বাজারদর তদারকি জোরদারে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা কি বাস্তবায়ন হবে?
সম্প্রতি জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিত্যপণ্যের বাজারদর বিশেষ করে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সংশ্লিষ্টদের বাজার তদারকি বা নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা আরও জোরদার করার নির্দেশ দিয়েছেন। দেশের শাসন ব্যবস্থায় এখন সবকিছুই প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্ঠিগোছর ছাড়া হয় না। যদিও প্রশাসনিক কর্মবণ্টন ব্যবস্থায় সবকিছু উল্লেখ আছে। তারপরও প্রধানমন্ত্রীর অনুশাসনের জন্য অপেক্ষা। করোনা, ইউত্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে সাম্প্রতিক সময়ে গোটা বিশ্বের অর্থনীতি ও বাজারব্যবস্থা টালমাটাল।
বাংলাদেশে সবকিছু বিশ্ব বাজারের উপর নির্ভরশীল না হলেও বাংলাদেশের পরিস্থিস্থিকেও আমাদের ব্যবসায়ীরা সে পর্যায়ে নিয়ে গেছে। ফলে নিত্যপণ্য মূল্যের ঊর্ধ্বগতির আগুনে পুড়তেই হচ্ছে সাধারণ মানুষকে। দেশের মানুষের খাদ্য নিরাপত্তার প্রধান উপকরণ চালের বাজার দীর্ঘ সময় ধরেই অস্থির। দরিদ্র ও সাধারণ মানুষের খাদ্য নিরাপত্তায় বহুল ব্যবহৃত আরেক খাদ্যপণ্য আটার একই অবস্থা। অধিকন্তু এ দুটি খাদ্যেপণ্যের দাম কোনোভাবেই কমছে না। বরং উল্টো বেড়েই চলেছে। ফলে প্রান্তিক ও সাধারণ আয়ের মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা ও জীবন-জীবিকা নির্বাহ করা দিন দিন কঠিন হয়ে উঠছে। খাদ্য পণ্যের অস্থির মূল্য ঠেকাতে মানুষকে আহার কাটছাঁট করতে বাধ্য হচ্ছেন। অনেকে একবেলা খেয়ে চলছে। তারপরও স্বস্তির খবর হলো ধানের উৎপাদন ভালো হয়েছে। সরকার নিজে খাদ্য আমদানি করেছে, বেসরকারিভাবে আমদানির অনুমতি প্রদান করায় খাদ্য মজুতও যথেষ্ট পরিমাণে আছে ফলে কোনো ঘাটতি হওয়ার কথা নয়; তবু চাল কিনতে সাধারণ মানুষকে হিমশিম খেতে হচ্ছে। সংকটের নেপথ্যে উৎপাদন ও মজুত নিয়ে সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরের সঠিক তথ্যের ঘাটতি। হয়তো বাড়তি পরিসংখ্যান দেখাচ্ছে অথবা বাজারে সিন্ডিকেট করে এই অস্থিরতা দীর্ঘায়িত করা হচ্ছে।
করোনা লকডাউন পরবর্তী সময় থেকে আমাদের ব্যবসায়ীরা পরিবহন ভাড়া বৃদ্ধি, বিশেষ করে জাহাজ ভাড়া বৃদ্ধির অজুহাতে দাম বাড়ানো শুরু করেন। এরপর আসলো ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ ও আর্ন্তজাতিক বাজারে যুদ্ধের কারণে সবগুলো নিত্যপণ্যের দামবৃদ্ধির অজুহাত। আর এ অজুহাতে আরেক দফা দাম বাড়ানো শুরু হয়। সর্বশেষ পর্যায়ে ডলারের দামবৃদ্ধি এবং দেশে জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির অজুহাতে দাম আরেক দফা বাড়ানো শুরু করেন। কিন্তু রাশিয়া-ইউক্রেন থেকে চাল, সয়াবিন ও গম কী পরিমান আমদানি করা হয় তার কোনো সুনির্দিষ্ট পরিসংখ্যান না দিলেও দোহাই দেবার সময় ওটাই সমানে আনেন। আবার লকডাউন পরবর্তী সময়ের জাহাজ ভাড়া এখন অর্ধেকে নেমে আসলেও পণ্যের দাম কমানোর পরিবর্তে নতুন অজুহাতে আরও বাড়ছে। ডলারের দাম ও কাঁচামালের দাম বৃদ্ধির অজুহাতে ১০ টাকার সাবান ১৫ টাকায়, ৫০ টাকার ডিটারজেন্ট পাউডার ১০০ টাকায় বাড়িয়ে দেওয়া কতটুকু যুক্তিসংগত তার সুনির্দিষ্ট জবাব কসমেটিক উৎপাদনকারী কোম্পানির প্রতিনিধিরা জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষন অধিদপ্তরের গণশুনানিতে দিতে ব্যর্থ হলেও দাম বাড়াতে দেশি-বিদেশি সবগুলো কোম্পানি প্রতিযোগিতা করে দাম বাড়াতে ব্যস্ত। আবার সয়াবিন তেলের দাম বৃদ্ধির অজুহাতে দেশে উৎপাদিত সরিষার তেলের দামও দ্বিগুণ। ব্যবসায়ীরা সুযোগকে হাতছাড়া করতে চান না। কয়েকদিন আগে দেশব্যাপী ব্ল্যাকআউটের সময় ঢাকায় ১০ টাকার মোমবাতি ঘণ্টার মধ্যেই ৩০-৫০ টাকায় ঠেকেছিল। বিদ্যুত সংকটের কথা শুনে ২০০ টাকার এনার্জি বাল্ব এখন ৫ শত-৬ শত টাকায়। ১৫ শত টাকার চার্জার ফ্যান ৩ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাবেও বাজারে নিত্যপণ্যের অস্থিরতার প্রমাণ পাওয়া যায়। আগস্ট ও সেপ্টেম্বরে মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে। আগস্টে মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৯ দশমিক ৮৬ শতাংশ। সেপ্টেম্বরে তা ৯ শতাংশের বেশি রয়েছে। তবে এ দুই মাসে খাদ্যপণ্যে মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশের বেশি রয়েছে। গবেষণা সংস্থা সিপিডি ইতোপূর্বে বলছে, মূল্যস্ফীতির ধাক্কায় চাপে পড়েছে গরিব মানুষ আর এ অবস্থায় তাই নিত্যপণ্যের উচ্চমূল্য নিয়ন্ত্রণ করাই বাংলাদেশের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ। তবে শুধু বাংলাদেশই নয়। গত এক যুগের মধ্যে পুরো বিশ্বই এখন সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতির সামনে আছে। আর বৈশ্বিক মূল্যস্ফীতি ও জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়ার কারণ হিসেবে প্রধানত করোনা মহামারির প্রভাব, ইউক্রেন যুদ্ধ, জ্বালানি তেলের উচ্চমূল্য, পরিবহন খরচ, ডলারের বিনিময় হার ব্যাপক বেড়ে যাওয়াকে দায়ী করা হচ্ছে। আর এসবের ব্যাপক প্রভাবে গরম হয়ে গেছে বাংলাদেশের নিত্যপণ্যের বাজার। বিষয়টি আচ করবার জন্য সাশ্রয়ী মূল্যে টিসিবির খাদ্যপণ্য বিক্রি ও খোলা বাজারে চাল বিক্রির ট্রাকের সামনে দাড়ালেই অনুমেয়। সবশ্রেণি পেশার মানুষ র্দীঘলাইন দিয়ে চাল কিনতে বাধ্য হচ্ছেন।
অর্থনীতিবিদদের মতে, বিদেশ থেকে আমদানিকৃত পণ্য ও দেশে অভ্যন্তরীণ উৎসে উৎপাদিত পণ্যের দাম বেড়ে সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাস উঠেছে। অনেক মানুষ বাধ্য হয়ে পণ্য ব্যবহার কমিয়েছে। চাল, ডাল, তেল, চিনিসহ নিত্যপণ্যের ব্যবহার কমিয়েছেন। ফলে প্রান্তিক ও সাধারণ আয়ের মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা ও জীবনজীবিকা নির্বাহ করা দিনদিন কঠিন হয়ে উঠছে। খাদ্যপণ্যের অস্থির মূল্য ঠেকাতে মানুষকে আহার কাটছাঁট করতে হচ্ছে। অনেকে একবেলা খেয়ে চলছে। যা পুষ্ঠিহীনতাসহ কর্মক্ষমতা হ্রাসের দীর্ঘমেয়াদী নেতিবাচক প্রভাব হতে পারে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিত্য পণ্যের দাম সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতায় রাখতে চেষ্টা চালানোর কথা বলেছেন। আসন্ন ২০২৩ সালে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক দুরবস্থা আরও বাড়তে পারে এমন আশঙ্কা প্রকাশ করে সরকারপ্রধান দেশবাসীকে সঞ্চয়ী মানসিকতা গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়েছেন। অতি স্বল্প সময়ে ফল পাওয়া যাবে এবং অধিক প্রয়োজন রয়েছে-এমন কল্যাণমূলক প্রকল্প গ্রহণ করার কথা বলেছেন। ২০২৩ সাল বিশ্বের জন্য ‘সবথেকে ঝুঁকিপূর্ণ একটা বছর; হতে পারে মন্তব্য করে ওই সময়ে দুর্ভিক্ষ ও খাদ্য সংকট দেখা দিতে পারে বলে মন্তব্য করেন। সেই কথাটা মাথায় রেখে আমাদেরকে এখন থেকেই খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি করা এবং খাদ্য সংরক্ষণের কী ব্যবস্থা করা যেতে পারে বা প্রক্রিয়াজাত করা যেতে পারে সেদিকে আমাদের বিশেষভাবে দৃষ্টি দিতে হবে।
নিত্যপণ্যের বাজার দর নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর উদ্বেগ এবং একে সাধারণের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে নিয়ে আসার যে নির্দেশনা দিয়েছেন, তা সময়োপযোগী ও বাস্তবসম্মত। আমরা বিশ্বাস করতে চাই। প্রধানমন্ত্রীর এ নির্দেশনা বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, অধিদপ্তর, স্থানীয় প্রশাসনগুলো আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করবে। এটা ভুলে গেলে চলবে না, সরকারের প্রধান শক্তি জনগণ। সরকারের যেকোনো উদ্যোগ জনগণকে সম্পৃক্ত করেই গ্রহণ করা হয়। জনগণ ভালো থাকলে সরকারও ভালো থাকে। বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তা ভালোভাবেই জানেন। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ বাস্তবায়নসহ সরকারের গৃহীত উদ্যোগগুলো বাস্তবায়িত হলে বাজারে অস্থিরতার তাৎক্ষণিক সমাধান হয়তো মিলবে। তবে মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদে খাদ্য সংকট এবং বাজার কারসাজি সমস্যার সমাধানে প্রয়োজন দেশীয় খাদ্য উৎপাদন বাড়ানো। পাশাপাশি সংকট সামাল দিতে বাজার নিয়ন্ত্রণ জরুরি।
নিত্যপণ্যের বাজার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা এখন খুবই দরকার। বিশেষজ্ঞদের মতে, চাল, আটা, সয়াবিন তেলসহ নিত্যপণ্যের দাম অস্বাভাবিক হওয়ার পেছনে শুধুমাত্র এককভাবে আন্তর্জাতিক বাজারমূল্য বৃদ্ধি দায়ী নয়। এক শ্রেণির ব্যবসায়ী সংকটময় পরিস্থিতিকে পুঁজি করে অতি মুনাফালাভের মনোবৃত্তির কারণে তারা নিজেরা সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ করে বাজার অস্থির করছেন। সরকারের নীতিনির্ধারকদের কেউ কেউ অতি মুনাফার বিরুদ্ধে কথা বলছেন। তবে অতিমুনাফাকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ অজানা কারণে সম্ভব না হওয়ায় নিত্যপণ্য নিয়ে এই অস্থিরতা প্রলম্বিত হচ্ছে মাসের পর মাস। আর চক্রাকারে সবগুলো খাদ্যপণ্যে এ অশুভ চর্চাটির সামাজিক সংক্রমণ ঘটেছে। ফলে দাম নিয়ে ক্রেতাদের মাঝে হাপিত্যেশ থাকলেও সমাধানের পথে কেউ হাটছে না। তবে পণ্যমূল্য যাতে সাধারণ ভোক্তাদের সাধ্যের মধ্যে থাকে তার জন্য সরকারকে প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা নিতে হবে। তবে টিসিবির মাধ্যমে বর্তমান চলমান ফ্যামিলি কার্ডের আওতায় চাল, আলু ও দেশি পেঁয়াজ বিক্রির ব্যবস্থা করা গেলে কৃষক ও ভোক্তারা অনেক বেশি উপকৃত হতেন। একইসঙ্গে টিসিবির আওতায় বিক্রি হওয়া খাদ্যপণ্য সংগ্রেহে স্থানীয় উৎস থেকে সংগ্রহ করার নীতির পরিবর্তে আর্ন্তজাতিক উৎস থেকে সরকার টু সরকার পর্যায়ে সংগ্রহ করার নীতি চালু করা দরকার।সরকারকে জেলা প্রশাসন, খাদ্য, কৃষি, প্রাণিসম্পাদ ও ভোক্তা অধিদপ্তরের সমন্বিত বাজার তদারকি জোরদার, উৎস স্থল, মিলমালিক ও উৎপাদক পর্যায়ে বাজার তদারকি নিশ্চিত করার পাশাপাশি বাজারসংক্রান্ত নীতিনির্ধারণে ব্যবসায়ীদের পাশাপাশি ভোক্তাদের সমঅংশগ্রহণ ও মর্যদা নিশ্চিত করতে হবে। প্রধানমন্ত্রীর নিত্যপণ্যের বাজার তদারকি বা নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা আরও জোরদার করার যে নির্দেশনা দিয়েছেন। তা সরকারের অন্যান্য নির্দেশনার মতো রুটিন নির্দেশনা হিসেবে বিবেচনা না করে অীত জনগুরুত্বপূর্ণ অগ্রাধিকারভাবে বাস্তবায়নে সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্বপালনে সদিচ্ছা ও আন্তরিকতার প্রতিফলন ঘটাতে হবে। তাহলেই বিশ্বব্যাপী আর্থিক মন্দা ও খাদ্য ঘাটতির মতো কঠিন বাস্তবতা থেকে আমরা রেহাই পাব।
লেখক: এস এম নাজের হোসাইন, ভাইস প্রেসিডেন্ট, কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) ই-মেইল: cabbd.nazer@gmail.com