-বোনদের ইজ্জত লুণ্ঠনের কথা, তিনি জানতেন না ভারতে লাখ লাখ শরণার্থীর বিষয়ে। তিনি শুধু জানতেন মৃত্যুর রায় হয়ে গেছে। কারা কর্তৃপক্ষকে ফাঁসির সব রকম ব্যবস্থা নিয়ে রাখতে বলা হয়েছিল, যাতে ওই আদেশ-সংবলিত বিশেষ টেলিগ্রামটি পৌঁছানো মাত্রই মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা যায়।
সামরিক আদালতের সেই রায় বঙ্গবন্ধু ধীর শান্ত মনে গ্রহণ করে নিজেকে মৃত্যুর জন্য তৈরি করে রেখেছিলেন। রায় ঘোষিত হওয়ার দিবাগত রাতেই বঙ্গবন্ধুকে লায়ালপুর জেলখানা থেকে মিয়াওয়ালি জেলে হেলিকপ্টারযোগে স্থানান্তরিত করা হয় । বঙ্গবন্ধু তাঁর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার প্রস্তুতি জানাতে গিয়ে ১৯৭২ সালের জানুয়ারিতে সাংবাদিক ডেভিড ফ্রস্টের কাছে এক সাক্ষাতকারে বলেছেন যে জেলে তাঁর সেলের পাশে কবর পর্যন্ত খোঁড়া হয়েছিল । ডেভিড ফ্রস্টের এ সংক্রান্ত এক প্রশ্নের উত্তরে বঙ্গবন্ধু বলেন ÔYes, I've seen it with my own eyes, and I said, ‘I know, this is my grave perhaps.’ All right, I'm ready'। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা সম্ভব হয়নি প্রধানত ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর সর্বাত্মক উদ্যোগ ও হস্তক্ষেপের কারনে। বঙ্গবন্ধুর প্রহসনের বিচার বন্ধ করে তাঁর মুক্তির জন্য পাকিস্তান সরকারকে চাপ দেয়ার ব্যাপারে অনুরোধ জানিয়ে তিনি ৬৭ টি দেশের সরকারপ্রধান ও রাষ্ট্রপ্রধানকে চিঠি দিয়েছিলেন। শুধু তাই নয় তিনি তাঁর মন্ত্রীসভার সদস্যদের বিভিন্ন দেশে পাঠিয়েছিলেন এবং শেষে তিনি স্বয়ং ইউরোপের ৫টি দেশ ও যুক্তরাষ্ট্র সফর করেন। তাঁর এসব ইতিবাচক পদক্ষেপসমূহের কারনে প্রতিকূল আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশের অনুকূলে এসেছিল। পাকিস্তানের সচেতন নাগরিকরাও বঙ্গবন্ধুর বিচার বন্ধ করে তাঁর সঙ্গে আলোচনার দাবি জানিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ হত্যা করার সাহস না পাওয়ার আর একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হচ্ছে পাকিস্তানিরা ভালোভাবেই জানতো, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর শেখ মুজিবের ফাঁসির খবর বাঙালিরা জানতে পারলে সেখানে আটকে পড়া ৯৩,০০০ পাকিস্তানি সেনা অফিসার ও জোয়ানদের একজনকেও বাঙালিরা জীবিত রাখবে না।
’৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ-ভারত যৌথ কমাণ্ডারের নিকট পরাজিত পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী এবং তাদের সহযোগিদের আত্মসমর্পণের পর বঙ্গবন্ধুকে কারাগার থেকে স্থানান্তর করা হলেও স্বদেশে ফিরতে দেয়া হয়নি। স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের জন্য বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তানে অপেক্ষা করতে হয়েছে ১৯৭২-এর ৮ জানুয়ারির প্রথম প্রহর পর্যন্ত। ক্ষমতা গ্রহণের মাত্র ১ দিন পর ২১ ডিসেম্বর সর্বপ্রথম বিদেশি সাংবাদিক ও কূটনীতিকদের এক সভায় ভুট্টো বলেন ‘শেখ মুজিবকে শিগগিরই মুক্তি দিয়ে গৃহবন্দি করে রাখা হবে’। ২৬ ডিসেম্বর মিয়াওয়ালি জেলখানা থেকে মুজিবকে সিহালা রেস্টহাউজে আনা হয়। ২৭ ডিসেম্বর পাকিস্তানের সদ্য ক্ষমতাপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট জুলফিকার আলী ভুট্টো রেস্টহাউজে গিয়ে বঙ্গবন্ধুর সাথে সাক্ষাত করেন এবং একই দিনে ড. কামাল হোসেনকে আনা হয় একই রেস্টহাউজে। ৮ জানুয়ারি পাকিস্তান ত্যাগ করার পূর্ব পর্যন্ত ভুট্টোর প্রাণপণ চেষ্টা ছিল শেখ মুজিবের কাছ থেকে একটি প্রতিশ্রুতি আদায় করা আর তা হলো- ‘বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে একটি জোড়াতালির সম্পর্ক বজায় রাখা।’ কিন্তু মুজিবের কথা ছিল একটাই- ‘আগে আমার জনগণের কাছে যেতে দাও। বাংলাদেশে না গিয়ে এ ব্যাপারে আমি কোনো কথাই বলতে পারব না।’ ৩ জানুয়ারি করাচির নিশতার পার্কের জনসভায় ভুট্টো ঘোষণা দেন- ‘আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবকে নিঃশর্ত মুক্তি দান করা হবে।’ ভুট্টো বঙ্গবন্ধুকে সরাসরি বাংলাদেশে ফিরতে দেননি। ৮ জানুয়ারির প্রথম প্রহরের পর শেখ মুজিবকে বহনকারী বিশেষ বিমানটি ইসলামাবাদ বিমানবন্দর ত্যাগ করে, সঙ্গে ড. কামাল হোসেন তাঁর স্ত্রী ও কন্যাসহ। পাকিস্তান থেকে বঙ্গবন্ধু পিআইএ’র ৭০৭ নম্বর বিশেষ কার্গো বিমানে প্রথমে লন্ডন গিয়েছেন। এরপর শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর বিশেষ অনুরোধে লন্ডন থেকে ঢাকা আসার পথে তিনি দিল্লীতে কয়েক ঘন্টার জন্য যাত্রাবিরতি করেছিলেন। লন্ডনে এবং দিল্লী উভয় জায়গাতেই তিনি পেয়েছিলেন বীরোচিত সংবর্ধনা ।
৮ জানুয়ারি সকাল ৭টায় বিবিসি’র ওয়াল্ড সার্ভিসে প্রচারিত খবরে বলা হয়’ বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতা শেখ মুজিবুর রহমান বিমানযোগে লন্ডনে আসছেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই বিমানটি লন্ডনের হিথরো বিমানবন্দরে অবতরণ করবে।’ প্লেনটি বিমানবন্দরে অবতরণ করার পর বঙ্গবন্ধু প্লেন থেকে নেমে ভিআইপি লাউঞ্জে আসলে তাঁকে বৃটিশ বৈদেশিক দপ্তরের উপস্থিত কিছু কর্মকর্তা স্বাগত জানান। কিছুক্ষণের মধ্যে সেখানে বৃটিশ ফরেন অফিসের দক্ষিণ এশিয়া বিভাগের প্রধান কর্মকর্তা স্যার ইয়ার মাদারল্যান্ড উপস্থিত হয়ে জানান বৃটিশ সরকার বঙ্গবন্ধুকে রাষ্ট্রীয় অতিথির মর্যাদা দিয়েছেন। সকাল ৮টার মধ্যেই বঙ্গবন্ধুকে ব্রিটিশ সরকারের সম্মানিত অতিথি হিসেবে লন্ডনের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত ক্যারিজেস হোটেলে নিয়ে আসা হয়। অল্প সময়ের মধ্যে ব্রিটিশ লেবার পার্টির নেতা (পরে প্রধানমন্ত্রী) হ্যারল্ড উইলসন বঙ্গবন্ধুর সাথে দেখা করতে এসে বলেন ‘গুড মর্নিং মি. প্রেসিডেন্ট’। বঙ্গবন্ধুর উপস্থিতির কথা জেনে হাজার হাজার বাঙালি হোটেল ঘিরে ‘জয়বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ শ্লোগান দিয়ে আকাশ-বাতাশ মুখরিত করে। দুপুরের দিকে এক জনাকীর্ণ সাংবাদিক সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেন ‘এক মুহূর্তের জন্য আামি বাংলাদেশের কথা ভুলিনি, আমি জানতাম ওরা আমাকে হত্যা করবে আমি আপনাদের সঙ্গে দেখা করার সুযোগ পাব না, কিন্তু আমার জনগণ মুক্তি অর্জন করবে।’ বঙ্গবন্ধু যখন লন্ডনে পৌঁছেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এ্যাডওয়ার্ড হিথ ছিলেন লন্ডনের বাইরে। বঙ্গবন্ধুর পৌঁছানোর কথা শুনে পূর্বনির্ধারিত কর্মসূচি বাতিল করে প্রধানমন্ত্রী হিথ ১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিটে ছুটে আসেন। প্রধানমন্ত্রী হিথ তাঁকে নজীরবিহীন সম্মান দেখান। ইতিহাস সাক্ষী ঐদিন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী হিথ নিজে তাঁর কার্যালয়ের বাইরে এসে গাড়ির দরজা খুলে দাঁড়িয়ে রইলেন, যতোক্ষণ শেখ মুজিব গাড়ি থেকে বেরিয়ে না এলেন।
১০ জানুয়ারি দিল্লীতে বঙ্গবন্ধুর জন্য বিশাল নাগরিক সম্বর্ধনার আয়োজন করা হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু লন্ডন থেকে দিল্লী হয়ে ঢাকা এসেছিলেন ব্রিটিশ রাজকীয় বিমান বাহিনীর একটি বিশেষ বিমানে যা কমেট নামে পরিচিত। রূপালী কমেট বিমানে চড়ে ১০ জানুয়ারি সকাল ৮টায় দিল্লীর পালাম বিমানবন্দরে ভারত সরকারের আমন্ত্রণে সংবর্ধনার জন্য নামেন। বিমানবন্দরে ভারতের রাষ্ট্রপতি ভিভি গিরি ও প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীসহ মন্ত্রিসভার সকল সদস্য, তিন বাহিনীর প্রধান এবং কূটনৈতিক মিশনের প্রধানগণ উপস্থিত ছিলেন। দিল্লীর প্যারেড গ্রাউন্ডের জনসভায় বঙ্গবন্ধু যে ভাষণটি দিয়েছিলেন তা ছিল নানা দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ। এ ভাষণের কিছু অংশ ১৯৯৮ সালে বোম্বের ফিল্ম ডিভিসনের আর্কাইভ থেকে সংগ্রহ করেছিলেন প্রখ্যাত সাংবাদিক শাহরিয়ার কবির এবং বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের ৪০তম বার্ষিকী উপলক্ষে তাঁর লেখা ‘১০ জানুয়ারির দুটি ভাষণ এবং বঙ্গবন্ধুর বিশ্বাস’ থেকে বঙ্গবন্ধু ও ইন্দিরা গান্ধীর বক্তৃতা সম্পর্কে জানা যায়। বঙ্গবন্ধুর আগে একটি সংক্ষিপ্ত ও মর্মস্পর্শী ভাষণ দিয়েছিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী যেটিও ছিল একটি আলোকিত ভাষণ। বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে ইন্দিরা গান্ধী বলেছিলেন, ‘শেখ সাহেব তাঁর জাতিকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তাদের স্বাধীনতা এনে দেবেন। তিনি তাঁর প্রতিশ্রুতি রক্ষা করে তাদের স্বাধীনতা এনে দিয়েছেন। পাকিস্তানিরা কায়িকভাবে তাঁকে বন্দি করেছিল, তাঁর আত্মাকে বন্দি করতে পারেনি। তাঁর স্বাধীন আত্মা বাংলাদেশের মানুষদের স্বাধীনতার লড়াইয়ে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে। যে সব আদর্শের জন্য তাঁরা সংগ্রাম করেছেন আমরাও একই আদর্শে বিশ্বাসী।’ মুক্তিযুদ্ধে সহযোগিতার জন্য ইন্দিরা গান্ধী ও ভারত সরকারের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বঙ্গবন্ধু তাঁর ভাষণে বলেন ‘জানেন বাংলাদেশ শেষ হয়ে গেছে। আমি সকল প্রকার সাহায্য সহানুভূতি আশা করি এবং এও আশা করি দুনিয়ায় শান্তিকামী, গণতান্ত্রিক যে মানুষ আছে তারা এগিয়ে আসবে আমার মানুষদের সাহায্য করার জন্য।’ তিনি আরো বলেন, ‘আমি বিশ্বাস করি সেক্যুলারিজমে। আমি বিশ্বাস করি গণতন্ত্রে। আমি বিশ্বাস করি সোস্যালিজমে।’ আমাকে প্রশ্ন করা হয় শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে আপনার আদর্শের এত মিল কেন? আমি বলি- ‘এটা আদর্শের মিল, নীতির মিল, এটা মনুষ্যত্বের মিল, এটা বিশ্বশান্তির জন্য মিল।’ বঙ্গবন্ধুর এই কথা শুনে সমবেত জনতা করতালিতে ফেটে পড়েছিলেন।
বঙ্গবন্ধুকে দিল্লী থেকে বৃটিশ এয়ার ওয়েজের কমেট বিমানটি বেলা ১.৪১ মিনিটে যখন তেজগাঁও বিমানবন্দরে পৌঁছায়, তখন বিমানবন্দর থেকে রেসকোর্স পরিণত হয়েছে এক জনসমুদ্রে যা কেবলমাত্র ৭ মার্চে তাঁর ঐতিহাসিক ভাষণের জনসমুদ্রের সাথে তুলনা করা যেতে পারে। বিমানবন্দর থেকে সারা পথ প্রচণ্ড ভিড়ের মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধু রেসকোর্সের দিকে রওনা হন। বিমানবন্দর থেকে একটি খোলা ট্রাকে রেসকোর্স যেতে জাতির পিতার সময় লাগে আড়াই ঘণ্টা। রেসকোর্সের জনসভায় তিনি মাইকের সামনে দাঁড়িয়ে শিশুর মতো কান্নায় ভেঙে পড়লেন, দুই চোখ গড়িয়ে পড়েছিল বহুবার অশ্রু। অশ্রুসজল তাঁর এ ভাষণটিতে আবেগের মধ্য দিয়ে দেশবাসীর ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি তিনি যে আহবান ও নির্দেশনা দিয়েছিলেন তা ছিল বীরোচিত এক বিশ্ববরেণ্য নেতার ভাষণ। তিনি কান্নারত কণ্ঠে বললেন, “কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন- ‘সাত কোটি বাঙ্গালির হে মুগ্ধ জননী, রেখেছো বাঙালি করে মানুষ করো নাই’। কবিগুরুর কথা মিথ্যা প্রমাণ হয়ে গিয়েছে। আমার বাঙালি আজ মানুষ। আমার বাঙালি আজ দেখিয়ে দিয়েছে দুনিয়ার ইতিহাসে এত লোক আত্মাহুতি, এত লোক জান দেয় নাই। তাই আমি বলি আমায় দাবায় রাখতে পারবা না।” ভাষণে ৩০ লাখ মানুষকে মেরে ফেলা হয়েছে উল্লেখ করে বঙ্গবন্ধু বলেন, “দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে, প্রথম বিশ্বযুদ্ধেও এত মানুষ, এত সাধারণ জনগণ মৃত্যুবরণ করে নাই, শহীদ হয় নাই, যা আমার ৭ কোটির বাংলায় করা হয়েছে। আমি জানতাম না আমি আপনাদের কাছে ফিরে আসবো, আমি খালি একটা কথা বলেছিলাম, তোমরা যদি আমাকে মেরে ফেলে দাও কোনো আপত্তি নাই, মৃত্যুর পরে তোমরা আমার লাশটা আমার বাঙালির কাছে দিয়ে দিও- এই একটা অনুরোধ তোমাদের কাছে।”
ভাষণে যুদ্ধবিধ্বস্ত স্বাধীন বাংলাদেশ পুনর্গঠনে সবার সাহায্য সহযোগিতা চেয়ে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আমি আশা করি, দুনিয়ার সব রাষ্ট্রের কাছে আমার আবেদন, যে আমার রাস্তা নাই, ঘাট নাই, আমার জনগণের খাবার নাই, আমার মানুষ গৃহহারা, সর্বহারা, আমার মানুষ পথের ভিখারী, তোমরা আমার মানুষকে সাহায্য করো। মানবতার খাতিরে আমি তোমাদের কাছে সাহায্য চাই। দুনিয়ার সব রাষ্ট্রের কাছে আমি সাহায্য চাই। আমার বাংলাদেশকে তোমরা রিকোগনাইজ করো, জাতিসংঘে স্থান দাও। দিতে হবে উপায় নাই। দিতে হবে। আমরা হার মানবো না, আমরা হার মানতে জানি না।’ শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে যুদ্ধবিধ্বস্ত স্বাধীন বাংলাদেশকে সম্মিলিত উদ্যোগে সোনার বাংলা হিসেবে গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু তাঁর বক্তৃতায় বারবার। সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের পুনর্গঠনের গুরুত্ব বিবেচনায় নিয়ে রেসকোর্সের সেই ভাষণে আবেগ আপ্লুত বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আজ থেকে আমার অনুরোধ, আজ থেকে আমার আদেশ, আজ থেকে আমার হুকুম, ভাই হিসেবে, নেতা হিসেবে নয়, প্রেসিডেন্ট হিসেবে নয়, প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নয়। আমি তোমাদের ভাই, তোমরা আমার ভাই। এই স্বাধীনতা আমার ব্যর্থ হয়ে যাবে যদি আমার বাংলার মানুষ পেট ভরে ভাত না খায়। এই স্বাধীনতা আমার পূর্ণ হবে না যদি বাংলার মা-বোনেরা কাপড় না পায়। এই স্বাধীনতা আমার পূর্ণ হবে না যদি এদেশের মানুষ যারা আমার যুবক শ্রেণি আছে তারা চাকরি না পায় বা কাজ না পায়। মুক্তিবাহিনী, ছাত্রসমাজ, কর্মী বাহিনী তোমাদের মোবারকবাদ জানাই। তোমরা গেরিলা হয়েছো, তোমরা রক্ত দিয়েছো, রক্ত বৃথা যাবে না, রক্ত বৃথা যায় নাই’।
তিনি ভাষণে দেশে ফেরায় স্বস্তি প্রকাশ করে বলেন, ‘আমারে আপনারা পেয়েছেন আমি আসছি। জানতাম না, আমার ফাঁসির হুকুম হয়ে গেছে। আমার সেলের পাশে আমার জন্য কবর খোঁড়া হয়েছিল। আমি প্রস্তুত হয়েছিলাম, বলেছিলাম আমি বাঙালি, আমি মানুষ, আমি মুসলমান- একবার মরে দুই বার মরে না। আমি বলেছিলাম, আমার মৃত্যু আইসে থাকে যদি আমি হাসতে হাসতে যাবো, আমার বাঙালি জাতিকে অপমান করে যাবো না, তোমাদের কাছে ক্ষমা চাইবো না এবং যাবার সময় বলে যাবো জয় বাংলা, স্বাধীন বাংলা, বাঙালি আমার জাতি, বাংলা আমার ভাষা, বাংলার মাটি আমার স্থান’। বাংলাদেশের রাষ্ট্র ব্যবস্থা সম্পর্কে ভাষণে তিনি বলেন, ‘আমার রাষ্ট্রে এই বাংলাদেশে হবে সমাজতন্ত্র ব্যবস্থা। এই বাংলাদেশে হবে গণতন্ত্র। এই বাংলাদেশে হবে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র’। স্বাধীনতা যুদ্ধে ভারতের নানামুখী অবদানের কথা একাধিকবার কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করে ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর ব্যক্তিগত উদ্যোগের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে বঙ্গবন্ধু তাঁর ভাষণে বলেন, “আমি বলে দিবার চাই আসার সময় দিল্লিতে শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে কথা হয়েছে, যেদিন আমি বলবো সেদিন ভারতের সৈন্য বাংলার মাটি ছেড়ে চলে যাবে এবং তিনি আস্তে আস্তে কিছু সরিয়ে নিচ্ছেন।” পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্কের প্রসঙ্গে ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেন, “পশ্চিম পাকিস্তানের ভাইদের বলি তোমরা সুখে থাকো। তোমার সামরিক বাহিনীর লোকেরা যা করেছে, আমার মা বোনদের রেপ করেছে, আমার ৩০ লক্ষ লোককে মেরে ফেলে দিয়েছে, যাও সুখে থাকো। তোমাদের সাথে আর না, শেষ হয়ে গেছে। তোমরা স্বাধীন থাকো, আমিও স্বাধীন থাকি।” তিনি ভাষণের এক পর্যায়ে আরো বলেন, “ (পাকিস্তানি কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে) আসার সময় ভুট্টো আমায় বললেন, শেখ সাব দেখেন দুই অংশের একটা বাঁধন রাখা যায় নাকি। আমি বললাম, আমি কিছু বলতে পারি না, আমি কোথায় আছি জানি না। আমার বাংলা, আমার মাটিতে গিয়ে বলবো। আজ বলছি, ভুট্টো সাহেব সুখে থাকো, বাঁধন ছুটে গেছে। তুমি (ভুট্টো) যদি কোনো বিশেষ শক্তির সাথে গোপনে পরামর্শ করে আমার বাংলার স্বাধীনতা হরণ করতে চাও, এবার মনে রেখো, এবার তাদের নেতৃত্ব দেবে শেখ মুজিবুর রহমান, মরে যাবো, স্বাধীনতা হারাতে ছাড় দেবো না।” ভাষণে তিনি সবাইকে সতর্ক করে বলেছিলেন, “আমি জানি ষড়যন্ত্র শেষ হয় নাই, সাবধান বাঙালি ষড়যন্ত্র শেষ হয় নাই।” নিজেদের ‘মুসলমান’ দাবিকারি পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর নিষ্ঠুরতার প্রসঙ্গ তুলে ধরে জনসমুদ্রে ভাষণ দেবার সময় বঙ্গবন্ধু বলেন, “কতবড় কাপুরুষ যে নিরপরাধ লোককে এভাবে হত্যা করে সামরিক বাহিনীর লোকেরা। আর তারা বলে কি আমরা পাকিস্তানের মুসলমান সামরিক বাহিনী । (ওদের) ঘৃণা করা উচিত।... আমরা মুসলমান, মুসলমান মা-বোনদের রেপ করে (পাকিস্তানিদের কথাকে ব্যাঙ্গ করে বলছেন) । আমরা মুসলমান !”
পাকিস্তানি জান্তারা শত প্রলোভন এবং ফাঁসির ভয় দেখিয়েও বন্দি জীবনের সাড়ে নয় মাসে শেখ মুজিবের কাছ থেকে কোনো কথা আদায় করতে পারেনি। জেলে আটক অবস্থায় প্রহরীদের সালামের জবাব দেওয়া ছাড়া কোন কথাই তিনি বলেননি ওই দুঃসহ বন্দি জীবনে। বাঙালির অধিকার আদায়ের সংগ্রাম করতে গিয়ে যিনি ৪৮ বার গ্রেফতার হয়েছিলেন এবং ১৩বছরের মতো সময় জেলের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে কাটিয়েছেন, মুক্তিযুদ্ধকালীন পাকিস্তানের কারাগারে প্রতিটি প্রহর যার কেটেছে মৃত্যু আশংকায়, জেলে থেকেও যিনি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক, যাঁর নাম মুখে নিয়ে হাসতে হাসতে জীবন দিয়েছে বাঙালি, ইতিহাসের সেই মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বদেশ প্রতাবর্তন ব্যতিত স্বাধীনতা সংগ্রামের বিজয়ের আনন্দ বাঙালি কিভাবে উপভোগ করে? প্রকৃতপক্ষে ১০ জানুয়ারিতে বাংলার রাজনীতির মুকুটহীন সম্রাট সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা শেখ মুজিবকে পেয়ে বাঙালি বিজয়ের পরিপূর্ণ আনন্দ প্রাণভরে উপভোগ করেছে। এ দিনই বঙ্গবন্ধুর হাত ধরেই, স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রবেশ করেছে এক গণতন্ত্রের এক আলোকিত অভিযাত্রায়। শুধু তাই নয়, ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে যেভাবে বঙ্গবন্ধু ইতিহাসকে সমৃদ্ধ করে গেছেন, তাঁর বীরোচিত স্বদেশ প্রত্যাবর্তন বাঙালির মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাসকে সমৃদ্ধ করার আর একটি বিরল ঘটনা। তাইতো প্রখ্যাত কবি অন্নদাশংকর রায়ের ভাষায় বলতে হয়-
‘যতকাল রবে পদ্মা যমুনা
গৌরী মেঘনা বহমান
ততকাল রবে কীর্তি তোমার
শেখ মুজিবুর রহমান।’
লেখক: সভাাপতি ও অধ্যাপক, আইন বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।
Email: hprodhan@yahoo.com