সরকারি কর্মকর্তাদের বাধ্যতামূলক অবসর ও জনগণের সেবাপ্রাপ্তি
তথ্য সচিবকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়েছে, এতে প্রশাসনে নাড়াচাড়া পড়ে গেছে। কেউ কেউ বলছেন, সচিবের প্রকৃত দোষ সরকারের প্রকাশ করা উচিত আর তা না হলে প্রশাসনে ভুল বার্তা যেতে পারে। দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের মধ্যে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয় একটি। স্বাভাবিক অবসরের এক বছরের কম সময়ের আগে এই মন্ত্রণালয়ের সচিবকে অবসরে পাঠানো হলো।
সরকারের এই সিদ্ধান্ত ইতিবাচক ফল দেবে না বলেও কেউ কেউ মন্তব্য করেছেন। পঁচিশ বছর পূর্তিতে বাধ্যতামূলক অবসরে দেওয়ার ক্ষেত্রে সরকারের ক্ষমতাকে অগণতান্ত্রিক ও কালাকানুন বলেও অভিহিত করেছেন। সচিব বা যে পর্যায়ের কর্মকর্তাই হোন না কেন, যিনি যে দোষে দুষ্ট সেটি প্রকাশ করা উচিত। সুনির্দিষ্ট ও যৌক্তিক কারণ না থাকলে বাধ্যতামূলক অবসরের ঘটনায় কর্মকর্তাদের মধ্যে ভয়ের সংস্কৃতি তৈরি হয়। বিভিন্ন স্তরের কর্মকর্তারা রীতিমতো স্তম্ভিত। আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দেওয়া দরকার। এ ধরনের বিধানের বিরুদ্ধে রিট করা দরকার। এ ধরনের মন্তব্যও করেছেন অনেকে। কিন্তু সরকারি কর্মকর্তা বা কর্মচারী সবাই প্রজাতন্ত্রের সেবক। তারা জনগণের কথা শুনবেন, জনগণের জন্য কাজ করবেন। তারা আলাদা কোনো এনটিটি নয় যেটি আমাদের দেশে দেখা যায়।
জগনগণের প্রতিনিধিরা জনগণের জন্য, রাষ্ট্রের কল্যাণের জন্য সরকারি কর্মকর্তাদের আইনের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করবেন। সরকার পরিচালনায় যারাই থাকুক, সেটি সরকারি কর্মকর্তাদের বিষয় নয়। তাদের বিষয় হচ্ছে সরকারে যারা আছেন, প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তা ও কর্মচারী হিসেবে সরকারের কথা, সরকারের নির্দেশ মেনে চলা, প্রকল্প বাস্তবায়ন করা। তা না হলে ‘চেইন অব কমান্ড’ ভেঙে যায়। আমরা চেইন অব কমান্ড ভাঙার উদাহরণ অহরহ দেখছি। কয়েকদিন আগে একটি রাজনৈতিক সমাবেশের মতো একজন নির্বাচন কমিশনারকে (যার প্রটোকল সচিবেরও উপরে) মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তারা যেভাবে তার বক্তব্য থামিয়ে দিয়েছেন, তাকে বসতে বলেছেন তাতে শক্তিশালী চেইন অব কমান্ড আছে কিনা সন্দেহ হচ্ছে। তাই, একজন সচিবকে বাধ্যতামূলক অবসরে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় যারাই থাকুক প্রজাতন্ত্রের সুবিধার্থে এ ধরনের সিদ্ধান্ত নিতে পারে। এটি যদি জনসমক্ষে ব্যাখ্যা করতে যায়, সেটি প্রশাসনে বিভক্তি তৈরি করবে। অনেকেই যে বলছেন বিষয়টির ব্যাখ্যা দেওয়া উচিত, সেটি বোধ হয় আরও সমস্যা বাড়াতে পারে।
সরকারি কর্মকর্তারা জনপ্রতিনিধিদের যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করবেন- বেশিও না, কমও নয়। একেবারে ‘হুজুর হুজুর’ করবেন সেটিও যেমন কাম্য নয়, তেমনি দেখে না দেখার ভান করবেন, যে মন্ত্রীর দাপট বেশি তাকে দেখে অস্থির হয়ে পড়বেন আর যার কোনো তেমন দাপট নেই তাকে পাত্তাই দেবেন না সেটি হতে পারে না। কয়েক মাস আগে আমি একজন অতিরিক্ত সচিব (কোনো এক অধিদপ্তরের ডিজির দায়িত্বে আছেন) এর কক্ষে ছিলাম, ওই সময়ে একজন মন্ত্রী এলেন অথচ ওই অতিরিক্ত সচিব দাঁড়ালেন না, শুধু বললেন, বসেন স্যার। এটি আমার কাছে বেখাপ্পা মনে হলো।
মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সাবেক সচিব আলী ইমাম মজুমদার বলেছেন, স্বাধীনতার পর থেকেই একটা আইন ছিল। রাষ্ট্রপতির আদেশ বলে যে কাউকে অবসরে পাঠানোর ক্ষমতা ছিল সরকারের। তারপর ১৯৭৪সালে সরকারি কর্মচারীদের আইনে এই বিধান ছিল। ২০১৮ সালে সরকারি কর্মচারী আইন যখন হয় সেই আইনেও ৪৫ ধারায় সেটা যুক্ত করা হয়। সরকারের এই ক্ষমতা আছে এবং সেটিও এখানে প্রয়োগ করা হয়েছে। এই ক্ষমতার বিরুদ্ধে, একপক্ষীয় আদেশের বিরুদ্ধে সংক্ষুদ্ধ ব্যক্তি চাইলে একমাত্র হাইকোর্টে যেতে পারেন। এ পর্যন্ত যারা উচ্চ আদালেত গিয়েছেন সরকারের এসব আদেশের বিরুদ্ধে সেখানে কোথাও সরকার জয়যুক্ত হয়নি। আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দেওয়া ছাড়া শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া ঠিক না। তিনি বলেন আইনটি প্রশ্নবিদ্ধ, সরকার চাইলে এটি সংশোধন করতে পারে। যেকোনো আইনই মানুষের জন্য, দেশের কল্যাণের জন্য। কোনো আইনে যদি কোনো প্রশ্ন থাকে তাহলে সংশ্লিষ্টদের সেটিকে সংশোধন করার চেষ্টা করা উচিত। তবে, সরকারি কর্মকর্তা আর জনপ্রতিনিধিদের মধ্যে যদি মামলা নিয়ে দৌড়াদৌড়ি করতে হয় সেটিও সুখকর বিষয় নয়। তারা প্রজাতন্ত্রের কাজ করবেন কখন? এমনিতেই সরকারি অফিসে জনগণের সেবার মান দিনে দিনে কঠিন হচ্ছে, কমে যাচ্ছে।
নির্বাচন কমিশন একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান। এখানে যেসব কর্মকর্তারা আসেন তারা প্রশাসন, বিচার বিভাগ, অবসরপ্রাপ্ত সেনা অফিসার- যেখান থেকেই আসুক না কেন মাঠ পর্যায়ের পুরো প্রশাসনের উচিত তাদের সম্মান করা। এখানেও দেখা যায় তার ব্যত্যয় ঘটে। শুধুমাত্র লাইন ম্যানেজমেন্টে যারা থাকেন তাদের দেখলে স্যার, স্যার বলা শুরু হয় আর তার বাইরের সবাইকে যেন নামমাত্র সম্মান প্রদর্শনের বিষয়টি বিষয়টিও দৃষ্টিকটু লাগে। প্রজাতন্ত্রের সবাই এ দেশের কল্যাণের জন্য কাজ করবেন এটিই তো স্বাভাবিক। এই কাজ করার জন্য কিছু নিয়ম-কানুন দেশই তৈরি করে যা সবার শ্রদ্ধা করা উচিত, মেনে চলা উচিত। প্রতিপক্ষ মনে করা, আইনের মার-প্যাঁচ দিয়ে এক বিভাগকে হেয় করার প্রতিযোগিতা আপাতত কারুর পক্ষে কাজ করতে পারে কিন্তু তার ফল পুরো জাতির জন্যই উল্টো হয়। আজ দেখা যাচ্ছে অধিকাংশ জায়গায় প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধির মধ্যে খুব ভালো সম্পর্ক নেই, শ্রদ্ধা তো দূরের কথা।
প্রশাসনের মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের আচার-আচরণ অনুকরণীয় হতে হয় আর এজন্য পাকিস্তান আমলে সিভিল সার্ভিসে যারা যোগদান করতেন তাদের মেধা, দক্ষতা, আচরণ সবই ছিল আলাদা। আর এখন একজন কর্মকর্তা উপস্থিত জনতার সামনে আবেগে খেলার ট্রফি ভেঙে ফেলেছেন। এ কেমন আচরণ? কী প্রশিক্ষণ তাদের দেওয়া হয়েছে? কেউ কেউ জনগণের গায়ে হাত তুলছেন আবার বাঘা জনপ্রতিনিধির সামনে বিড়ালের মতো আচরণ করছেন, এ কী? এ দেশ তো সবার। সবাই সবাইকে সম্মান করবেন, জনগণের জন্য, দেশের জন্য কাজ করবেন। তাতেই সম্মান। কে বড় কে ছোট, কে কোন পজিশনে কাজ করছে সেই অনুযায়ী আচরণ করা অন্তত সরকারি কর্মকর্তাদের ক্ষেত্রে বেমানান মনে হয়।
আর একটি দৈনিকে দেখলাম, বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হচ্ছেছ আরও পাঁচ সচিবকে। সরকারবিরোধী ষড়যন্ত্রে জড়িত থাকার আভিযোগ পাওয়া গেছে তাদের বিরুদ্ধে। শুধু সচিব নন, কয়েকজন অতিরিক্ত সচিবও আছেন এই ষড়যন্ত্রে। সব মিলিয়ে সংখ্যাটি নাকি ১২। একটি গোয়েন্দা সংস্থা এই বার জনের দৈনন্দিন চলাফেরা, মোবাইল ফোনে যোগাযোগসহ দেশে-বিদেশে তাদের কার্যক্রম পর্যবক্ষেণ করে বিস্তারিত রিপোর্ট দিয়েছে। যতটা জানা যায় যে, পদোন্নতি বঞ্চিত কয়েক জন কর্মকর্তা সরকারবিরোধী কার্যক্রমে জড়িয়ে পড়েন যাদের তথ্য গোয়েন্দা সংস্থার হাতে কিছু রিপোর্ট এসেছে।
আমাদের মনে আছে ২০১৪সালে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সনদ নেওয়ার কারণে পাঁচ সচিবকে একসঙ্গে বাধ্যতামূলখ অবসরে পাঠিয়েছিল সরকার। এটি তো যেকোনো সরকারকে করতেই হবে। এ কেমন সচিব? দেশের একটি পুরো মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে যারা থাকেন, তাদের যদি ভুয়া সার্টিফিকেট বহন করতে হয় তাহলে অবস্থা কোথায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে? এসব বড় পজিশনে যদিও রাজনীতির কিছুটা গন্ধ থাকে তারপরেও তারা তো জি হুজুর হবেন না বা তেল মেরে সচিব হবেন না, তারা সচিব হবেন তাদের কর্মের মাধ্যমে, দক্ষতার মাধ্যমে। সেটি দেশের জন্য এবং সরকারের জন্য লাভ। জি হুজুর মার্কা সচিব যদিও মনে হয় অনেক আজ্ঞাবহ তাদের দ্বারা কেউই কিন্তু উপকৃত হয় না, উপকৃত হন তিনি নিজে। বর্তমানে কোনো প্রশাসনিক কর্মকর্তার সঙ্গে আলাপ হলেই এ ধরনের কথা শোনা যায় যে বিষয়টি আগে ছিল না।
প্রশাসন বিশেষজ্ঞ সালাহউদ্দীন এম অমিনুজ্জামান যথার্থই বলেছেন, একজন দক্ষ পেশাজীবী আমলা নৈতিকভাবে ও আইনগতভাবেও দলীয়করণের প্রক্রিয়ায় পা বাড়াতে পারেন না। তিনি প্রজাতন্ত্রের কর্মী, দলের নন। তবে এটা মেনে নিতে হবে যে, গণতান্ত্রিক সমাজে নির্বাচত সরকারের অনুগত হয়ে তাদের কাজকর্ম করতে হয়। শুধু আইনি ব্যত্যয় হলে তারা সংশ্লিষ্ট বিষয়ে তাদের দ্বিমত পোষণ করতে পারেন। এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, দলীয়করণও স্বজনতোষণের প্রক্রিয়া কোনোভাবেই সরকারের দক্ষতা বা ইমেজ বাড়ায় না। ইদানিং আমলাতন্ত্রের ’ইমেজ সংকট’ এর পেছনে দলীয় পরিচয় একটা প্রধান কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
অভিযোগ উঠেছে, দলীয় সহমর্মিতা কিংবা আনুগত্য না থাকলে দক্ষতা ও যোগ্যতায় পদোন্নতি হবে, তা নিশ্চিত নয়। এতে সার্বিকভাবে প্রশাসনের দক্ষতা প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশ বিঘ্নিত হচ্ছে- সামগ্রিকভাবে প্রশাসনের দক্ষতা ও যোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। আমরা মনে করি যেকোনো সরকারের আমলেই হোক সরকারি কর্মকর্তাদের রাজনৈতিক বিবেচনায় পদোন্নতি প্রদান, সুবিধা প্রদান কারুর জন্যই মঙ্গল নয়। এতে দেশ কোনোভাবেই উপকৃত হয় না। সরকার জনগণের সেবার জন্য, দেশের জন্য।
আমরা সবাই জানি সরকারের অনেক প্রচেষ্টা সত্ত্বেও সরকারি অফিস-আদালতে জনগণের সেবাপ্রাপ্তি সহজ হয়নি। এটি কীভাবে করা যায় তা নিয়ে জনপ্রতিনিধিসহ সরকারি কর্মকর্তাদের পদ্ধতি বের করতে হবে। সরকারি কর্মসেবায় পদ্ধতিগত অস্বচ্ছতা, কর্ম সম্পাদনের দিন বেঁধে দেওয়ার পর তা না হওয়া, সেবাগ্রহীতা যথাযোগ্য তথ্যাদি সরবারহে গাফিলতি, অতি দ্রুত কাজ করিয়ে নেওয়ার প্রবণতা, দাপ্তরিক দালাল চক্রের ভূমিকা দূর করার দায়িত্ব মূলত সরকারের। সেটি কিন্তু হয়নি। আর এই কাজ জনপ্রতিনিধি একা পারবেন না, সরকারি কর্মকর্তারও একা পারবেন না। এজন্য থাকতে হবে সৎ ও যৌথ প্রয়াস।
লেখক: সাবেক শিক্ষক; ক্যাডেট কলেজ, রাজউক কলেজ ও বাউবি।
এসএন