‘পিঞ্জরে বসিয়া শুক’-সুখ?
‘পিঞ্জরে বসিয়া শুক মুদিয়া নয়ন/কি ভাবিছ মনে মনে? অথবা তোমার/ ভাবনার বাস্তবিক আছে অধিকার/পরাধীন বন্দিভাবে রয়েছ যখন …’ এই ‘শুক’ হচ্ছে টিয়া পাখি। ঊনিশের দশকে অজ্ঞাতনামা এক কবির এ ক’টি লাইন টিয়া পাখির প্রতীকে বাংলাদেশের তখনকার মহিলাদের অবস্থা নিয়ে বলা হয়েছে। আবার ‘পিঞ্জরে বসিয়া শুক’ নামে উপন্যাসটি বাংলা ভাষার দুরূহতম কথাসাহিত্যিক কমল কুমার মজুমদারের । মূলত: প্রান্তিক মানুষের জীবনের স্বাভাবিক বিকাশ কিভাবে ধর্মের খাঁচায় বন্দি হয়ে যায় তা-ই এর উপজীব্য।
মূল বিষয়টা হচ্ছে ‘পিঞ্জর’ বা ‘খাঁচা’। সেটা ধর্মের হোক বা কারাগার হোক, যে খাঁচার মধ্যে কেউ থাকুক না কেন সে কি আর বাইরের বাস্তবতা সম্পর্কে বুঝতে পারে? আমাদের সমাজে অর্থের মোহের কাছে তেমনি বন্দি হয়ে আছে অনেকে। তারা অর্থ-অর্থ-এর বাইরে আর কোনো চিন্তা করতে পারে না। যা তাদের স্বাভাবিক জীবনকে অর্থের ঘেরাটোপে বন্দি করে রেখেছে। যা তারা বুঝেও বুঝে না!
এই কথাগুলো মনে এলো এই জন্য যে, সম্প্রতি দুর্নীতির মামলায় আগাম জামিন নিতে গিয়ে হাইকোর্ট, চার জন অতি ধনীকে সরাসরি কারাগারে পাঠিয়ে দিয়েছেন। যা তারা কল্পনাও করতে পারেনি। এজন্য হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট বিচারপতিদ্বয়কে অনেক ধন্যবাদ। কারণ আইনের ফাঁক ফোঁকরে এই ধরনের কথিত ধনীরা অন্যায়, অপকর্ম করেও পার পেয়ে যান! এ যাত্রায় আর সেটা হলো না। নিয়তি তাদের কারাগারে-দুর্নীতির অর্থের ‘সুখ’ খোঁজার সুযোগ করে দিয়েছে হয়তো!
খোলাসা করেই বলি। এই চার জন অতি ধনী হলেন নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম মালিক তথা বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য এম এ কাশেম, বেনজীর আহমেদ, রেহানা রহমান ও মোহাম্মদ শাহজাহান৷ তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের জমি কেনা বাবদ অতিরিক্ত ৩০৩ কোটি ৮২ লাখ টাকা ব্যয় দেখিয়ে তা আত্মসাত করেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়টির ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যানসহ ছয়জনের বিরুদ্ধে ৫ মে মামলাটি করে দুদক। ছয়জনের মধ্যে ওই চারজন আগাম জামিন চেয়ে হাইকোর্টে আবেদন করলে আদালত নামঞ্জুর করে পুলিশে সোপর্দ করে।
এই চার জনই বড় ব্যবসায়ী ও শিক্ষিত। তাদের সম্পদের অভাব নেই। বাড়ি-গাড়ি সবই আছে। তারপরও তারা অবৈধভাবে অর্থ আত্মসাতের সুযোগ হারাতে চায়নি! আরও চাই, আরও চাই। সেজন্য এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ১০ ট্রাস্টি তথা মালিকদের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থে ১০টি বিলাসবহুল গাড়ি কেনা হয়েছিল। পরে অভিযোগের প্রেক্ষিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয় তা বিক্রি করে সেই অর্থ বিশ্ববিদ্যালয়ের তহবিলে জমা দেওয়ার নির্দেশ দেয়।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনে আছে, ‘কোন জনকল্যাণকামী ব্যক্তি, বা প্রতিষ্ঠানের নিঃশর্ত দান-অনুদানে তহবিল গঠন করতে হবে। কোন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ তহবিলের অর্থ উক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রয়োজনীয় ব্যয় ব্যতীত অন্য কোনো উদ্দেশে ব্যয় করা যাইবে না।’
এই সব বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মালিক তথা উদ্যোক্তদের বেশির ভাগই জনকল্যাণের পরিবর্তে কিভাবে নিজেদের কল্যাণ হয় তারই চেষ্টা করে যাচ্ছে। অর্থাৎ দান-অনুদানে বিশ্ববিদ্যালয প্রতিষ্ঠার অর্থ কিভাবে বহুগুণে ফেরত আনা যায় তার ফন্দিফিকিরে ব্যস্ত। তারা তাদের সামাজিক মর্যাদারও তোয়াক্কা করে না। অবশ্য আমাদের সমাজ, কিছু টাকা পেলেই এসব দুর্নীতিবাজদের মাথায় তুলে রাখে! শুধু নর্থ সাউথ নয়, আরও বহু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে অনিয়ম, দুর্নীতি, মালিকানা নিয়ে দ্বন্দ্ব, হামলা-মামলা চলছে একই উদ্দেশে। জনকল্যাণের ইচ্ছে যদি তাদের না থাকে বা টাকা কামানোই মূখ্য উদ্দেশ্য হয়, সেক্ষেত্রে তারা অন্য কোনো ব্যবসা খুঁজে নিতে পারতেন। তা না করে দুর্নীতির মাধ্যমে তারা শিক্ষাকে কলুষিত করছে। তাই তাদের যথাযথ শাস্তি হওয়া প্রয়োজন।
বাইরের দেশগুলোতে কি দেখি? সেখানকার বেশির ভাগ ধনী তাদের সম্পদের অনেকাংশ জনকল্যাণেই দান করে দেয়। মার্কিন ধনী বিল গেটস, ওয়ারেন বাফেটসহ অনেকে ইতোমধ্যে তাদের সম্পদের অর্ধেকেরও বেশি জনকল্যাণে দান করে দিয়েছেন। তারা ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা করে বা বিভিন্ন সংস্থার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের বৃত্তি, গবেষণাসহ নানা কল্যাণমূলক কাজে অর্থ ব্যয় করছে। তারা চিন্তাও করে না নিজেদের গড়া এসব প্রতিষ্ঠান থেকে ভিন্ন পথে বহুগুণ আয় তুলে আনবে!
আর আমাদের দেশের বেশির ভাগ ধনী তার উল্টো। তারা নিজে ও পরিবারের বাইরে কিছু চিন্তা করে না। সেজন্য অগাধ সম্পদ থাকলেও তাদের যত সব কৃপণতা জনকল্যাণের স্বার্থে কিছু ব্যয় করতে। এতে বুঝা যায়, এখানকার সেই ধনীরা সৎ পথে সম্পদ অর্জন করেনি। অবৈধ যে কোনো উপায়েও সম্পদ গড়ার মোহে তারা আচ্ছন্ন। আর এই মোহ থেকে তাদের উদ্ধারের কি কোনো উপায় আছে? সন্তান-সন্ততি তথা পরিবারের কাছেই বা তারা কি ভাবমূর্তি রেখে যাবে?
অপরদিকে, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে দেশের অন্যতম সেরা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে শিক্ষার্থীদের বহু টাকা খরচ করতে হয়। উদ্যোক্তাদের দুর্নীতি এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সুনাম ক্ষুণ্ন করেছে। এতে শিক্ষার্থীরা এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্টিফিকেট নিয়ে নৈতিকতার দিক থেকে বিপন্ন বোধ করতে পারেন। অথবা কেউ কেউ হতে পারে প্রভাবিতও। আবার কারো কারো জীবনের চলার পথে এক প্রশ্নবোধক!
ইব্রাহিম আজাদ: লেখক ও সাংবাদিক
আরএ/