র্যাবের উপর নিষেধাজ্ঞা এবং জঙ্গিবাদের উত্থানের যোগসূত্রতা
মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ এনে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটেলিয়নের (র্যাব) বেশ কিছু কর্মকর্তার উপর যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা আরোপের ঘটনাটি সাম্প্রতিক সময়ে বেশ আলোচনার মুখ দেখেছে। প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য বিভিন্ন দেশের ১৫ ব্যক্তি ও ১০ প্রতিষ্ঠানের উপর এই নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে, যার মধ্যে সাত জনই বাংলাদেশের।
স্বাভাবিকভাবেই বাংলাদেশ সরকার এবং সাধারণ জনগণের মনে এই সিদ্ধান্তে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছে। এটা যে কোনো স্বাভাবিক সিদ্ধান্ত নয়—সেটি পরিষ্কার উপলব্ধি করা যায়। বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের বিপক্ষে একটি শক্তিশালী গোষ্ঠী সব সময়েই ষড়যন্ত্রে লিপ্ত থাকে—সে কথা নতুন করে বলার প্রয়োজন নেই। আর সেই শক্তি এখন নতুন আঙ্গিকে নতুন কৌশলে ষড়যন্ত্র অব্যাহত রেখেছে। রাজনৈতিক স্থিতিশীল পরিস্থিতিকে কীভাবে অস্থিতিশীল করে রাজনৈতিক উত্তেজনাপূর্ণ ক্ষেত্র হিসেবে বাংলাদেশকে কীভাবে বহিঃর্বিশ্বে তুলে ধরা যায় সে বিষয়ে ক্রমাগত কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বর্তমানে বিশ্ব পুঁজিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের মোড়লের ভূমিকায় রয়েছে। নিকট অতীতেও দেশটির বিরুদ্ধে অনেক গণতান্ত্রিক সরকারকে উৎখাতে সহযোগিতা কিংবা ইন্ধন দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধেও মার্কিন ভূমিকা নিয়ে বেশ বিতর্ক রয়েছে। এমতাবস্থায় দেশের অন্যতম এলিট ফোর্স র্যাবের সিনিয়র কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে মার্কিন সিদ্ধান্ত যে গভীর রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের ফলাফল তা বলার অপেক্ষা রাখে না। দেশের বর্তমান পরিস্থিতি এ বিষয়ে বিশ্লেষণের তাগিদ অনুভব করেই লেখাটি শুরু করলাম।
প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত ‘জিরো টলারেন্স’ নীতির আলোকে বাংলাদেশ এখন জঙ্গি দমনে রোল মডেল। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে র্যাব চরমপন্থি, জঙ্গিবাদ, জলদস্যু ও সন্ত্রাস দমন, অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র ও গোলাবারুদ উদ্ধার এবং চাঞ্চল্যকর হত্যাকাণ্ড আসামি গ্রেপ্তারসহ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় ঈর্ষণীয় ভূমিকা রাখছে র্যাব। সরকারের চরম সাহসিকতা এবং দূরদর্শিতায় জঙ্গিবাদের মূলোৎপাটনের ক্ষেত্রে র্যাবের ভূমিকা অনন্য। বলা যেতে পারে, র্যাব জল, স্থল ও আকাশে অভিযান পরিচালনার সক্ষমতা সম্পন্ন একটি ত্রিমাত্রিক বাহিনীতে পরিণত হয়েছে।
একটা সময় ছিল যখন দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলকে রক্তাক্ত করেছিল চরমপন্থিরা। র্যাব সাধারণ মানুষকে সঙ্গে নিয়ে চরম দৌরাত্ম্য নিয়ন্ত্রণ করেছে। দেশে একটি গোষ্ঠীর ছত্রছায়ায় জঙ্গিবাদের বীজ বপন করা হয়েছিল। তারা এ দেশকে একটি ব্যর্থ রাষ্ট্র হিসেবে পরিণত করতে চেয়েছিল। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট ওই একই গোষ্ঠীর মদদে বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে থামিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছিল। ২০০৫ সালের সিরিজ বোমা হামলা গোটা দেশের মানুষ আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিল। সে সব পরিস্থিতি এখন দেশে আর নেই। এক্ষেত্রে আমরা বর্তমান সরকারের নেতৃত্বে র্যাবের সাহসী ভূমিকার প্রশংসা করতে পারি নিঃসন্দেহে।
বিভিন্ন সময়ে বোমা হামলা চালিয়ে জঙ্গি সংগঠন জেএমবি তাদের শক্তি জানান দেওয়ার পরপরই তাদের দমনের লক্ষ্যে মাঠে নামেন র্যাব সদস্যরা। এরপর গ্রেপ্তার করা হয় জেএমবি প্রধান শায়খ আবদুর রহমান, সিদ্দিকুল ইসলাম ওরফে বাংলাভাই, সামরিক শাখার প্রধান আতাউর রহমান সানিসহ শতশত জঙ্গিকে। এ ছাড়া গুলশানের হলিআর্টিসানে জঙ্গি হামলার পর র্যাব অভিযুক্তদের গ্রেপ্তার করলে আইনের আওতায় আনা সক্ষম হয়। সন্ত্রাসী, জঙ্গি ও মাদকসহ বিভিন্ন অভিযান চালাতে গিয়ে এ পর্যন্ত র্যাবের প্রায় ৩০ জনের বেশি নিজের জীবন উৎসর্গ করেছেন।
র্যাবের এমন হাজারো সাহসিকতার উদাহরণ থাকা সত্ত্বেও হঠাৎ করে এই প্রতিষ্ঠানের কতিপয় কর্তাব্যক্তির উপর একটি দেশের নিষেধাজ্ঞার বিষয়টিকে গভীরভাবে মূল্যায়নের তাগিদ অনুভব করছি। আমরা জানি, অতি সম্প্রতি ইরানে একটি জঙ্গি সংগঠন মসজিদে হামলা চালিয়ে প্রায় ৩০ জনের বেশি মুসল্লিকে হত্যা করেছে। সারা বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন স্থানে এমন নানাবিধ জঙ্গি হামলার ঘটনা প্রায়ই গণমাধ্যম সূত্রে আমাদের চোখে পড়ছে। দীর্ঘদিন থেকে বাংলাদেশে জঙ্গি উত্থানের বিষয়টি সাধারণ মানুষের মাথা থেকে প্রায় চলেই গেছে। কিন্তু আগামী নির্বাচনকেন্দ্রীক রাজনৈতিক উত্তেজনা, বিএনপির অগণতান্ত্রিক হুঁশিয়ারি, নির্বাচন কমিশনে জামায়াত নেতাদের দ্বারা গঠিত বিডিপি নামে নতুন একটি রাজনৈতিক দলের আবেদন, আগামী ১০ ডিসেম্বরের বিএনপির সরকার উৎখাতের আলটিমেটাম প্রভৃতি মিলিয়ে দেশের রাজনীতিতে একটি নতুন পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটতে যাচ্ছে। আর এ সব পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে যেকোনো সময় জঙ্গিগোষ্ঠীসমূহ মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারে। আগামী নির্বাচনে সহিংস পরিস্থিতি সৃষ্টির মাধ্যমে রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের গভীর ষড়যন্ত্র আমাদের সামনে অনকেটা দৃশ্যমান।
তাত্ত্বিকভাবে আমরা জানি, জঙ্গি সংগঠনগুলো সহিংস তৎপরতার জন্য নির্দিষ্ট সময় ও পরিস্থিতি বেছে নেয়, যা নির্ভর করে কোনো দেশের আভ্যন্তরীণ আর্থসামাজিক-রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং জঙ্গিবাদের বৈশ্বিক প্রবণতার উপর। ইতোমধ্যেই জঙ্গিবাদের যে বৈশ্বিক প্রবণতা আমরা লক্ষ্য করছি, তা সত্যিই আমাদের শঙ্কিত করে তুলছে।
স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে জঙ্গিরা সাধারণত প্রচারণা ও কর্মী সংগ্রহের মাধ্যমে সংগঠনের সামর্থ্য বৃদ্ধিতে ব্যস্ত থাকে। এই পর্যায়ে নিবেদিত কিছু কর্মী বাছাই করে তাদের মনস্তাত্ত্বিক ও শারীরিক প্রশিক্ষণের মাধ্যমে কথিত ‘জিহাদের’ জন্য প্রস্তুত করা হয়। অতীতের ঘটনাপ্রবাহ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, রাজনৈতিক অস্থিরতার সময় মূলত এই অপশক্তি তাদের কার্যক্রমের উপযুক্ত সময় হিসেবে বিবেচনা করে।
কাজেই এই পরিস্থিতির মূল্যায়ন করা যায় যে, জঙ্গি নির্মূলে র্যাবের কার্যক্রম মানবাধিকার ইস্যুতে প্রশ্নবিদ্ধ করা কিংবা কোনো রাষ্ট্রের শৃঙ্খলা বাহিনীর উচ্চপদস্থদের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি সাধারণ জনগণের নিরাপত্তার সঙ্গে যেমন সম্পৃক্ত তেমনি দেশে নতুন করে জঙ্গি কার্যক্রমের উত্থানের প্রশ্নটিও সামনে চলে আসে।
সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে সন্ত্রাসী বা জঙ্গি গোষ্ঠীর কোনো বড় কর্মকাণ্ড দেখা যায়নি। আগামীতে বাংলাদেশসহ বিশ্ব একটি কঠিন সময়ের মুখোমুখি হতে পারে। আর সেই পরিস্থিতির সুযোগে জঙ্গি গোষ্ঠীগুলো বিশ্বব্যাপী তাদের কার্যক্রমে সক্রিয় হয়ে উঠতে পারে। বিশেষত জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কোনো ধরনের রাজনৈতিক টানাপোড়েন, দোষারোপ, নিষেধাজ্ঞা কোনোটিই স্থিতিশীল পরিস্থিতি বজায় রাখার লক্ষণ নয়। কাজেই বাংলাদেশের বিভিন্ন বাহিনীর উপর আন্তর্জাতিক নানা ধরনের নিষেধাজ্ঞা এবং নতুনভাবে তেমন কোনো পরিবেশ সৃষ্টির ষড়যন্ত্র কিংবা সম্ভাবনা তৈরির সব অপশক্তিতে যথাযথভাবে মোকাবিলা করার ক্ষেত্রে দূরদর্শী অবস্থানে থাকার চেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে সবাইকেই।
লেখক: অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
আরএ/