জ্বালানি সংকট বর্তমানে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ
সারা পৃথিবীতে কোভিড পরবর্তী সময়ে অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের ক্ষেত্রে যে স্থবিরতা ছিল, সেটি কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ শুরু হয়েছে। ফলে অর্থনীতিতে আরেকটি বড় ধরনের চাপের সৃষ্টি হয়েছে।
যেহেতু ডলারের মূল্য আন্তর্জাতিক বাজারে বেশি, ফলে আমাদের কারেন্সি ডেপ্রিসিয়েট করতে হয়েছে। অন্যদিকে আমাদের টাকার অবমূল্যায়ন হয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই টাকার অবমূল্যায়নের কারণে আমদানি খরচ বেড়ে গেছে। রপ্তানি থেকে যে আয় হচ্ছে সেটিও কিছুটা বাড়ছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, যে পণ্যটি আগে ১০ ডলার দিয়ে কেনা হত সেটি টাকায় ৮৫০ টাকা। এখন সেটির মূল্য হয়ে গেছে ১০০০ টাকার উপরে। কাজেই সেই একই জিনিস এখন আমদানি করতে খরচ হচ্ছে ১০০০ টাকার উপরে। আগে যে জিনিসটি আপনি ৮৫০ টাকায় কিনতে পারতেন, এখন সেটি কিনতে খরচ হচ্ছে ১০০০ টাকার বেশি। যেহেতু ডলারের মূল্যমান ইন্টারন্যাশনাল মার্কেটে বেড়ে গেছে কাজেই এখানেও আমরা মূল্যস্ফীতি দেখতে পাচ্ছি।
আমাদের খরচ বেড়ে যাচ্ছে। কোভিডের পরবর্তী সময়ে দুনিয়া জুড়ে অর্থনীতি পুনরুদ্ধার না হতেই ইউক্রেন রাশিয়া যুদ্ধের প্রভাবে সাপ্লাই চেইন যেটিকে বলা হয়, অর্থাৎ যে পণ্যগুলো সেখান থেকে আসত, সেগুলো আসতে পারছে না। এই যে সাপ্লাই চেইন নষ্ট হয়ে যাওয়ার ফলে আমরা যে সংকটের মধ্যে আছি, সেটি মন্দার দিকেও যেতে পারে এবং বাংলাদেশেও তার প্রভাব পড়েছে। অন্যদিকে ডলারের দাম বেড়ে যাওয়া সেটিও অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের একটি বড় কারণ বলতে হবে।
বাংলাদেশের কয়েকটি ইতিবাচক দিক আছে যেটি নিঃসন্দেহে ভাল। যেমন— একটি হলো খাদ্যশস্য, যা আমরা নিজেরাই উৎপাদন করি। চাল আমাদের আমদানি করতে হয় কিছু, তবে খাদ্যে আমরা প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণ বলা যায়। সেটি নিশ্চয়ই একটি ভাল দিক। অর্থনৈতিক সংকট বলতে আমরা কিছুটা চাপের মধ্যে আছি। তবে আমি সেটিকে ঠিক ভারসাম্যহীনতা বলতে চাই না। তবে আমাদের ভবিষ্যতের ব্যাপারে সাবধান থাকতে হবে। আমরা যে চাপের মধ্যে আছি, সেক্ষেত্রে খাদ্য সংকটের ভয় আছে বলে আমি মনে করছি না। আমরা যেহেতু প্রধান খাদ্যদ্রব্য নিজেরা উৎপাদন করছি।
আমাদের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে জ্বালানি সংকট। আমাদের জ্বালানি সাপ্লাইয়ে সমস্যা হচ্ছে। খরচও বেশি হচ্ছে। জ্বালানির দাম বেড়ে গেছে। ফলে পরিবহন, শিল্প কারখানার উৎপাদন ইত্যাদির খরচ কিন্তু বেড়ে গেছে।
বিদ্যুৎ সরবরাহেও আমরা সমস্যা দেখতে পাচ্ছি। সেটিও আসছে জ্বালানি তেল থেকেই। সব মিলিয়েই আমাদের যে সংকট সেই সংকটের জায়গাটি অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি আছে। সাধারণ মানুষ যেহেতু মূল্যস্ফীতির একটি চাপের মুখে আছে, জ্বালানি সংকট সাধারণ মানুষের মধ্যে চাপ আরও বৃদ্ধি করতে পারে। যে কারণে আমাদের দ্রুত জ্বালানি সংকট মোকাবিলা করা উচিত। সেটি মোকাবিলা করতে হলে আমাদের তেলের সরবরাহ ঠিক করতে হবে এবং তা সঠিকভাবে ব্যবহারে মনযোগ দিতে হবে।
আমাদের রেমিট্যান্স বৃদ্ধি কেন হচ্ছে না এই প্রশ্ন আসছে। আমাদের মনে রাখতে হবে কোভিডের পরে মানুষজন ব্যাপকহারে বাইরে যেতে পারছে না। সেটি মাত্র গত ১বছর ধরে যাচ্ছে। তা ছাড়া বিদেশ গিয়েই তো আর মানুষ সঙ্গে সঙ্গে টাকা পাঠায় না। তবে সামনে আমাদের রেমিট্যান্সের পরিমাণ বাড়বে। সেইটুকু সময় পর্যন্ত অর্থাৎরেমিট্যান্স বৃদ্ধি পাওয়া পর্যন্ত এখন যে সংকট আমরা মোকাবিলা করছি, সেজন্য আমাদের কিছুটা স্ট্র্যাটেজিক হতে হবে। অপচয় রোধ করতে হবে।
কোভিডের সময় আমরা হোম অফিস করেছি। এই আপদকালীন সময়ে সপ্তাহে অন্তত একদিন যদি হোম অফিস করা হয়, তাহলে রাস্তাঘাটে জ্বালানির চাহিদা কম হবে। বিভিন্ন ধরনের মিটিংগুলো যেগুলো অনলাইনে করা সম্ভব, সেগুলো অনলাইনে করার জন্য উৎসাহিত করা উচিত। একটি সেমিনার হলে কত মানুষকে মিটিংয়ে যেতে হয়। সেক্ষেত্রে আমাদের স্ট্র্যাটেজিক ইউটিলাইজেশন হতে হবে। আমাদের কৃষি উৎপাদন, শিল্প উৎপাদন যেখানে তেলের সরবরাহ দরকার সেখানে ব্যবহার বাড়াতে হবে।
আগামীতে আমাদের ইকোনোমিক জোনগুলো বাস্তবায়নের দিকে যেতে হবে। আগামীতে যে সময় আসছে, সেক্ষেত্রে ইকোনোমিক জোনগুলোতে কিছুতেই বিদ্যুৎ বন্ধ করা সঠিক হবে না। কাজেই ইকোনোমিক জোনগুলোতে লং টার্মে, মিডিয়াম টার্মে ইকোনোমিক জোনসমূহ বাস্তবায়নে মনযোগ দিতে হবে। যেকোনো অর্থনৈতিক সংকট আমাদের জন্য যেন বিপর্যয় নিয়ে না আসে সেজন্য আমাদের শিল্প উৎপাদন বাড়াতে হবে।
লেখক: অর্থনীতিবিদ
আরএ/