ভোটের বাদ্য ও ইভিএমের খরচ
আন্দোলনের উত্তাপের মধ্যেই চলছে নির্বাচনের আলোচনা। কেমন হবে নির্বাচন, কেমন দেখতে চাই নির্বাচন আর কেমন হয়েছিল নির্বাচন এই আলোচনাকে সামনে নিয়ে আসার প্রচেষ্টা লক্ষ্যনীয়। পরিবর্তনশীল এই বিশ্বে কোনোকিছুই তো আগের মতো হয় না। ফলে নির্বাচন কেন আগের মতো হবে?
২০১৪ সালের নির্বাচনে বিরোধীদল ভোট বর্জনের কারণে ভোটের দিনের আগেই সরকার গঠনের উপযোগী আসনে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ সরকার জয়লাভ করেছিল। তাতে আইন রক্ষা হলেও নির্বাচন তার গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। ক্ষমতাসীনরাও একে নিয়ম রক্ষার নির্বাচন বলেছিলেন। ২০১৮ সালের নির্বাচনে সবাই অংশ নিলেন কিন্তু অভিযোগ উঠল যে ভোটের আগের রাতেই ভোটবাক্স ভর্তি করা হয়েছে।
তাহলে আগামী নির্বাচন কেমন হবে? আগের মতো দৃষ্টিকটু পথে হবে না এটা নিশ্চিত, তাহলে কীভাবে হবে? নির্বাচনের সময় সরকার কেমন থাকবে, প্রশাসন ও পুলিশ কী ভূমিকা পালন করবে, এসব গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা ছাপিয়ে মূল আলোচনা কেন্দ্রীভূত করা হচ্ছে যন্ত্র নিয়ে। যন্ত্রের নাম ইভিএম বা ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন।
নির্বাচন একটি অতি রাজনৈতিক বিষয়। নির্বাচন নিয়ে সংকটটাও রাজনৈতিক। আগামী নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক সংকটকে কি কারিগরি পদ্ধতিতে মোকাবিলা করা হবে? ডিজিটাল সাফল্যের প্রচার করতে করতে সরকার শেষ পর্যন্ত নির্বাচনেও কি ডিজিটাল নির্ভরতা সৃষ্টি করতে যাচ্ছে? এই প্রশ্ন উঠছে বিরোধী শিবিরসহ অনেকেরই মধ্যে। কিন্তু সংকট যখন রাজনৈতিক তখন কারিগরি কৌশল সংকট মোকাবিলায় কতটা কাজে আসবে? আগের দিন বা রাতে এলাকায় থাকতে পারবে কি না, ভোটদানের কক্ষে কার নিয়ন্ত্রণ থাকবে, কেউ আবার বোতাম টেপায় সহায়তা করবে কি না, ভোট গণনার সময় আবার সাময়িকভাবে গণনা বন্ধ থাকবে কি না ইত্যাদি নানা সন্দেহ ঘুরে বেড়ায় বাতাসে। কিন্তু সে সব বিষয় নিয়ে আশ্বস্ত করার চাইতে ইভিএমে ভোট করার ব্যাপারে নির্বাচন কমিশনের দৃঢ় অবস্থান সন্দেহ জাগায়। এমনিতেই ঘর পোড়া গরু তার উপর আবার ইভিএমের সিঁদুরে মেঘ!
নির্বাচন কমিশনের ঘোষণায় ইভিএম নিয়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ উৎসাহ নিয়ে সমর্থন জানালেও শুধু বিরোধী দলসমূহ নয়, নির্বাচন সংক্রান্ত বিশেষজ্ঞ মহলেও যন্ত্রটি নিয়ে ভীষণ আপত্তি রয়েছে। ইভিএম নিয়ে আপত্তির একটা কারণ হলো ইভিএম রিমোট হ্যাকিং করা যায়।
ড. অ্যালেক্স হালডারমেন নামে একজন বিশেষজ্ঞ যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া অঙ্গরাজ্যে ইভিএমের ওপর গবেষণা করে প্রমাণ পেয়েছেন, আমেরিকায় ইভিএম টেম্পারপ্রুফ নয়। পরবর্তীকালে এ কারণে ক্যালিফোর্নিয়া অঙ্গরাজ্যেও ইভিএম ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়। এখন যুক্তরাষ্ট্রের ২২টির বেশি অঙ্গরাজ্যে ইভিএম নিষিদ্ধ। আয়ারল্যান্ড ও নেদারল্যান্ডসও ইভিএম ব্যবহার নিষিদ্ধ করেছে। জার্মানি ও ফিনল্যান্ডে আদালতের নির্দেশে নিষিদ্ধ করা হয়েছে ইভিএম।
যুক্তরাষ্ট্র ১৯৬৪ সাল থেকে ইভিএম ব্যবহার করছে আর ভারত ব্যবহার শুরু করেছে ১৯৮৪ সালে। এই দুই দেশে ইভিএম ব্যবহার নিয়ে এখন বিতর্ক চলছে। পত্রিকায় খবর প্রকাশিত হয়েছে যে, ভারতে ইভিএম জালিয়াতি জেনে যাওয়ার কারণে খুনের মতো ঘটনা ঘটেছে। (ইভিএমের কারচুপি জানায় গোপীনাথ ও গৌরী খুন? ২৪ জানুয়ারি ২০১৯, প্রথম আলো)।
নির্বাচনী পদ্ধতি সংক্রান্ত তথ্য থেকে জানা, পৃথিবীর ৯০ শতাংশ দেশে ইভিএম পদ্ধতি নেই। ২০০৬ সালে আয়ারল্যান্ড ই-ভোটিং পরিত্যাগ করেছে। ২০০৯ সালের মার্চ মাসে জার্মানির ফেডারেল কোর্ট ইভিএমকে অসাংবিধানিক ঘোষণা দেয়। ২০০৯ সালে ফিনল্যান্ডের সুপ্রিম কোর্ট তিনটি মিউনিসিপ্যাল নির্বাচনের ফলাফল অগ্রহণযোগ্য বলে ঘোষণা করেন। উন্নত দেশ, আধুনিক যন্ত্র এবং ডিজিটাল টেকনোলজি ভালোভাবে ব্যবহার করা সত্ত্বেও মূলত, ইভিএম নিয়ে বিতর্ক ও নানাবিধ জটিলতার কারণে এই দেশগুলো ইভিএম ব্যবহার থেকে সরে গেছে। ইভিএম নিয়ে ইউরোপের দেশসমূহের একাধিক পর্যবেক্ষণের কারণেই তারা ইভিএমে জনগণকে ভোট দিতে বাধ্য করছেন না। ফলে আমাদের দেশে ইভিএম চাপিয়ে দেওয়ার প্রবণতার মধ্যে অন্য কোনো উদ্দেশ্য খুঁজে পাওয়া অস্বাভাবিক নয়। এর ফলে নির্বাচন বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করতে পারবে না।
নির্বাচন কমিশন কর্তৃক ১৫০ আসনে ইভিএম ব্যবহারের ঘোষণা এবং ইভিএম কেনার জন্য টাকা বরাদ্দের তৎপরতা নতুন বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। ডলারের রিজার্ভ কমে যাওয়া, আমদানি ব্যয় বেড়ে যাওয়া, বিশ্বব্যাপী নানা সংকটের কথা বলে সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে যখন ব্যয় সংকোচনের কথা বলা হচ্ছে, যখন আইএমএফের কাছ থেকে ঋণ নেওয়ার জন্য দৌড়ঝাঁপ করতে হচ্ছে, তখন নির্বাচন কমিশন (ইসি) জানালেন, আগামী নির্বাচনে ১৫০ আসনে ইভিএমে ভোট করার জন্য মাত্র ৮ হাজার ৭১১ কোটি টাকা দিয়ে ২ লাখ ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) কেনা হবে। তাদের হিসাবে মেশিন-প্রতি দাম পড়বে মাত্র ৪ লাখ ৩৫ হাজার ৫৫০ টাকা। এত দাম আর পেপার অডিট ট্রেইল থাকবে কি না এই সন্দেহ সত্ত্বেও এ যেন টানাটানির সংসারে গাড়ি কেনার পরিকল্পনার মতো।
এর মধ্যেই খবর বের হলো, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে, অর্থাৎ ২০১৮ সালে ইসি ৩ হাজার ৮২৫ কোটি টাকা দিয়ে যে দেড় লাখ ইভিএম কিনেছিল (যার প্রতিটির দাম পড়েছিল ২ লাখ ৫৫ হাজার টাকা) তার ২৮ হাজারই নষ্ট হয়ে পড়ে রয়েছে। বিকল ইভিএমগুলোর ‘ওয়ারেন্টি ডেট’ থাকলেও সেগুলো বিনা খরচে মেরামত করে কাজে লাগানো যাবে কি না তা পরিষ্কার জানা যায়নি এখনো।
এখন ছোট বেলায় শেখা পাটিগণিত অনুযায়ী একটু হিসেব করে দেখা যাক। নতুন ইভিএম কিনতে খরচ হবে ৮ হাজার ৭১১ কোটি টাকা, আগের ইভিএম কিনতে খরচ হয়েছিল ৩ হাজার ৮২৫ কোটি টাকা। তাহলে ইভিএম কেনা বাবদ খরচ দাঁড়ায় ১২ হাজার ৫৩৬ কোটি টাকা। ১ মার্চ নির্বাচন কমিশন জানিয়েছে দেশে মোট ভোটারের সংখ্যা ১১ কোটি ৩২ লাখ ৫৮ হাজার ৩৫১ জন। ৩০০ আসনে এই পরিমাণ ভোটার হলে ১৫০ আসনে তার অর্ধেক হবে। ১৫০ আসনে মোট ভোটারের সংখ্যা প্রায় ৫ কোটি ৬৬ লাখ ২৯ হাজার। তাহলে ইভিএম যন্ত্র বাবদ এই ১৫০ আসনে প্রত্যেক ভোটারের পেছনে খরচ কত হবে, দেখা যাচ্ছে, নির্বাচনে ভোটারপিছু শুধু ইভিএম কেনা বাবদ খরচ হবে ২ হাজার ২১৪ টাকা। এর বাইরে পরিচালনা ব্যয় তো আছেই। এই বিপুল ব্যয় করে বাড়তি হিসেবে আমরা পাব আপত্তি, অসন্তোষ আর আশঙ্কা।
গণতন্ত্রের অন্যতম শর্ত জবাবদিহি আর প্রধান সংকট আস্থাহীনতা। যন্ত্রের চাইতেও জনগণের মনের সংশয় অনেক গুরুত্বপূর্ণ। ফলে এই সংশয় দূর করাটাই নির্বাচনের আগে প্রধান কাজ।
লেখক: সদস্য, কেন্দ্রীয় কমিটি, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ)।
এসএন