স্বাধীনতার অর্ধ-শতাব্দী: ওষুধশিল্পে বাংলাদেশ কতদূর এগোল
স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে বাংলাদেশে ওষুধশিল্প ছিল অত্যন্ত নাজুক অবস্থায়। দেশের সিংহভাগ ওষুধ বিদেশ থেকে আমদানি করা হতো। এতে প্রচুর বৈদশেকি মুদ্রার অপচয় হতো। দেশে যে সামান্য পরমিাণ ওষুধ উৎপাদন হতো, তাও বিদেশি ওষুধ কোম্পানির নিয়ন্ত্রাধীন ছিল। ছিল না সরকারি কোনো নিয়ন্ত্রণ। এ পরিস্থিতিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজবিুর রহমানরে উদ্যোগে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে একটি ‘ড্রাগ কন্ট্রোলার অফিস’ প্রতিষ্ঠা করা হয়। দেশের মানুষ যেন প্রয়োজনের সময় প্রয়োজনীয় ওষুধ কিনতে পারে এবং বৈদেশিক মুদ্রার অপচয়রোধ করা যায় সে লক্ষ্যে ১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজবিুর রহমান একটি কমিটি গঠন করান। এই কমিটিকে এ বিষয়ে নীতিমালা প্রণয়ন, বিদেশ থেকে আমদানীকৃত ওষুধের মান যাচাই-বাছাই, পরমিাণ ও মূল্য নির্ধারণের মাধ্যমে আমদানি নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা প্রদান করা হয়। গঠন করা হয় টিসিবির অধীনে একটি ‘ড্রাগ সেল’। মূলত এসব র্কমকাণ্ডই ‘ছায়া ওষুধ নীতি’ হিসাবে কাজ করেছে। ১৯৭৪ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ওষুধের আমদানি কমিয়ে দেশে ওষুধ উৎপাদন বৃদ্ধি এবং ঔষধশিল্পকে সহযোগিতা প্রদানের জন্য ‘ঔষধ প্রশাসন পরিদপ্তর’ গঠন করেন। এ ছাড়া ওষুধের আমদানি কমিয়ে আনতে আগেই গঠিত ‘বাংলাদেশ শিল্প ব্যাংক’ ও ‘বাংলাদশে শিল্প ঋণ সংস্থা’কে নতুন ঔষধশিল্পে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে আর্থিক সহায়তা প্রদান করতে নির্দেশ দেন।
বর্তমানে ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের হাতে ঔষধ শিল্পের পূর্ণ তদারকি। প্রতিষ্ঠনটি ১৯৭৬ সাল থেকে যাত্রা শুরু করে সরাসরি স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রনালয়ের অধীনে একটি পৃথক অধিদপ্তর হিসেবে কাজ শুরু করে এবং ১৭ জানুয়ারি ২০১০ এ এসে ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর হিসেবে উন্নীত হয়। ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের কাজ- ওষুধের সমস্ত নতুন প্রকল্পের প্রস্তাবের মূল্যায়ন, ঔষধ উৎপাদন লাইসেন্স ইস্যু এবং নবায়ন, বিক্রয় ড্রাগ লাইসেন্স ইস্যু এবং নবায়ন, ওষুধ পণ্যের নিবন্ধন ও নবায়ন, ওষুধ পণ্যের মূল্য নির্ধারণ এবং মূল্যের সার্টিফিকেশন, ফার্মাসিউটিক্যাল প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন, কাঁচামাল এবং প্যাকেজিং উপকরণ আমদানির জন্য তালিকার অনুমোদন, ওষুধ আমদানির জন্য ইন্ডেন্টের অনুমোদন, নজরদারি এবং ফার্মাকোভিজিল্যান্স কার্যকলাপ, মাদক আদালত এবং অন্যান্য আদালতে মামলার বিচার, রপ্তানি লাইসেন্স, এফএসসি (ফ্রি সেলস সার্টিফিকেট), জিএমপি (গুড ম্যানুফ্যাকচারিং প্রাকটিস) সার্টিফিকেট এবং সিপিপি (ফার্মাসিউটিক্যাল পণ্যের শংসাপত্র) প্রদান।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বিশেষ করে ১৯৮২ সালে প্রথম ড্রাগ অ্যাক্ট জারি হওয়ার পর ঔষধ শিল্পের অবস্থার পরিবর্তন ঘটে। আশির দশকের প্রথমদিকে বাংলাদেশের ওষুধ শিল্প বাজারে বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর আধিপত্য ছিল। তখন দেশে মোট ১১৬ জন লাইসেন্সধারী ওষুধ উৎপাদনকারী ছিল। তাদের মধ্যে ৮টি বহুজাতিক কোম্পানি দেশের অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের ৭০ শতাংশ উৎপাদন করত। বাকী ৩০ শতাংশের মধ্যে ১৫ শতাংশ করে বাজার যথাক্রমে ২৫টি মাঝারি ও ১৩৩টি ক্ষুদ্র আকারের স্থানীয় প্রতিষ্ঠানের দখলে ছিল। কিছু স্থানীয় প্রতিষ্ঠান বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর হয়ে কাজ করত, আমদানিকৃত প্রোডাক্টস বিক্রয় করত এবং ওষুধ উৎপাদন করত। বহুজাতিক কোম্পানিগুলো মূলত সিম্পল ড্রাগ ফর্মুলেশন ম্যানুফ্যাকচার করত আর এগুলো ছিল বহুলাংশে নন-এসেনশিয়াল ড্রাগস। ১৯৮২ সালে প্রবর্তিত হয় বাংলাদেশ ড্রাগস (কন্ট্রোল) অর্ডিন্যান্স ১৯৮২। এই অর্ডিন্যান্স অনুযায়ী কোনো বিদেশি কোম্পানি
কোনো স্থানীয় উৎপাদনকারীর কাছে প্রযুক্তি হস্তান্তর করতে পারবে না যদি না দেশে তাদের নিজস্ব কোনো সেটআপ থাকে । এ অর্ডিন্যান্স বাস্তবায়নের ফলে বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর আধিপত্য কমতে থাকে এবং দেশীয় মালিকানাধীন কোম্পানিগুলোর বিকাশ লাভ করে। ১৯৮২ সালের ড্রাগ অর্ডিন্যান্সের মাধ্যমে আরোপিত বিভিন্ন বিধিনিষেধ তুলে নেওয়া হয় ২০০৫ ও ২০১৫ সালের ওষুধ নীতির মাধ্যমে। জাতীয় ওষুধনীতি ২০০৫ এর অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল কম দামে জরুরি ওষুধের সরবরাহ ও সহজলভ্যতা নিশ্চিত করা। এ একই নীতির আওতায় সাবকনট্রাকটিং এর উপর বিধিনিষেধ তুলে নেয়ার ফলে কতগুলো স্থানীয় প্রতিষ্ঠান বিদেশি কোম্পানিগুলোর
সঙ্গে মিলে ওষুধ উৎপাদন ও রপ্তানির কাজ শুরু করে। কেবল জেনেরিক ওষুধের ক্ষেত্রেই নয় অধিকন্তু প্যাটেনটেড ওষুধের ক্ষেত্রেও দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলো আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে কাজ শুরু করে।
১৯৯৫ সালে, বাংলাদেশ বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার সঙ্গে ট্রিপস চুক্তি স্বাক্ষর করে। এর ফলে স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে বাংলাদেশ পেটেন্ট ছাড়াই ওষুধ উৎপাদন ও বাজারজাতকরণের সুবিধা পায়। আর এ জন্যে বাংলাদেশ কম খরচে ওষুধ উৎপাদন করতে পারে এবং ভোক্তা পর্যায়ে ওষুধের দাম অনেক কম হয়, যা বাংলাদেশের অনুন্নত স্বাস্থ্য খাতের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। প্রাথমিকভাবে, চুক্তির সময়সীমা ২০০৫ সাল পর্যন্ত ছিল, কিন্তু পরে এটি ২০১৬ পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছিল। পরে আবার চুক্তির মেয়াদ ২০৩৩ পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। এই সুবিধাটি
দেশের ওষুধ শিল্পের অগ্রগতিকে ত্বরান্বিত করে। দেশীয় ওষুধ প্রস্তুতিকারকরা প্রধানত জেনিরিক ওষুধ উৎপাদন করে। বাংলাদেশে উৎপাদিত ওষুধের ৮০ শতাংশই জেনেরিক, ২০ শতাংশ মাত্র প্যাটেন্টেড ড্রাগ। মোট ওষুধের মধ্যে জেনেরিক ওষুধের আধিপত্য দেশের ওষুধ শিল্প বিকাশের একটি শক্তিশালী স্তম্ভস্বরূপ। কারণ এসব ওষুধ উৎপাদনের জন্য প্যাটেন্ট বাবদ কোনো অর্থ ব্যয় করতে হয় না [৩] ড্রাগ অর্ডিন্যান্স ১৯৮২ প্রবর্তিত হওয়ার পর থেকেই বাংলাদেশের ওষুধ শিল্প খাত (অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ও জ্ঞানভিত্তিক খাত) একটি শক্তিশালী খাত হিসেবে দ্রুত বিকাশ লাভ করতে থাকে। বাংলাদেশ এ অঞ্চলে জেনিরিক ওষুধ উৎপাদনের বিকাশমান হাব হিসেবে বিবেচিত হয়। ২০১৩ সালে এ খাত থেকে ১০২ বিলিয়ন টাকা রাজস্ব আয় হয়, যা বেড়ে ২০১৮ সালে ২০২ বিলিয়ন ডলারে উন্নিত হয়।
বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদার ৯৮ শতাংশ পূরণ করে মোট ৪৭টি কোম্পানি বিশ্বের ১৫৩টি দেশে ওষুধ রপ্তানি করে থাকে। তবে দেশের ঔষধ শিল্পের কাঁচামাল এখনো আমদানি নির্ভর, তাই লাভের গুড় পিঁপড়ায়ই খেয়ে যায় বেশি। অধুনা এ সমস্যা সমাধানকল্পে এবং ঔষধ শিল্পকে সয়ংসম্পূর্ণ করতে সরকার মুন্সীগঞ্জের গজারিয়ায় ‘এ্যকটিভ ফার্মাসিউটিক্যাল ইনগ্রেডিয়েন্ট’ বা ঔষধশিল্প পার্ক নির্মানের উদ্যোগ নিয়েছে। এখানে তৈরি হবে ঔষধ শিল্পের কাঁচামাল এতে কাঁচা মালের আমদানি খরচ বাঁচবে। দেশে নিজস্ব পেটেন্টেড ঔষুধের গবেষণা ও উৎপাদন বাড়বে। দেশের কেমিস্ট ও বায়োকেমিস্টরা দেশে কাজ করতে আগ্রহী হবে। সঙ্গে সঙ্গে ঔষধের বাজার আরও সম্প্রোসারিত হবে বলে আশা প্রকাশ করেন বাংলাদেশ ঔষধ শিল্প সমিতির মহাসচিব এস এম শফিউজ্জামান [৪]। জনাব জামানের আমরাও প্রত্যাশা করি বাংলাদেশের ঔষধ শিল্প অনেক দূর এগিয়ে যাক। নিজস্ব পেটেন্টে তৈরি হোক নতুন নতুন ওষুধ, বাড়ুক রপ্তানি আয়। সেই সঙ্গে দেশে ঔষধের মূল্য থাকুক সাধারণ নিম্নবিত্তের হাতের নাগালে যেন রোগ নিরাময়ে ঔষধ কিনতে গিয়ে যেন কাওকে সর্বশান্ত হতে না হয়।
লেখক: ডা. মো. শামীম হায়দার তালুকদার সি ই ও, এমিনেন্স অ্যাসোসিয়েট ফর সোশ্যাল ডেভোলাপমেন্ট
এমএমএ/