নতুন কারিকুলাম নিয়ে হাঁকডাক বোধ হয় একটু বেশি হচ্ছে
বাংলায় একটি প্রবাদ আছে ‘যত গর্জে তত বর্ষে না’। একটি দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় কারিকুলাম একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বলা যায় এটি শিক্ষাব্যবস্থার দিক নির্দেশনা। সেটি হতে হয় যুগোপযোগী। এটি হঠাৎ করার কোনো বিষয় নয়, আমূল পরিবর্তন করাও নয়। আমাদের কৃষ্টি, কালচার, ইতিহাস, ঐতিহ্য, মুক্তিযুদ্ধ, অভ্যাস সবই কারিকুলামের অন্তর্ভুক্ত ছিল, আছে এবং থাকবে। এর কোনোটিই পরিবর্তন করা যাবে না।
প্রণীত কারিকুলাম বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে পরিবর্তন হয়। কারিকুলামের লক্ষ্য অর্জনের জন্য যে বই-পুস্তক তৈরি করা হয় সেখানে কিছু পাঠ পরিবর্তন করা, সেখানে কিছু সংযোজন করা, পরিমার্জন করা, সেগুলোর মেসেজ ডিসেমিন্টে করা, সেগুলো মূল্যায়ন করার ক্ষেত্রে পরিবর্তন হয়। এগুলো সবই স্বাভাবিক এবং অবিরত প্রক্রিয়া। কিন্তু বর্তমান কারিকুলামে যেসব বিষয় নিয়ে আলোচনা হচ্ছে সেটি রাজনৈতিক একটি খেলার মতো। এমনভাবে প্রচার করা হচ্ছে যে, যেসব বিষয় কারিকুলামে আসতেছে সেগুলোর সঙ্গে চলতি কারিকুলামের কোনো মিল নেই, এবং এটি আর জীবনেও পরিবর্তন করার প্রয়োজন হবে না। এখানেই ভয়। ঘটা করে এত প্রচারের কি আছে এখানে? এরশাদ আমলে আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছিলাম। এরশাদ প্রায় প্রতিদিনই বলতেন ‘এসব দু’শো বছরের পুরনো নিয়ম-কানুন পরিবর্তন করা হচ্ছে।’ আসলে কি পরিবর্তন করা হয়েছে আমরা সবাই জানি।
বর্তমান যুগ দ্রুতই পরিবর্তিত হচ্ছে। এ যুগ কম্পিউটারের যুগ, ইন্টারনেটের যুগ, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার যুগ। ইচ্ছে করলেও কেউ এগুলো থেকে দূরে থাকতে পারবেনা। পড়াশুনার ক্ষেত্রের সঙ্গে এগুলোর সংযোগ অবশ্যই থাকবে ও এগুলোর প্রভাব অবশ্যম্ভাবী। শিক্ষার্থীরা এখন শিক্ষকের দেওয়া নোট কিংবা নোট বইয়ের পাতায় সীমাবদ্ধ থাকেনা, তারা হাতের মোবাইল টিপে দেখে নেয় কোন একটি বিষয়ের উপর কি কি আলোচনা আছে, কি কি ব্যখ্যা আছে। এই অবস্থাগুলো প্রাতিষ্ঠানিকভাবে পরিবর্তন করলেও কিংবা না করলেও শিক্ষার্থীরা এগুলোর আশ্রয় নেবে, এগুলোতে অভ্যস্ত হবে এবং কেউ কেউ এগুলো ব্যবহারে দক্ষ হবে। এ নিয়ে ঘটা করে বলার কিছু নেই।
আমাদের প্রাথমিকে কারিকুলাম বেশ একটি দীর্ঘ সময় ধরে ‘দক্ষতাভিত্তিক’ ছিল, এখনও তাই আছে। বিষয়ভিত্তিক কিংবা সার্বিক যে দক্ষতা তাদের অর্জন করার কথা দেখা গেছে তার অর্ধেক, কোন কোন বিষয়ে তারও কম দক্ষতা অর্জন করছে পঞ্চম পাস করা শিক্ষার্থীরা। মাধ্যমিকের কারিকুলাম ‘আউটকাম বেইজড’। দেখা গেল প্রাথমিকের শিক্ষার্থীদের কাঙ্ক্ষিত দক্ষতা অজিত হচ্ছে না, মাধ্যমিকের শিক্ষার্থীদের যে আউটকামে পৌঁছানোর কথা তার ধারের কাছে নেই অনেকেই। শুধু গ্রেড পাচ্ছে, আর পাসের হার বাড়ছে। অতএব, মহা উৎসাহে আমদানি করা হলো ‘তথাকথিত সৃজনশীল প্রশ্ন’। এবার শিক্ষার্থীরা পুরোপুরি উল্টে যাবে, উল্টে যাবে প্রাচীন সব ধ্যান ধারণা। দেখা গেল সৃজনশীল প্রশ্ন পুরনো ধাচের প্রশ্নের কাছে ধরা খেয়ে তার কাছে মিশে গেছে। হয়েছে এক মহা হ-য-ব-র-ল। তার আগে প্রশ্নব্যাংক আর মাল্টিপেল চয়েস অর্থাৎ টিকমারা কোশ্চেন দিয়ে যে, হ-য-ব-র-ল করা হয়েছিল তার খেসারত কিন্তু শিক্ষার্থীরা এখনও দিচ্ছে এবং শিক্ষাব্যবস্থায় তার রেশ এখনও কাটেনি। সেটি কাটতে আরও বহু সময় লাগবে।
২০১৯ সাল থেকে শুনে আসছি আমাদের কারিকুলামে বিপ্লব ঘটতে যাচ্ছে এবং ক’দিন পর পর সমস্ত পত্রিকায় বড় বড় হেডিং দেখি। অন্যান্য মিডিয়াতেও বিশাল আলোচনা, সয়লাব হচ্ছে চারদিক। মোবাইলে মেসেজ আসতেছে—মহা কিছু হতে যাচ্ছে কারিকুলামে। কিন্তু কি হতে যাচ্ছে আসলে? প্রথম থেকে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত বিদ্যালয়েই ধারাবাহিক মূল্যায়ন হবে। চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণিতে শিখনকালীন মূল্যায়ন হবে ৬০ শতাংশ, ৪০ শতাংশ মূল্যায়ন হবে ক্লাস শেষে পরীক্ষার মাধ্যমে। যষ্ঠ ও অষ্টম শ্রেণিতে বিদ্যালয়ে ধারাবাহিক মূল্যায়ন হবে ৬০ শতাংশ, সামষ্টিক মূল্যায়ন হবে ৪০ শতাংশ। নবম দশম শ্রেণিতে কয়েকটি বিষয়ে শিখনকালে অর্ধেক মূল্যায়ন এবং বাকি অর্ধেক সমাষ্টিক মূল্যায়ন হবে। প্রকৃত মূল্যায়নই হচ্ছে ‘ধারাবাহিক মূল্যায়ন’ কারণ সামষ্টিক মূল্যায়ন শিক্ষার্থীদের সব দিক সঠিকভাবে মূল্যায়ন করতে পারেনা। এটি জানা সত্ত্বেও বহু দেশে সামষ্টিক মূল্যায়নই চলছে বহু বাস্তব কারণে। আমাদের দেশও এর ব্যতিক্রম নয়। ধারাবাহিক মূল্যায়নের কথা শিক্ষা সংশ্লিষ্ট প্রায় সবাই জানেন এবং এটি করতেও চান কিন্তু করা হচ্ছে না। কারণ বহুবিধ। এখানে পদ্ধতি, পদ্ধতির সঙ্গে শিক্ষকের মোটিভেশন, দক্ষতা আর প্রশাসনিক বিষয় জড়িত। শুধু যদি প্রচার করি বা কথায় কথায় বলি যে, ৬০ শতাংশ হবে ধারাবাহিক মূল্যায়ন। সেটিতো হবে ‘স্কুল বেজইড অ্যাসেসমেন্ট বা এসবিএ’ এর মতো। এসবিএ’র করুণ পরিণতির কথা আমরা নিশ্চয়ই ভুলে যাইনি। তাই বলছি, এত ঘটা করে বলার কি আছে? ধারাবাহিক মূল্যায়নের একটি শতাংশ লিখে ফেললাম, আর সব পরিবর্তন হয়ে গেল?
নতুন কোনো পদ্ধতি চালু করার পর বিশাল অংশের এক শিক্ষক কিন্তু তা রপ্ত করতে পারেন না। আমাদের মনে আছে ইংরেজিতে কমিউনিকেটিভ পদ্ধতি চালু করা হয়েছে সেই প্রায় ১৯৯৮-৯৯ সালে, সেটি কিন্তু স্বপ্নই রয়ে গেছে। যে উদ্দেশে কমিউনিকেটিভ পদ্ধতি চালু করা হয়েছে তার ধারে কাছেও কিন্তু নেই শিক্ষার্থীরা। বরং তারা খুইয়েছে গ্রামারের দক্ষতা আর ফ্লুয়েন্সি দুটোই। ইতোমধ্যে মাধ্যমিক পর্যায়ের ৬২টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নতুন শিক্ষাক্রমের পাইলটিং চলছে। পাইলটিং কার্যকলাপ কি রকম চলছে , কি অভিজ্ঞতা অর্জিত হচ্ছে, কী কী চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হচ্ছে এগুলো বেশি বেশি আলোচনায় আসা উচিত। জাতির সামনে তুলে ধরা উচিত। তারপর যৌথ সিদ্ধান্ত হবে কিভাবে ধীরে ধীরে কোথায় কিভাবে পরিবর্তন আনা হবে। আমাদের শিক্ষার্থীদের অবস্থা, শিক্ষকদের অবস্থা, শ্রেণিকক্ষ—এগুলোর মধ্যে কোথায় এতবড় বিপ্লব ঘটাবো? দেশের বিভিন্ন স্তরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে উপকরণ, ম্যানেজিং কমিটি, দক্ষ শিক্ষক সংকটের কথা কারোরই অজানা নয়।
২০২৩ সালে নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন শুরু হতে যাচ্ছে বলে চারদিকে আলোচনা প্রচারণা চলছে। শিক্ষার্থীদের জন্য আনন্দঘন শিক্ষা নিশ্চিত করতে এ শিক্ষাক্রম তৈরি করা হয়েছে বলে সংশ্লিষ্টরা বলছেন। এগুলো আমার কাছে রাজনৈতিক বক্তব্যের মতো মনে হয়। কারণ সবাই যখন বলাবলি করছেন যে, আমাদের শিক্ষায় আনন্দ নেই, শিক্ষার্থীরা আনন্দ পাচ্ছে না, পড়াশুনা তাদের কাছের পাহাড়ের মতো। তাই মনে হচ্ছে এর বিপরীতে কথা বললেই জনপ্রিয়তা আসবে। শ্রেণিকক্ষে আনন্দটা দেবে কে? কিভাবে সেটি নিশ্চিত করতে হবে? কারিকুলাম তৈরি করার নোটে লিখে রাখলেই শিক্ষার্থীদের আনন্দ দেওয়া যাবে? ২০২৩সালে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেনি, ৬ষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের মাধ্যমে শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন শুরু হবে। ২০২৪সালে তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণি এবং অষ্টম ও নবম শ্রেণি এ শিক্ষাক্রমের আওতায় আসবে। ২০২৫সালের মধ্যে সব শিক্ষার্থীকে এ শিক্ষাক্রমের আওতায় নিয়ে আসা হবে। নবম ও দশম শ্রেণিতে বিজ্ঞান, বাণিজ্য ও মানবিক বিভাগের বিভাজন থাকছেনা। মুখ¯’নির্ভর শিক্ষা থেকে সরে এসে অভিজ্ঞতানির্ভর শিক্ষায় প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। প্রাক-প্রাথমিক থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের জন্য একটি নিরবচিছন্ন ধারাবাহিক শিখন নিশ্চিত করা হচ্ছে। পরীক্ষার বিষয় ও পাঠ্যপুস্তকের চাপ কমানোর চেষ্টা করা হয়েছে। শিক্ষার্থীরা যাতে নিজেদের মতো কিছুটা সময় কাটাতে পারে তা নিশ্চিত করতেই নতুন কারিকুলাম। ষষ্ঠ শ্রেণিতে শিক্ষার্থীদের কারিকুলামে একটি কারিগরি বিষয় অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে। একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণিতে ৩০ভাগ শিখনকালীন ও ৭০ভাগ সামষ্টিক মূল্যায়ন হবে। পিএসসি ও জেএসসি পরীক্ষা থাকছে না। এটি আমাদের মূল শিক্ষানীতিতেও নেই। হঠাৎ এসে জুড়ে বসেছিল। অধিকাংশ লোকই পছন্দ করেনি। উপরোক্ত কথাগুলো সবই পজিটিভ, সবই আনন্দের সংবাদের মতো মনে হয়। যেসব জায়গায় শিক্ষার্থীদের সমস্যা ছিল সব জায়গাতেই যেন বলা হচ্ছে কোনো সমস্যা থাকবে না, সব দূর করা হবে, সব সমাধান করা হবে যেমনটি নির্বাচনে দাঁড়ানোর আগে একজন প্রার্থী বলে থাকেন। তারপর সমাধান কতটা হয় তাতো আমরা জানি।
যে কোনো পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর জন্য, নতুন পদ্ধতিতে শিক্ষাদানের জন্য, শিক্ষার্থীদের অভ্যস্ত করার জন্য প্রয়োজন শিক্ষকদের নিজেদের উৎসাহ, প্রয়োজন তাদের সেলফ মোটিভেশন, প্রশিক্ষণ দিয়ে এসব জায়গায় বড় পরিবর্তন আনা খুব কঠিন। শোনা যাচ্ছে মাস্টার ট্রেইনার তৈরি করা হবে প্রতিটি উপজেলায়, তারা প্রশিক্ষণ প্রদান করবেন অন্যান্য শিক্ষকদের, তারপর তারা নতুন পদ্ধতির সঙ্গে পরিচিত হবেন। এটি করতে গেলে অজানা থেকে যাবে নতুন পদ্ধতি, যেমনটি হয়েছে ক্রিয়েটিভ প্রশ্নপত্রের ক্ষেত্রে, কমিউনিকেটিভ ইংরেজির ক্ষেত্রে, মাল্টিপল চয়েস প্রশ্নের ক্ষেত্রে, স্কুল বেইজড অ্যাসেসমেন্টের ক্ষেত্রে, সৃজনশীল প্রশ্নের ক্ষেত্রে। সবশেষে যেটি বলতে চাচ্ছি অতি বেশি উৎসাহ না দেখিয়ে, বড় আকারে শোডাউনের জন্য হাঁকডাক না করে পূর্বের অভিজ্ঞতা এবং বাস্তবতার সমন্বয় ঘটিয়ে শুধু কাজ করাটাই বোধ হয় বেশি ভাল ছিল। কাজ ফল বয়ে আনবে, প্রচার নয়।
লেখক: (শিক্ষা বিশেষজ্ঞ ও গবেষক) ব্র্যাক শিক্ষা কর্মসূচিতে কর্মরত সাবেক ক্যাডেট কলেজ ও রাজউক কলেজ শিক্ষক।
প্রেসিডেন্ট: ইংলিশ টিচার্স এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ইট্যাব)
আরএ