সাহসের গল্প: দাসত্বের প্রতিরোধ এবং বর্ণবাদের বিরুদ্ধে ঐক্য
ইউনেস্কোর সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, প্রতি বছর ২৩ আগস্ট দাস বাণিজ্য এবং এর বিলোপের স্মরণে আন্তর্জাতিক দিবস হিসেবে ‘দাস বাণিজ্য স্মরণ ও বিলোপ দিবস’ (International Day for the Remembrance of the Slave Trade and its Abolition) পালিত হয়।
দাসপ্রথা মানব ইতিহাসের এক লজ্জাজনক অধ্যায়। দাসপ্রথা এখন অনেকের কাছে একটা অদ্ভুত ব্যবস্থা মনে হতে পারে কিন্তু একসময় এটা স্বাভাবিক ছিল। এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য ‘সাহসের গল্প: দাসত্বের প্রতিরোধ এবং বর্ণবাদের বিরুদ্ধে ঐক্য’ (Stories of Courage: Resistance to Slavery and Unity against Racism)।
দাস ধনী লোকদের জন্য আভিজাত্যের প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হতো। শিক্ষিত বুদ্ধিজীবীদের ঘরেও মানুষকে দাস হিসেবে রাখা হতো। অবশ্য সবাই এখন দাসপ্রথাকে একটি অমানবিক ব্যবস্থা বলে মনে করে। মানবাধিকারের আন্তর্জাতিক ঘোষণাপত্র সকল মানুষের সমান অধিকারের সমর্থন করে এবং সকল মানুষের স্বাধীনতাকে সমর্থন করে, যা দাসত্বের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। এই দিবসটি দাস বাণিজ্য ও এর বিলুপ্তি হিসেবে স্মরণ করা হয়।
দাস ব্যবসা ইতিহাসের সবচেয়ে খারাপ মানবাধিকার লঙ্ঘনের একটি বিষয় হিসেবে বিবেচিত হয়। প্রায় ৪০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে, ১৮ মিলিয়নেরও বেশি আফ্রিকান পুরুষ, মহিলা এবং শিশু ট্রান্সআটলান্টিক দাস ব্যবসার শিকার হয়েছিল। এই সময়ে, লোকদের তাদের স্থানীয় উপজাতিদের কাছ থেকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল এবং সামান্য বা বিনা বেতনে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত কাজ করতে বাধ্য করা হয়েছিল।
দাস ছিল তার প্রভুর সম্পত্তি। তিনি ক্রীতদাস ব্যক্তিকে বিনা বেতনে কাজ করাতে পারতেন। সে সময় ঋণ থেকে বাঁচতে অনেকেই দাসত্ব গ্রহণ করতে বাধ্য হয়। একজন ক্রীতদাস ব্যক্তির সন্তানকেও দাস হিসেবে গণ্য করা হতো। যুদ্ধে পরাজিত হয়েও প্রায়শই দাসত্ব গ্রহণ করা হতো। সারাজীবন অমানবিক শ্রম দিয়ে মরতে হয়েছে তাদের। তাদের প্রভু তাদের মুক্তি না দিলে দাসত্বের এই চক্র থেকে মুক্তির কোনো উপায় ছিল না।
দাসদের ক্রয়-বিক্রয়ের বাজার বিকশিত হয়েছে ভারতীয় উপমহাদেশসহ বিশ্বব্যাপী। এই বাজারে আফ্রিকান নিগ্রোদের উচ্চ চাহিদা ছিল। তাদেরকে জোর করে ধরে নিয়ে যাওয়া হতো। ক্রীতদাসদের কৃষি ও গৃহস্থালি কাজে ব্যবহার করা হতো। এ ছাড়া উচ্চবিত্তরাও তাদের লালসা চরিতার্থ করার জন্য ক্রীতদাসীকে ব্যবহার করত।
অতীতে বিশ্বের প্রায় সর্বত্রই দাসত্বের প্রচলন ছিল। খ্রিস্টান, ইহুদি এবং ইসলাম তিনটি ধর্মেই দাসপ্রথার উল্লেখ রয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রাচীন সভ্যতায়ও দাসপ্রথা প্রচলিত ছিল। সুমেরীয় ও ব্যাবিলনীয় সভ্যতায় দাসপ্রথা প্রচলিত ছিল। মিশরীয়দেরও অনেক ক্রীতদাস ছিল, যার মধ্যে ছিল ইহুদি, ইউরোপীয় এবং ইথিওপিয়ান ক্রীতদাস। গ্রীক এবং রোমানরা ক্রীতদাসদেরকে চাকর, সৈনিক এবং সরকারি কাজে ব্যবহার করত।
এটি ছিল একটি অভূতপূর্ব গণ মানব পাচার, অপমানজনক অর্থনৈতিক লেনদেন এবং অকথ্য মানবাধিকার লঙ্ঘন দ্বারা চিহ্নিত একটি ঘটনা। দাস ব্যবসার ইতিহাস পাঠ করলে এর প্রকৃত বর্বরতা জানা যায়। তথ্য ও পরিসংখ্যান বাদেও এর পেছনে রয়েছে লাখ লাখ মানুষের বেদনার গল্প। স্বদেশ ও পরিবার থেকে যারা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিলেন তাদের গল্প। যারা তাদের অত্যাচারীদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিল তাদের গল্প। যারা সব প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে জয়লাভ করে তাদের স্বাধীনতা অর্জন করেছে তাদের গল্প।
সেই ধারা আজও অব্যাহত রয়েছে কারণ সারা বিশ্বের মানুষ এখন বর্ণবৈষম্যের বিরুদ্ধে একসঙ্গে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে যা ট্রান্সআটলান্টিক দাস ব্যবসার সবচেয়ে স্থায়ী উত্তরাধিকার। দাস বাণিজ্য ও এর বিলোপের স্মরণে আন্তর্জাতিক দিবস হিসেবে এই দিনে শুধু দাসত্বের ভয়াবহতা স্মরণ করা এবং এর শিকারদের সম্মান জানানোর জন্য নয়; এটি আজকের বিশ্বে দাসপ্রথা থেকে সৃষ্ট বর্ণবাদ ব্যবস্থার সম্পূর্ণ বিলুপ্তি নিশ্চিত করার জন্যও কাজ করছে।
জাতিসংঘের সেক্রেটারি-জেনারেল আন্তোনিও গুতেরেস দিনটিকে চিহ্নিত করার জন্য একটি বার্তা প্রদান করেছেন। তিনি উল্লেখ করেছেন, ‘আমরা ট্রান্সআটলান্টিক দাস বাণিজ্য সম্পর্কে অনেক কিছু জানি। আজ এমন একটি দিন যা আমরা স্মরণ করি-মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ, নজিরবিহীন গণ মানব পাচার, জঘন্য অর্থনৈতিক লেনদেন এবং অকথ্য মানবাধিকার লঙ্ঘন হিসাবে’।
কিন্তু এমন অনেক কিছু আছে যা আমরা জানি না তাহলো দাস বাণিজ্য সম্পর্কিত তথ্য এবং পরিসংখ্যানের পিছনে রয়েছে লক্ষ লক্ষ মানুষের গল্প-অব্যক্ত কষ্ট এবং বেদনার গল্প। ছিন্নভিন্ন পরিবার এবং সম্প্রদায়ের গল্প । সেইসঙ্গে অত্যাচারীদের নিষ্ঠুরতার বিরুদ্ধে বিস্ময়কর সাহস এবং অবাধ্যতার একটি গল্পও। আমরা কখনই জানব না যে প্রতিরোধের প্রতিটি কাজ - বড় বা ছোট - কীভাবে ধীরে ধীরে কিন্তু নিশ্চিতভাবে অন্যায়, নিপীড়ণ এবং দাসত্বের উপর জয়লাভ করেছে।
জন্মভূমি এবং সম্প্রদায় থেকে বিচ্ছিন্ন লক্ষ লক্ষ আফ্রিকানদের শ্রদ্ধা জানাতে এবং সর্বত্র বর্ণবাদের বিরুদ্ধে সংহতি প্রকাশ ও রুখে দাঁড়াতে আমাদেরকে একত্রিত হতে হবে। আজ, মানুষ ক্রমাগত জাতিগত বৈষম্য, প্রান্তিকতা এবং বর্জনের সম্মুখীন। ঔপনিবেশিক শাসন, দাসপ্রথা ও শোষণের মূলে থাকা রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও কাঠামোগত ক্ষমতার ভারসাম্যহীনতা এখনো সুযোগ ও ন্যায়বিচারের সমতাকে অস্বীকার করে।
আসুন আমরা বর্ণবাদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হই এবং একসঙ্গে মর্যাদা, সাম্য ও সংহতির ভিত্তিতে সমাজ গড়ে তুলি। দাসপ্রথা সত্যিই একটি খারাপ ব্যবস্থা ছিল। যদিও ইতিহাসের এই অন্ধকার অংশটিকে একটি অন্ধকার কোণে ঠেলে দিতে আমাদেরকে প্রলুব্ধ করে, তবে আমাদের স্বীকার করতে হবে যে এটি ঘটেছে এবং এর ক্ষতিপূরণের জন্য কাজ করতে হবে। কালো মানুষ ঐতিহাসিকভাবে প্রান্তিক এবং নিপীড়িত হয়েছে, এবং এই দিনটি পালন করা আমাদের মনে রাখতে সাহায্য করে কেন আমাদের নিজেদেরকে সংশোধন করতে হবে।
অতীতের অনেক কিছুই ভবিষ্যতে আমাদের সাহায্য করতে পারে। যখন আমরা দাস বাণিজ্যের মতো জঘন্য ঘটনার দিকে তাকায় তখন তা আমাদেরকে এটিকে পুনরায় ঘটতে না দেওয়ার জন্য ব্যবস্থা নেওয়ার পথ বাতলে দেয়। আমরা যতই উপেক্ষা বা অস্বীকার করার চেষ্টা করি না কেন, জাতিগত অবিচার এবং বর্ণ বৈষম্য আজও বিদ্যমান। এই দিনটি বর্ণবাদকে অবাধে চলতে দেওয়ার বিপদ সম্পর্কে সচেতনতা বাড়ায় এবং যেখানেই আমরা এটি দেখি সেখানেই এর বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়”।
স্মরণ করা যেতে পারে যে, ইতিহাসের সবচেয়ে জঘন্য ব্যবসা হিসেবে দাস ব্যবসাকে বর্ণনা করা হয়েছে। বিভিন্ন দার্শনিক, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, অর্থনীতিবিদ, সমাজবিজ্ঞানী, কবি, সাহিত্যিক, শিল্পী ও চলচ্চিত্র নির্মাতা দাস ব্যবসায়কে তাদের লেখনির মাধ্যম তুলে ধরেছেন ও চলচ্চিত্রে রূপ দিয়েছেন। যা পড়ে ও দেখে আমাদের গা শিউরে উঠেছে। মনে দানা বেঁধেছে ক্রোধ ও ক্ষোভ।
উল্লেখ্য, ১৭৯১ সালের ২২ এবং ২৩ আগস্ট রাতে, বর্তমান হাইতি এবং ডোমিনিকান প্রজাতন্ত্রে যে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে তা মানব সভ্যতাকে দাসপ্রথা বিলুপ্তির পথে নিয়ে যায়। এর পর পর্যায়ক্রমে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ ও অঞ্চল থেকে দাসপ্রথা আনুষ্ঠিানিকভাবে বিলুপ্ত হয়।
তবে দাস বাণিজ্য আনুষ্ঠানিকভাবে বিলুপ্ত হলেও আধুনিক সমাজে এখনো দাস বাণিজ্যের মতো মানব পাচার বাণিজ্য চালু রয়েছে যা আধুনিক দাসপ্রথা বলে অনেকেই মনে করেন। মানুষের সুবিধাবাদী চরিত্রের কারণে সমাজ থেকে দাসপ্রথা নির্মূল হয়নি। তাই বলা যায় সমাজ থেকে দাসপ্রথা বিলুপ্ত হয়নি শুধু ধরন পরিবর্তন হয়েছে।
ড. মতিউর রহমান: গবেষক ও উন্নয়নকর্মী