প্রযুক্তি নির্ভর জীবন: নীতি ও নৈতিকতায় পরিবর্তন ঘটাবে
মানব সভ্যতার ইতিহসে তিনটি বড় শিল্পবিপ্লব গোটা দুনিয়ার গতিপথ ব্যাপকভাবে পাল্টে দিয়েছিল। প্রথম শিল্পবিপ্লব ঘটেছিল ১৭৮৪ সালে বাষ্পীয় ইঞ্জিন আবিষ্কারের মাধ্যমে। বিদ্যুতের আবিষ্কার হয় ১৮৭০ সালে যার ফলে দ্বিতীয় শিল্পবিপ্লব ত্বরান্বিত হয় এবং তৃতীয় শিল্পবিপ্লব ঘটে ১৯৬৯ সালে ইন্টারনেটের আবিষ্কার ও ১৯৯০ সালে এর বাণিজ্যিক ব্যবহার অবমুক্ত করার মাধ্যমে। ইন্টারনেটের আবিষ্কার শিল্পবিপ্লবের গতিকে বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়। তবে আগের তিনটি শিল্পবিপ্লবকে ছাড়িয়ে গেছে আজকের যুগের ডিজিটাল বিপ্লব যাকে চতুর্থ শিল্পবিপ্লব হিসেবেও গণ্য করা হচ্ছে।
উল্লেখ করা যেতে পারে যে, ইন্টারনেট আবিষ্কারের ফলে নানা ধরনের হার্ডওয়ার ও সফটওয়ার নির্মাণ প্রতিষ্ঠানের বিকাশ ঘটে দ্রুত গতিতে। ডিজিটাল বিপ্লব বা চতুর্থ শিল্পবিপ্লবকে কেন্দ্র করে বিশ্বব্যাপি অসংখ্য হাইটেক কপোর্রেশন ও বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। মাইক্রোসফট, অ্যাপল, গুগুল, অ্যামাজন, আলীবাবা’র মতো অসংখ্য প্রতিষ্ঠান। প্রযুক্তিকে নির্ভর করে গড়ে উঠেছে কৃষি প্রক্রিয়াকরণ শিল্প প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে মহাকাশে ভ্রমনের জন্য অত্যাধুনিক মহাকাশযান তৈরির প্রতিষ্ঠান।
এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, এইসব প্রতিষ্ঠান প্রতিনিয়ত আমাদের জীবনযাত্রাকে সহজসাধ্য করার জন্য নানারকমের ডিজিটাল উদ্ভাবন ও সেবা দোরগোড়ায় পৌঁছে দিচ্ছে। হার্ডওয়ার, সফটওয়ার সবধরণের সেবা আমরা পাচ্ছি মুহূর্তে। সারা দুনিয়া এখন আমাদের হাতের মুঠোয়। আমাদের প্রাত্যহিক জীবনযাত্রা এদের সেবা ছাড়া অচল। উচ্চবিত্ত থেকে শুরু করে নিম্নবিত্ত প্রত্যেকেই আমরা ডিজিটাল সেবার আওতাভুক্ত। মোবাইল ফোনে দশ টাকার টক টাইম কেনা থেকে শুরু করে নেটফ্লিক্সে সদ্য নির্মিত হলিউডি মুভি দেখা, অনলাইনে খাবার অর্ডার করা থেকে দামি ব্র্যাণ্ডের গাড়ি কেনা সবই এখন ডিজিটাল বিপ্লবের অবদান। ডিজিটাল এই যুগে কী করা সম্ভব না তার চেয়ে জানা ভালো কী করা যায় না। চতুর্থ শিল্পবিপ্লব আমাদের জীবনে এনেছে দুর্দান্ত গতি।
প্রায় দুই বছরেরও বেশি সময় ধরে গোটা পৃথিবী করোনাভাইরাসের থাবায় পর্যুদস্ত। নিঃসন্দেহে মানবজাতির জন্য এটি বড় ধরনের একটি সংকট বা বিপর্যয়। এই ভাইরাসের কারণে এক সময় গোটা পৃথিবী থমকে গিয়েছিল। সব ধরনের সামাজিক, সাংস্কুতিক ও রাজনৈতিক তৎপরতা ব্যাহত হয়েছিল। এই ভাইরাস থেকে বাঁচতে মানুষ নিজেদেরকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছিল। সরাসরি দেখা-সাক্ষাত বা মেলামেশা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। তদুপরি বিভিন্ন দেশের সরকার ঘোষিত লকডাউন বা শাট ডাউনের কারণেও মানুষকে গৃহবন্দি থাকতে হয়েছিল। এই অবস্থায় প্রযুক্তি নির্ভর যোগাযোগই হয়ে ওঠেছিল মানুষের জন্য একমাত্র উপায় বা মাধ্যম।
আমাদের দেশের মোট জনসংখ্যার বৃহৎ একটি অংশ এখন কোনো না কোনোভাবে ডিজিটাল প্রযুক্তির সঙ্গে যুক্ত। তবে তাদের উল্লেখযোগ্য একটি অংশ এখনো ডিজিটালি নিরক্ষর। এদের হাতে হাতে এখন ইন্টারনেটের সুবিধাযুক্ত স্মার্ট ফোন। সামাজিক যোগাযোগের সব মাধ্যম ব্যবহার করে যোগাযোগ স্থাপন বা ভাব বিনিময়, মোবাইল ফোনে কথা বলা থেকে ক্যাবল সংযোগের মাধ্যমে টিভিতে সিনেমা দেখা সবই সম্ভব হচ্ছে ডিজিটাল প্রযুক্তির এই যুগে।
ধনী, দরিদ্র, গ্রাম ,শহর নির্বিশেষে সবাই আজ প্রায় ডিজিটাল বিপ্লবের সুবিধাভোগী। তরুণ প্রজন্ম বিশেষ করে মাধ্যমিক পর্যায়ের স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের একটি বৃহৎ অংশ ইন্টারনেট প্রযুক্তির সঙ্গে সংযুক্ত। লেখা পড়ার পাশাপাশি বিনোদন খুঁজতে গিয়ে তারা অন্যান্য বিষয়য়েও আসক্ত হচ্ছে। অপরদিকে, ঘরে ঘরে ডিস বা ক্যাবল সংযোগের মাধ্যমে বিদেশি টিভি চ্যানেলে প্রচারিত নাটক, সিনেমা দেখে আমাদের ভাবনা জগতেও পরিবর্তন হচ্ছে।
ওটিটি প্লাটফর্মে এখন আমরা সিনেমা দেখে অভ্যস্ত হয়ে যাচ্ছি। যে সব সিনেমার বেশির ভাগই আমাদের আবহমান সংস্কৃতির সাথে মানানসই নয়। কিন্তু তাতেই আকৃষ্ট হচ্ছি। ইন্টারনেটের গুগল বা যে কোনো সার্চ ইঞ্জিনে ঢুকলেই সেগুলোর বিজ্ঞাপন অযাচিতভাবেই আমাদের চোখে পড়ছে। কৌতুহলবশত: কেউ যদি সেখানে ঢুকে দেখতে চাই তাহলে খুব একটা দোষ দেওয়া যায় না। অনেকেই পর্ণগ্রাফিতে আসক্ত হয়ে পড়ছে। এ ছাড়াও অনলাইন গেমস ও জুয়াতে আসক্তিও বৃদ্ধি পেয়েছে। এইভাবে আমাদের অগোচরেই কিছু বিষয় আমাদের মাথায় ঢুকে যাচ্ছে যা আমাদের আচার আচরণে পরিবর্তন আনছে।
পূর্বেই উল্লেখ করেছি এদেশের সিংহভাগ মানুষ এখনো ডিজিটালি সচেতন নয়। ইন্টারনেটে তারা কী দেখছে তা আমরা জানি না। এ সম্পর্কিত কোনো গবেষণাও আমাদের দেশে হয়েছে বলে জানা নেই। সেই সঙ্গে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এখনো অবধি ইন্টারনেটের নিরাপাদ ব্যবহার সংক্রান্ত কোনো শিক্ষা দেয়া হয় বলে জানা নেই। সরকারিভাবেও কোনো উদ্যোগ আছে বলে জানা নেই। কারণ, এখানে ব্যবসায়ের একটা বিষয় রয়েছে-তাহলো মুনাফা অর্জন।
তবে এসবের একটা নেতিবাচক প্রভাব যে রয়েছে সে বিষয়ে বিভিন্ন সময়ে বিশেষজ্ঞরা উল্লেখ করেছেন। যেমন, অনলাইনে প্রতারণা, নারী নির্যাতন, যৌন হয়রানি, নারী ধর্ষণ ও হত্যা, পারিবারিক সহিংসতা, স্বামী কতৃর্ক স্ত্রী হত্যা, স্ত্রী কতৃর্ক স্বামী হত্যা, সন্তানসহ হত্যা, শিক্ষক-শিক্ষার্থীর মধ্যকার সম্পর্কের পরিবর্তন, দুনীর্তি, মাদক ও জুয়ার বিস্তার, নারী ও শিশু পাচার. সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নারীর প্রতি অবমাননাকর মন্তব্য ও গোপনে ভিডিও ধারণ করে ছড়িয়ে দেওয়া, প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ এগুলো আমরা দেখতে পাচ্ছি। বিবাহ বিচ্ছেদ, প্রেমিক বা প্রেমিকার বাড়িতে বিয়ের জন্য অনশন এসবই এখন ঘটছে। সুতরাং এ কথা বলা যায় গতানুগতিক সমাজে যে নীতি, নৈতিকতা, মূল্যবোধ ও বন্ধন ছিল তার পরিবর্তন ঘটছে। আর এসবের পিছনে অনুঘটক হিসেবে কাজ করছে আধুনিক প্রযুক্তি উদ্ভাবিত বিভিন্ন মাধ্যম।
মানুষ মানুষের উপর আস্থা ও বিশ্বাস হারাচ্ছে। সততা ও আদর্শের অভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে। ফলে আমাদের মানবিক মূল্যবোধ কমে যাচ্ছে। আমরা দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, চরমপন্থা, সহিংসতা এবং অনৈতিকতায় জড়িয়ে পড়ছি। নীতি, নৈতিকতা, মানবতা, সহানুভূতি, সহযোগিতা, সহমর্মিতা ও দয়ার মতো মানবিক গুণাবলী দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে যাকে সমাজবিজ্ঞানীরা সামাজিক পুঁজির সংকট বলে বর্ণনা করেছেন। এই সংকট কতদিন চলবে তা এখনই বলা মুস্কিল।
ডিজিটাল যুগে এসে আমাদের পূর্বেকার সংস্কৃতি বিলুপ্ত হতে বসেছে। এ জন্য এখন আর কেউ সিনেমা হলে গিয়ে সিনেমা দেখতে আগ্রহী হয় না। বাঙালির আবহমান সংস্কৃতি যেমন গান, নাটক ও সিনেমার ফিউশন তৈরি করা হলেও তা আর আগের মতো আবেদন রাখতে পারছে না। পূর্বে যে সব নাটক, গান, যাত্রাপালা ও সিনেমা আমাদের হৃদয় ও মনকে আকৃষ্ট করত, আমাদেরকে মানবিক হওয়ার শিক্ষা দিত, আত্মিক উন্নতি ঘটাত সে রকম এখন আর আবেদন সৃষ্টি করতে পারছে না। ফলে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে এক ধরনের আত্মিক ও নৈতিক শূন্যতা বিরাজ করছে। বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর অবস্থাও তাই। আর এই আত্মিক ও নৈতিক শূন্যতার জায়গায় স্থান নিচ্ছে ধমীর্য় গোঁড়ামি ও কুসংস্কার।
অন্যদিকে অনেক বিশেষজ্ঞের মতে নতুন তথ্য প্রযুক্তি উদ্ভূত সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জগুলোর অন্যতম হলো মানুষের গোপনীয়তা। আমাদের দৈনন্দিন জীবনের কর্মকান্ডের তথ্য সংগ্রহ ও তথ্য বণ্টন নতুন বিপ্লবের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। কারণ, সে অনুযায়ী প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের সেবা উদ্ভাবন করে বাণিজ্য করবে। এ যুগে তাই গোপনীয়তা রক্ষা করা খুব কঠিনই হবে। নতুন এই কঠিন পরিস্থিতিতে গোপনীয়তার সংজ্ঞাই বদলে যাবে। আগের মতো অনেক কিছুকে আর গোপনীয় বলে রক্ষা করতে পারব না আমরা। সবকিছুই খোলামেলা হয়ে গেলে মূল্যবোধকেও নবতর নিম্নস্তরে নামিয়ে এনে নতুন করে সংজ্ঞায়িত করার প্রয়োজন পড়বে। অর্থাৎ আমাদের নৈতিকতা ও নৈতিক সীমারেখাকে নতুন করে সংজ্ঞায়িত করতে বাধ্য করবে চতুর্থ শিল্পবিপ্লব।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চতুর্থ শিল্পবিপ্লবে যান্ত্রিক মেধা বা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স কোনো নৈতিকতা দিয়ে চলবে না, সে চলবে অঙ্কের নিয়মে। মূল্যবোধহীন যান্ত্রিক মেধার অবারিত বিকাশ সামাজিকতার যেটুকু অবশিষ্ট আছে, তার বিলোপ ঘটাতে পারে। ফলে পারিবারিক ও সামাজিক মূল্যবোধ অর্থাৎ সমাজ ও রাষ্টে্র স্থান দখল করবে ব্যবসা। দ্বিতীয় ও তৃতীয় শিল্পবিপ্লবে পুঁজির চাহিদাই মূল্যবোধে রূপান্তরিত হয়েছে এবং রাষ্ট্র সে মতে আইন পরিবর্তন করে লিবারেল সেজেছে। চতুর্থ শিল্পবিপ্লব পরিণত হলে দেখা যাবে, মানবের সৃজনশীলতা উদ্ভূত অ্যালগরিদম এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার স্বয়ংক্রিয় সিদ্ধান্তে যা আসে, তাই ধীরে ধীরে মূল্যবোধ বলে পরিগণিত হবে। এতে সমাজে পাপের অস্তিত্ত্ব বিলীন হয়ে উঠতে পারে এবং মানব মননে পাপবোধ বলে কিছু অবশিষ্ট রইবে না। মানবমনের বিবিধ চাহিদাই হয়ে উঠবে মূল্যবোধের ভিত্তি। ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র যখন উপনিবেশে সংঘাত সৃষ্টি করেছে ও লুটপাট অব্যাহত রেখেছে, তখন ইউরোপের বস্তবাদী নাগরিক তা নিয়ে মাথা ঘামায়নি, কেননা তাতে আর্থিক মুনাফার যোগ ছিল। আর্থিক মুনাফাই নৈতিকতার সীমা ঠিক করে দিয়েছিল। পশ্চিমা পুঁজিবাদী দেশগুলো এভাবে রূপান্তরের মধ্য দিয়ে গেছে যার বর্তমান নীতি হলো, ব্যক্তি ও ব্যবসার যেকোনো চাহিদাই নৈতিকতার ভরকেন্দ্র-হোক তা আগের মানদণ্ডে অনৈতিক বা বেঠিক।
প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় শিল্প বিপ্লব যেসব দেশে সংঘটিত হয়েছিল তার প্রভাবে সমাজ জীবনেও ঘটেছিল ব্যাপক পরিবর্তন। সেসব পরিবর্তনের ইতিহাস আমরা সমাজচিন্তক ও ইতিহাসবিদদের রচনা থেকে জানতে পারি। সেসব তত্ত্বের ভিত্তিতে ও বর্তমান পরিস্থিতি পর্যালোচনা করলে এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, ডিজিটাল বিপ্লব বা চতুর্থ শিল্পবিপ্লব মানুষের স্বভাব, সংস্কৃতি ও জীবনাচারে অনেক পরিবর্তন সৃষ্টি করেছে। আমাদের দেশেও আধুনিক প্রযুক্তির উপর নির্ভরশীল বিশাল এক জনগোষ্ঠীর মানস জগতেও ঘটে গেছে ব্যাপক পরিবর্তন। যার ফলে সমাজে প্রচলিত মূল্যবোধ ও নীতি, নৈতিকতার সাথে ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যবহার জনিত কারণে তাদের আচার আচরণে ও নীতি নৈতিকতায় ব্যাপক পরিবর্তন ঘটেছে। তবে সমাজের সমগ্র জনগোষ্ঠীর জন্য এই পরিবর্তন কতদিনে সম্পন্ন হবে তা সময়ই বলে দিবে।
ড. মতিউর রহমান: গবেষক ও উন্নয়নকর্মী