ডেঙ্গু প্রতিরোধে জনসচেতনতা একান্ত প্রয়োজন
এই সময়ে বাংলাদেশের অন্যতম আলোচিত এক রোগের নাম ডেঙ্গু জ্বর। করোনা মহামারির বিরুদ্ধে লড়াই করতে করতে যখন মানুষ ক্লান্ত, তখন ডেঙ্গুর প্রকোপ সাধারণ মানুষকে হতবিহ্বল করে তুলছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) মতে, ডেঙ্গু বিশ্বের সবচেয়ে বিপজ্জনক এবং মারাত্মক মশাবাহিত রোগ।
পরিসংখ্যান মতে গত ৫০ বছরে ডেঙ্গু বেড়েছে প্রায় ৩০ গুণ বেশি। ২০০০ সালে বাংলাদেশে প্রথম ডেঙ্গু শনাক্ত হয় এবং ৫,৫০০ জন আক্রান্ত হয়েছিল। প্রতি বছরই ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব পরিলক্ষিত হয় এবং বাংলাদেশে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব সবচেয়ে বেশি হয়েছিল ২০১৯ সালে। সরকারি হিসাব অনুযায়ী, সেই বছর ১০১,৩৫৪ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছিল এবং ১৭৯ জন মারা যায়।
দেশে প্রতিদিন বাড়ছে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা। চলতি মাসের প্রথম ১৫ দিনে সারা দেশে ৫২১ জন ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এর আগে গত মাসে মোট ৭৩৭ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হন। এ মাসে ডেঙ্গুর সংক্রমণ বাড়বে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে ১৭ জুলাই পর্যন্ত হাসপাতালে ভর্তি হওয়া ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা এক হাজার ৭২৩। তাদের মধ্যে, ১,৪৯৮ জন সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন এবং তিন জন মারা গেছেন। গত বছর ১ জানুয়ারি থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ২৮ হাজার ৪২৯ জন। তাদের মধ্যে প্রায় ১০৫ জন মারা গেছেন এবং ২৮ হাজার ২৬৫ জন সুস্থ হয়ে উঠেন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এডিস ইজিপ্টাই মশার কামড়ে ডেঙ্গু হয়। গ্রীষ্মমণ্ডলীয় বা উপ-ক্রান্তীয় অঞ্চল এই মশার পছন্দের আবাসস্থল। এই মশার শরীরে হালকা কালো রঙ এবং সাদা পা এবং শরীরে রূপালী-সাদা ব্যান্ড দেখে চিহ্নিত করা যায়। একটি পূর্ণ বয়স্ক মশা যেকোনো স্থানে জমা হয়ে থাকা বৃষ্টির পানিতে বংশবৃদ্ধি করতে পারে। তবে এরা সাধারণত ফেলে দেওয়া ডাবের খোসা, টায়ার, ব্যারেল, প্লাস্টিকের ড্রাম, ফুলের টব, খোলা ক্যান এবং পাত্রে বেশি দিন ধরে জমে থাকা পানিতে বংশবৃদ্ধি করে। এডিস মশার বংশবৃদ্ধির জন্য আদর্শ অন্যান্য অনেক ইনডোর এবং আউটডোর স্থানও রয়েছে যেমন বাড়িতে ব্যবহৃত ফ্রিজের নিচে, বাড়ি বা কলকারখানার এসির নিচে জমে থাকা পানি, ছাদে জমা বৃষ্টির পানি, ইত্যাদি।
বাংলাদেশে সাধারণত মে থেকে সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত ডেঙ্গু জ্বরের প্রাদুর্ভাব দেখা যায়। ডেঙ্গু জ্বর বহনকারী মশা যদি একজন মানুষকে কামড়ায় তাহলে চার থেকে ছয় দিনের মধ্যেই ডেঙ্গু জ্বর হবে। আবার জীবাণুমুক্ত মশা আক্রান্ত ব্যক্তিকে কামড়ালে তাও ডেঙ্গুর বাহক হয়ে উঠে। এভাবেই মশার মাধ্যমে ডেঙ্গু মানুষ থেকে মানুষে ছড়ায়।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ডেঙ্গু জ্বরে সাধারণত প্রচণ্ড জ্বর হয় এবং সারা শরীরে প্রচণ্ড ব্যথা হয়। জ্বর সাধারণত ১০৫ ডিগ্রি ফারেনহাইট পর্যন্ত উঠতে পারে। শরীরে, বিশেষ করে হাড়, নিতম্ব, পিঠ সহ জয়েন্ট এবং পেশীতে প্রচণ্ড ব্যথা হয়। এ ছাড়া মাথা ব্যথা ও চোখের পেছনে ব্যথা হয়ে থাকে। কখনও কখনও ব্যথা এত তীব্র হয় যে মনে হয় হাড় ভেঙে যাচ্ছে। তাই এই জ্বরের আরেক নাম হল 'ব্রেক বোন ফিভার’। জ্বরের ৪ বা ৫তম দিনে, সারা শরীরে লাল ফুসকুড়ি দেখা যায়, যাকে ত্বকের ফুসকুড়ি বলা হয়, অনেকটা অ্যালার্জি বা স্ক্র্যাচের মতো। বমি বমি ভাব এবং এমনকি বমিও হতে পারে। রোগী অত্যধিক ক্লান্তি এবং ক্ষুধামন্দা অনুভব করে।
সাধারণত, ৪ বা ৫ দিন পরে জ্বর চলে যায়; কিছু রোগীর ২ বা ৩ দিনের মধ্যে আবার জ্বর হতে পারে। এছাড়াও, জ্বরের কারণে সবচেয়ে জটিল অবস্থায় রক্তক্ষরণ হতে পারে। প্রায়শই লিভারের ক্ষতির কারণে রোগীর জন্ডিস, কিডনি ক্ষতির কারণে রেনাল ফেইলিওর ইত্যাদি এমনকি মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে।
এখন পর্যন্ত ডেঙ্গু ভাইরাসের কোনো ভ্যাকসিন আবিষ্কৃত হয়নি। তাই এই ভাইরাস মোকাবিলার সবচেয়ে ভালো উপায় হলো প্রতিরোধ। ডেঙ্গু প্রতিরোধে সচেতনতাই প্রাথমিক হাতিয়ার। সরকার ও জনগণের সমন্বিত সচেতনতাই পারে আমাদের এই মহামারি থেকে নিরাপদ রাখতে। ডেঙ্গু প্রতিরোধে প্রথমে এডিস মশার বংশবৃদ্ধি ও উৎপত্তির দিকে নজর দিতে হবে। এডিস মশার প্রজনন ক্ষেত্র ধ্বংস করে প্রাপ্তবয়স্ক মশা ধ্বংস করে ডেঙ্গু সম্পূর্ণরূপে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। এক্ষেত্রে সরকার ও জনগণ যৌথভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারে। মশার প্রজনন ক্ষেত্র ধ্বংসের বিষয়ে জনগণ যেমন সচেতন হবে, তেমনি পুরনো মশা নিধনে সংশ্লিষ্ট সরকারি দপ্তরগুলোকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে।
ডেঙ্গুর বিস্তার রোধে জনগণের কাজ হবে বাড়ির আশপাশের ঝোপঝাড়, জঙ্গল, জলাশয় পরিষ্কার রাখা। খেয়াল রাখতে হবে যেন ব্যবহৃত জিনিসপত্র যেমন খোলা পানির ট্যাংক, ফুলের টব ইত্যাদিতে পানি না জমে। বাথরুমের কোথাও জমা পানি পাঁচ দিনের বেশি রাখা যাবে না। অ্যাকুরিয়াম, ফ্রিজ বা এয়ার কন্ডিশনারের নিচে যাতে বেশিক্ষণ পানি না জমে সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। দিনের বেলা শরীর ভালোভাবে কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখতে হবে; প্রয়োজনে মশা নিরোধক ব্যবহার করা যেতে পারে। দিনের বেলা ঘুমালে মশারি টাঙিয়ে বা কয়েল দিয়ে ঘুমাতে হবে। হাফপ্যান্টের বদলে ফুল প্যান্ট পরিয়ে শিশুদের স্কুলে পাঠানো যেতে পারে।
ডেঙ্গু রোগীকে মশারির নিচে রাখতে হবে যাতে কোনো মশা রোগীকে কামড়াতে না পারে। মশা তাড়ানোর স্প্রে, কয়েল এবং ম্যাট ব্যবহার করতে হবে, সেইসঙ্গে দিনে ও রাতে মশার কামড় এড়াতে মশারি ব্যবহার করতে হবে। অন্যদিকে ডেঙ্গুর বিস্তার রোধে সরকারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হবে জনগণকে সচেতন করা। 'জেনেটিকালি মডিফাইড' পদ্ধতিতে কীভাবে ডেঙ্গু নির্মূল করা যায় সে বিষয়ে প্রাসঙ্গিক গবেষকদের নিয়োগ করা। ডেঙ্গু প্রতিরোধের জন্য জাতীয় নির্দেশিকা প্রদান। সব গণমাধ্যমে ডেঙ্গু সম্পর্কে নিয়মিত প্রচারণা চালাতে হবে। শহর এলাকায় নিয়মিত মশা নিরোধক স্প্রে করা। আক্রান্ত ব্যক্তিদের যথাযথ চিকিৎসা নিশ্চিত করা এবং প্রয়োজনে বিশেষ বাহিনী মোতায়েন করা।
সর্বোপরি ডেঙ্গু মহামারি থেকে রক্ষা পেতে জনগণ ও সরকারকে নিজ নিজ অবস্থান থেকে দায়িত্বশীল হতে হবে। আত্মসচেতনতা ছাড়া সরকারের সমালোচনা করে যেমন ডেঙ্গু দূর হবে না, তেমনি জাতীয় স্বার্থও হুমকির মুখে পড়বে। তাই সবার আগে প্রয়োজন আত্মসচেতনতা। এ ছাড়া সরকার-জনগণ মিলে সমন্বিত নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা বাস্তবায়ন করতে হবে। উভয় পক্ষের দায়িত্বশীল আচরণই পারে ডেঙ্গুর প্রকোপ কমিয়ে দেশকে এই সংকট থেকে মুক্ত করতে।
লেখক: গবেষক ও উন্নয়নকর্মী।
আরএ