সঠিক খাদ্য নিশ্চিত হোক হাসপাতালের রোগীদের জন্য
খাদ্য ও পুষ্টি বিষয়ে আলোচনা করতে গেলে যে বিষয়টা প্রথমেই বলতে হয়, তা হলো ইমিউনিটি বা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা। বিশষজ্ঞরা প্রায়শই বলে থাকেন প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধই উত্তম। আর দেহের নিজস্ব রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ভালো থাকলে কোনো জীবানু সহজে আক্রমণ করতে পারে না। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য সবচেয়ে কার্যকর উপায় হলো খাদ্য। তবে সবার দেহে খাদ্যের চাহিদা সমান নয়। মানুষের দেহের গঠন, ওজন, বয়স, পেশা ও লিঙ্গভেদে খাদ্য চাহিদার ভিন্নতা দেখা যায়। আবার যারা ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ, এলার্জি বা এ ধরনের নানা রোগে আক্রান্ত তাদের ক্ষেত্রে খাদ্যের পরিমান যেমন নির্ধারিত থাকে তেমনি কোনো কোনো খাদ্য নিষিদ্ধও থাকে। প্রয়োজনের চেয়ে কম খাদ্য গ্রহণ করলে যেমন সমস্যা, আবার বেশি খাদ্য গ্রহণ করলেও সমস্যা। তাই পুষ্টিবিদরা বলেন, সঠিক সময়ে, নির্ধারিত পরিমানে, সঠিক খাদ্য গ্রহণের মাধ্যমেই পুষ্টি নিশ্চিত হয়।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বরাত দিয়ে বিবিসি জানাচ্ছে, বাংলাদেশে সরকারি হাসপাতাল রয়েছে ৬৫৪টি এবং এ সব হাসপাতালে মোট শয্যার সংখ্যা ৫১,৩১৬টি[১]। তবে ঢাকা মেডিকেল ও শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতলের মতো কিছু কিছু হাসপাতালে শয্যা ছাড়াও হাসপাতালের মেঝে এবং বারান্দায় রোগীরা অবস্থান করে চিকিৎসা নিয়ে থাকেন। সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নেওয়া অধিকাংশ রোগীই নিম্ন আয়ের মানুষ। ওষুধ ও চিকিৎসা সংক্রান্ত অন্য খরচ (প্রয়শই সরকারি হাসপাতালের যন্ত্রপাতি নষ্ট থাকার কারণে বাইরে থেকে টেস্ট করাতে হয় বলে রোগীরা জানান) মেটাবার পর খাদ্য কেনার মতো যথেষ্ট টাকা তাদের হাতে থাকে না। তাই হাসপাতালের সরবরাহকৃত খাদ্যের উপর তারা নির্ভর করেন। ২৮ এপ্রিল ২০২০ তারিখে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হাসপাতাল ও ক্লিনিক শাখার এক অনুমোদনপত্র থেকে দেখা যায় কোভিড ১৯ হাসপাতালের কোভিড-১৯ আক্রান্ত রোগীদের পথ্য সরবরাহের জন্য দৈনিক ৩০০ টাকা হারে ডায়েট স্কেল অনুমোদিত হয়েছে। সেখানে দেখা যায় সকালের খাবার বাবদ ৯০ টাকা এবং দুপুর ও রাতের খাবার বাবদ মোট ২১০ টাকা ধার্য করা হয়েছে। পত্রে উল্লেখিত সকালের নাস্তায় থাকছে পাউরুটি, কলা, চিনি, ডিম, ফল ও দুধ। দুপুর ও রাতের খাবারে বলা হয়েছে, রুই/কাতল মাছ অথবা মুরগীর মাংস, খাসির মাংস, চাল, মসুর ডাল, সবজি (পেপে+আলু), সয়াবিন তেল, পেঁয়াজ ও লাকড়ি।
অপরদিকে, কোভিড ছাড়া অন্য রোগীদের জন্য বরাদ্দ ১২৫ টাকা। সকালের নাস্তায় ৩৩ টাকা, দুপুর ও রাতের খাবার ৯২ টাকা। সকালের নাস্তায় আছে পাউরুটি, কলা, চিনি ও ডিম। দুপুর ও রাতের খাবারে বলা হয়েছে, রুই/কাতল মাছ অথবা মুরগীর মাংস, চাল, মসুর ডাল, সবজি (পেপে+আলু), সয়াবিন তেল, পেঁয়াজ ও লাকড়ি[২]। জানা যায়, ২০০৯ সালে রোগী প্রতি বরাদ্দ ৪৫ টাকা থেকে ৭৫ টাকা করা হয়। ২০১৩ সালে এই বরাদ্দ বাড়িয়ে করা হয় ১২৫ টাকা। দেখা যাচ্ছে, সরকার প্রতি রোগীর জন্য অর্থ ও একটি সাধারণ মান নির্ধারণ করে দিয়েছে। তবে রোগীর খাবার ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের। খাবারের জন্য প্রতিটি হাসপাতালের নিজস্ব ব্যবস্থাপনা রয়েছে। দরপত্রের মাধ্যমে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ নির্দিষ্ট ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে প্রতিদিনের খাবার সংগ্রহ করে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের জানানো প্রতিদিনের রোগীর সংখ্যার ভিত্তিতে সরবরাহকারী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান আয়োজন করে। তবে কথা হচ্ছে সরকারের বরাদ্দকৃত ১২৫ টাকায় কতটা মানসম্মত খাবার দেওয়া সম্ভব। অনেক ক্ষেত্রে রোগীরা অভিযোগ করে থাকেন, যে মানের খাবার হাসপাতাল থেকে তাদের দেওয়া হয় তার মূল্য ৬০-৭০ টাকার বেশি নয়। ভোরের কাগজের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের (ডিএমসি) পরিচালক বিগ্রেডিয়ার জেনারেল এ কে এম নাসির বলেছিলেন, ২ হাজার ৬শ বেডের হাসপাতালে ৩ হাজার ৭শ থেকে ৩ হাজার ৯শ জন রোগী ভর্তি থাকেন। রোগীদের চারবেলা খাবার দেওয়া হয়। ১২৫ টাকায় রোগীদের চার বেলা এবং রোগভেদে খাবার দেওয়াটা কঠিন কাজ। এ জন্য বরাদ্দ বাড়ানো প্রয়োজন। বরাদ্দ বাড়লে খাবারের মান আরও বাড়ানো যাবে। সেই সঙ্গে খাদ্য তালিকায় নতুন আইটেমও যোগ করা যাবে। রোগীরা তাদের চাহিদা অনুযায়ী প্রোটিন ও ভিটামিন পাবে [৩]।
২০১৩ থেকে ২০২২, নয় বছরে লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়েছে দ্রব্যমূল্য। কিন্তু এই নয় রছরে এক টাকাও বাড়েনি পথ্য বরাদ্দ। সীমিত বাজেটের কারণে রোগীদের জন্য আমিষ, প্রোটিন, ক্যালরি সমৃদ্ধ খাবার যে পরিমাণ ও মাত্রায় চিকিৎসকেরা সুপারিশ করেন এর সামান্যও দেশের অধিকাংশ হাসপাতালের রোগীরা পাচ্ছেন না। রোগ অনুযায়ী খাবার না দিলে রোগীদের জটিলতা বাড়ে। এ ক্ষেত্রে হাসপাতালে আসা দরিদ্র রোগী ও দূরবর্তী এলাকার রোগীরাই বেশি সমস্যায় পড়েন। কেননা, তাদের হাসপাতালের খাবারের উপরই নির্ভর করতে হয়। খাবারের মান বাড়াতে তাই বিশেষজ্ঞরা বাজেট বাড়ানোর উপর জোর দিচ্ছেন।
এরছর অমরা স্বাধীনতার ৫০ বছর উদযাপন করলাম। এই ৫০ বছরে দেশ অনেক ক্ষেত্রে সফলতার স্বাক্ষর রেখেছে। দেশের জিডিপি বেড়েছে, স্কুলগামী শিশুর সংখ্যা বেড়েছে, মাতৃ মৃত্যু, শিশু মৃত্যুর হার কমেছে। সম্প্রতি কোভিড নিয়ন্ত্রণেও বাংলাদেশ সফলতা দেখাতে সক্ষম হয়েছে। গ্লোবাল কোভিড রিকভারি ইনডেক্সে বাংলাদেশের অবস্থান এখন পঞ্চম। ৮০ পয়েন্ট নিয়ে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সর্বোচ্চ অবস্থানে রয়েছে [৪]। এমন একটা অবস্থানে দাঁড়িয়ে আমাদের দারিদ্র পিড়িত দেশের অসহায় রোগাক্রান্ত মানুষগুলোর জন্য একটা পরিপূর্ণ স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে পারি না! আমরা প্রত্যাশা করি প্রতিটি মানুষ হাসিমুখে সুস্থ্য শরীরে হাসপাতাল ছাড়ুক। নিশ্চিত হোক স্বাস্থ্যসেবা, পথ্যের অভাবে যেন কেউ দুর্বল হয়ে না পড়ে, পথ্য ক্রয়ের দুঃশ্চিন্তায় যেন কারো কপালে বলিরেখা দেখা না দেয়, রোগের ভিত্তিতে সব রোগীর পথ্য নিশ্চিত হোক, বজায় থাকুক পথ্যের মান। কোভিড রোগীদের জন্য যেমন ৩০০টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল অন্য সব রোগীরাও সমবরাদ্দের অংশীদার হোক। কোভিডের মতো অন্য সব রোগ থেকেও মুক্তি পাক বাংলাদেশ।
লেখক: ডা. মো. শামীম হায়দার তালুকদার
সি ই ও, এমিনেন্স এসোসিয়েটস ফর সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট
আরএ/
রেফারেন্স:
১. করোনাভাইরাস: সংকট মোকাবেলায় চিকিৎসক-আইসিইউ কতোটা আছে বাংলাদেশে? বিবিসি নিউজ বাংলা: Available: https://www.bbc.com/bengali/news-52018765. Accessed 7 May 2022.
২. Hospital and clinic unit in dghs bd. কোভিড-১৯ হাসপাতালের রোগীদের জন্য দৈনিক তিনশত টাকা হারে অনুমদিত ডায়েট স্কেল প্রেরণ প্রসংগে. Available: http://hospitaldghs.gov.bd/wpcontent/uploads/2020/04/548_20200428.pdf
৩. Bhorer Kagoj. সরকারি হাসপাতালে চার বেলা খাবার ১২৫ টাকায়। [cited 30 Apr 2022]. Available:https://www.bhorerkagoj.com/2018/07/06/
সরকারি-হাসপাতালে-চার-বেলা/
৪. Dhaka Tribune. Global Covid recovery index: Bangladesh ranks 5th in the world. 6 May 2022 [cited 7 May 2022]. Available: https://www.dhakatribune.com/bangladesh/2022/05/06/bangladesh-moves-up-5-notches-on-global-covid-recovery-index