বিশ্ব শরণার্থী দিবস/শরণার্থীদের নিরাপত্তার অধিকার
জাতিসংঘ শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশনার (ইউএনএইচসিআর) শরণার্থীদের বর্ণনা করেছে এভাবে ‘শরণার্থী হল এমন এক জনগোষ্ঠী যারা যুদ্ধ, সহিংসতা, সংঘাত বা নিপীড়ন থেকে বাঁচতে পালিয়ে এসেছে এবং অন্য দেশে নিরাপত্তা খুঁজতে আন্তর্জাতিক সীমান্ত অতিক্রম করেছে। প্রায়শই তাদের পিঠে কাপড়ের চেয়ে সামান্য বেশি সম্পত্তি থাকে এবং তারা তাদের বাড়ি, চাকরি এবং প্রিয়জনদের রেখে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছে’।
শরণার্থীদের আন্তর্জাতিক আইনে সংজ্ঞায়িত এবং সুরক্ষিত করা হয়েছে। ১৯৫১ সালের শরণার্থী কনভেনশন হলো একটি মূল আইনি দলিল, যা একজন শরণার্থীকে এইভাবে সংজ্ঞায়িত করে— ‘যে কেউ জাতি, ধর্ম, জাতীয়তা, কোনো নির্দিষ্ট সামাজিক গোষ্ঠীর সদস্য বা রাজনৈতিক মতামতের কারণে নির্যাতিত হওয়ার একটি সুপ্রতিষ্ঠিত ভয়ের কারণে তাদের মূল দেশে ফিরে যেতে অক্ষম বা অনিচ্ছুক।’
বর্তমানে বিশ্বব্যবস্থায় ভিন্ন ভাষা, ভিন্ন জাতিসত্তা, ভিন্ন সংস্কৃতি, ভিন্ন ধর্ম এবং ভিন্ন মতাদর্শের মানুষের প্রতি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ক্রমবর্ধমান অসহিষ্ণুতা, সাম্রাজ্যবাদ ও আধিপত্য বিস্তারের লক্ষ্যে লাখ লাখ মানুষকে নিজে দেশ ছেড়ে অন্য দেশে আশ্রয় গ্রহণ করতে বাধ্য করছে। ফলে, শরণার্থী সমস্যা একটি অন্যতম আন্তর্জাতিক সমস্যা হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। জাতিসংঘের এক হিসাব অনুযায়ী, প্রতি মিনিটে পৃথিবীতে ২০ জন মানুষ নিজের দেশ ত্যাগ করছে প্রধানত যুদ্ধ, অত্যাচার, এবং নির্যাতন থেকে বাঁচার জন্য। সেই সঙ্গে আছে জলবায়ুর বিরূপ প্রভাব জনিত কারণে দেশত্যাগ। দেশত্যাগী এসব মানুষ বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন পরিচয়ে পরিচিত, যেমন: শরণার্থী (Refugee), আশ্রয়প্রার্থী (Asylum seekers), রাষ্ট্রবিহীন মানুষ (Stateless people), অভ্যন্তরীণ বাস্তচ্যুত মানুষ (Internally displaced people) কিংবা জোরপূর্বক বাস্তচ্যুত মানুষ (Forcibly displaced people)।
জাতিসংঘ শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশনার (ইউএনএইচসিআর) এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে এ বছর (২০২২) জুনের প্রথম সপ্তাহ নাগাদ সারাবিশ্বে জোরপূর্বক বাস্তচ্যুতদের সংখ্যা ১০০ মিলিয়য়ন ছাড়িয়ে গেছে। ইউক্রেন যুদ্ধ এবং অন্যান্য সংঘাতের কারণে সহিংসতা, সংঘাত, মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং নিপীড়নের কারণে পালাতে বাধ্য হওয়া মানুষের সংখ্যা প্রথমবারের মতো রেকর্ড ১০০ মিলিয়নের মাইলফলক অতিক্রম করেছে। জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক হাইকমিশনার ফিলিপ্পো গ্র্যান্ডি বলেছেন, ‘এটি এমন একটি রেকর্ড যা কখনোই তৈরি হওয়া উচিত ছিল না।’ তিনি আরও বলেছেন, বিশ্ব শরণার্থী দিবস, ‘ধ্বংসাত্মক দ্বন্দ্ব, নিপীড়নের অবসান এবং নিরপরাধ মানুষকে তাদের বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য করার জন্য অন্তর্নিহিত কারণগুলোকে মোকাবিলা করার জন্য একটি সচেতন আহ্বান হিসেবে কাজ করে।’, ১০০ মিলিয়নের সংখ্যার মধ্যে শরণার্থী, আশ্রয়প্রার্থী এবং নিজেদের দেশের অভ্যন্তরে সংঘাত বা সহিংসতার কারণে বাস্তচ্যুত ব্যক্তিও অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।
ইউএনএইচসিআর আরও উল্লেখ করেছে, বিশ্ব শরণার্থী দিবস হলো একটি আন্তর্জাতিক দিবস, যা বিশ্বব্যাপী শরণার্থীদের সম্মান করার জন্য জাতিসংঘ কর্তৃক মনোনীত। এটি প্রতি বছর ২০ জুন উদযাপন করা হয়। দিবসটি সেইসব মানুষের শক্তি এবং সাহস প্রদান করে যারা সংঘর্ষ বা নিপীড়ন থেকে বাঁচতে তাদের নিজ দেশ ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছে। বিশ্ব শরণার্থী দিবস হলো তাদের দুর্দশার জন্য সহানুভূতি এবং বোঝাপড়া তৈরি করার এবং তাদের জীবন পুনর্গঠনে তাদের সংগ্রামকে স্বীকৃতি দেওয়ার একটি উপলক্ষ।
জাতিসংঘের ঘোষণা অনুযায়ী, ২০০১ সাল থেকে প্রতি বছর দিনটি পালিত হয় এক একটি প্রতিপাদ্য ধরে। এই বছর, শরণার্থীদের নিরাপত্তা খোঁজার অধিকারের উপর জোর দেওয়া হয়েছে। বিশ্ব শরণার্থী দিবস ২০২২ এর মূল থিম বা প্রতিপাদ্য বিষয় হলো ‘যে কেউ, যেখানেই থাকুক, যখনই থাকুক তাদের নিরাপত্তা চাওয়ার অধিকার রয়েছে’। (Whoever.Wherever. Whenever. Everyone has the right to seek safety).
ইউএনএইচসিআর বলছে এই গ্রহের প্রতিটি মানুষেরই নিরাপত্তা চাওয়ার অধিকার রয়েছে। তারা যেই হোক না কেন, যেখান থেকেই আসুক না কেন, যখনই আসুক না কেন, যারা পালাতে বাধ্য হয়েছে বা যাদের পালাতে বাধ্য করা হয়েছে তাদের মর্যাদার সঙ্গে আচরণ করা উচিত। যে কেউ সুরক্ষা চাইতে পারে, তারা কে বা তারা যা বিশ্বাস করুক না কেন সেটি বিবেচনা না করে তাদের নিরাপত্তা চাওয়ার বিষয়টি যেটি একটি মানবাধিকার তার উপর গুরুত্ব দেওয়া উচিত।
ইউএনএইচসিআর আরও বলছে, তারা যেখান থেকেই আসুক না কেন, পালাতে বাধ্য হওয়া মানুষকে স্বাগত জানানো উচিত। শরণার্থীরা সারাবিশ্ব থেকে আসে। জীবন বাঁচাতে তারা একটি প্লেন, একটি নৌকা বা পায়ে হেঁটে এক দেশ থেকে অন্য দেশে আশ্রয় নিতে পারে তবে যা সর্বজনীন তা হল তাদের নিরাপত্তা চাওয়ার অধিকার। যখনই মানুষ পালাতে বাধ্য হয়, তাদের সুরক্ষা পাওয়ার অধিকার রয়েছে। হুমকি যাই হোক না কেন যুদ্ধ, সহিংসতা, নিপীড়ন থেকে প্রত্যেকেই সুরক্ষা পাওয়ার যোগ্য। প্রত্যেকেরই নিরাপদ থাকার অধিকার রয়েছে।
নিরাপত্তা চাওয়া বলতে ইউএনএইচসিআর এখানে পাঁচটি বিষয়ের কথা উল্লেখ করেছে। যেমন—১. আশ্রয় চাওয়ার অধিকার: নিপীড়ন, সংঘাত বা মানবাধিকার লঙ্ঘন থেকে পালিয়ে আসা যে কেউ অন্য দেশে সুরক্ষা চাওয়ার অধিকার রাখে, ২. নিরাপদ প্রবেশাধিকার: পালাতে বাধ্য হওয়া সব মানুষের জন্য সীমান্ত উম্মুক্ত রাখা উচিত। প্রবেশাধিকার সীমিত করা এবং সীমানা বন্ধ করা নিরাপত্তা খুঁজতে থাকা জনগোষ্ঠীর জন্য তাদের যাত্রাকে আরও বিপজ্জনক করে তুলতে পারে, ৩. দেশে ফিরতে বাধ্য না করা: যদি তাদের জীবন বা স্বাধীনতা ঝুঁকির মধ্যে থাকে তবে তাদের দেশে ফিরে যেতে বাধ্য করা যাবে না। এর মানে হলো- দেশগুলো শরণার্থীদের তাদের দেশে ফিরিয়ে দিলে যে বিপদের সম্মুখীন হবে তা মূল্যায়ন না করে কাউকে পেছনে ঠেলে দেওয়া উচিত নয় ৪. কোনো বৈষম্য না করা: সীমান্তে জনগণের প্রতি বৈষম্য করা উচিত নয়। জাতি, ধর্ম, লিঙ্গ এবং উৎপত্তির দেশ নির্বিশেষে শরণার্থী অবস্থার জন্য সমস্ত আবেদনকে অবশ্যই ন্যায্য বিবেচনা করা উচিত, ৫. মানবিক আচরণ: পালাতে বাধ্য করা লোকদের সম্মান ও মর্যাদার সঙ্গে আচরণ করা উচিত। তারা যেকোনো মানুষের মতো নিরাপদ ও মর্যাদাপূর্ণ আচরণ পাওয়ার অধিকারী। অন্যান্য বিষয়গুলোর মধ্যে পরিবারগুলোকে একত্রিত রাখা, পাচারকারীদের হাত থেকে তাদের রক্ষা করা এবং নির্বিচারে আটক এড়ানো।
আয়তনে ছোট ও উন্নয়নশীল দেশ হলেও বাংলাদেশ এক বিশাল শরণার্থী জনগোষ্ঠীকে আশ্রয় প্রদান করেছে। ২৫ আগস্ট, ২০১৭ থেকে, মিয়ানমারে জাতিগত সহিংসতার কারণে ১.১ মিলিয়নেরও বেশি রোহিঙ্গা শরণার্থী পালিয়ে এসে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। পৃথিবীর সর্ববৃহৎ শরণার্থী শিবির কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফে অবস্থানরত রোহিঙ্গারা নিপীড়নের শিকার হয়ে নিজ দেশের পৈতৃক ভিটেমাটি ছেড়ে বাংলাদেশে শরণার্থী হয়েছে। বাংলাদেশ সরকার বিশেষ করে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদার মানবিকতায় ও বাংলাদেশের জনগণ তাদের সাধ্যমতো প্রচেষ্টা নিয়ে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের পাশে দাঁড়িয়েছে। এটি মানবতার একটি বিরল দৃষ্টান্ত। জীবন-ধারণের উপকরণসহ তাদের যথাযোগ্য মর্যাদায় নিজ দেশে প্রত্যাবাসনের জন্য মিয়ানমার সরকারের উপর চাপ প্রয়োগ অব্যাহত রাখতে বাংলাদেশ সরকার আন্তর্জাতিক ও বিভিন্ন দাতা সংস্থার প্রতি অব্যাহত সহযোগিতার আহ্বান জানিয়ে আসছে।
দেশে দেশে জাতিগত দাঙ্গা, ধর্মীয় সম্প্রদায়ের সঙ্ঘাত, হিংসা-বিদ্বেষ ও সহিংসতায় আক্রান্ত হয়ে ক্ষুধা-দারিদ্র্যের জ্বালায় নিজ দেশ থেকে উচ্ছেদ হয়ে নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে মানুষ ভিন্ন দেশে শরণার্থী হচ্ছে। শরণার্থীরাও বিভিন্ন দেশে ক্ষুধা ও বেকারত্বের তাড়নায় অপরাধের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হয়ে স্থানীয় সংস্কৃতির জন্য হুমকি হয়ে পড়ায় নতুন নতুন সংকটের সৃষ্টি হচ্ছে। শরণার্থীরা নিজ দেশ থেকে বিচ্যুত হলেও আশ্রয় ও নিরাপত্তার চ্যালেঞ্জগুলো বিদ্যমান থেকেই যাচ্ছে। সুতরাং এবারের বিশ্ব শরণার্থী দিবসটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। শরণার্থীদের মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকা ও তাদের নিরাপত্তার বিষয়টি নিশ্চিত করার দায়িত্ব আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উপরই বর্তায়।
ইউএনএইচসিআর বলছে বিশ্ব শরণার্থী দিবস বিশ্বব্যাপী উদ্বাস্তুদের অধিকার, চাহিদা এবং স্বপ্নের উপর আলোকপাত করে, রাজনৈতিক ইচ্ছা এবং সংস্থাগুলোকে একত্রিত করতে সাহায্য করে যাতে শরণার্থীরা কেবল বেঁচে থাকাই নয় বরং উন্নতিও করতে পারে। যদিও প্রতিদিনই শরণার্থীদের জীবন রক্ষা করা এবং উন্নত করা গুরুত্বপূর্ণ, বিশ্ব শরণার্থী দিবসের মতো আন্তর্জাতিক দিনগুলো দ্বন্দ্ব বা নিপীড়ন থেকে পালিয়ে আসা লোকদের দুর্দশার দিকে বিশ্বব্যাপী মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করতে সহায়তা করে। বিশ্ব শরণার্থী দিবসে অনুষ্ঠিত অনেক কার্যক্রম শরণার্থীদের সমর্থন করার সুযোগ তৈরি করে।
প্রতি বছর, বিশ্ব শরণার্থী দিবসে উদ্বাস্তুদের সমর্থনে বিশ্বের অনেক দেশে বিভিন্ন ইভেন্ট আয়োজন করা হয়। এই ইভেন্টগুলোতে শরণার্থী ছাড়াও সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তা, হোস্ট সম্প্রদায়, বহুজাতিক সংস্থা, সেলিব্রিটি, স্কুলের শিশু এবং সাধারণ জনগণও অংশ নেয়। এই সব ইভেন্ট শরণার্থীদের প্রতি বিশ্ব সম্প্রদায়ের মনোযোগ আকর্ষণ করে যাতে তাদের প্রতি বিশ্ববাসী সহানুভূতিশীল হয়। মানুষ হিসেবে তাদের বেঁচে থাকার অধিকার, মৌলিক মানবিক চাহিদা পাওয়ার অধিকার ও নিরাপত্তা পাওয়ার অধিকারের উপর গুরুত্ব দেওয়া হয়।
লেখক: গবেষক ও উন্নয়নকর্মী
আরএ/