মুক্ত গণমাধ্যমের প্রত্যাশা
মানুষ কথা বলতে চায়। প্রকাশ্যে কথা বলতে না পারলে গোপনে বলে। উচ্চস্বরে বলতে ভয় পেলে ফিসফিস করে বলে। সরাসরি বলতে না পারলে ঘুরিয়ে পেচিয়ে বলে। শ্রদ্ধা ভক্তি হারালে ব্যঙ্গ করে বলে আর বিশ্বাসযোগ্য তথ্য না পেলে গুজবের বিস্তার ঘটায়। একসময় হলি রোমান আম্পায়ার সম্পর্কে বলা হত ইট ইজ নট রোমান ইভেন্ট এন্ড আম্পায়ার অলসো। বাংলাদেশের গণমাধ্যম স্বাধীন নয়। এমন কথা বলা যাবে যে, এটা ঠিক গণচরিত্রের নয়, সংবাদ মাধ্যম হিসেবে কার্যকারিতা হারাচ্ছে আর এর স্বাধীনতা প্রায় বিপন্ন। প্রায় শব্দটার বহুল ব্যবহার তথ্য সঠিকতার অভাব থেকে নয়, শব্দটার ব্যবহার বেডে়ছে। সতর্কতা হিসেবে। বিপদ তাড়াতে না পারলেও বিপদ এড়াতে কে না চায়। কিন্তু পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে, অনেকেইে ব্যঙ্গ করে লিখেছিলেন, আমার মন খারাপ এই কথাটা লেখার কারণেও নাকি এখন বিপদ নেমে আসতে পারে। মুজতবা আলী কৌতুক করে একটি কথা বলেছেন, মনে আছে নিশ্চয়ই। হিটলারের জামানায় জার্মানিতে একজন আর একজনকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, কিরে তুই নাকি দাঁতের ডাক্তারি পড়া দিয়েছিস। উত্তরে বলেছিল, কী আর করব? কেউ তো মুখ খুলতেই চায় না।
কোনো দেশে গণমাধ্যম কতটুকু মুক্ত বা কতখানি স্বাধীনতা ভোগ করে তা থেকে সেই দেশের গণতান্তিক পরিবেশ সর্ম্পকে ধারণা পাওয়া যায়। বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবসে রিপোর্টারস উইদাউট বর্ডারস (আরএসএফ) ২০২২ সাল শেষে প্রতিবেদন প্রকাশ করে তাতে দেখা যায়, ১৮০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৬২তম (স্কোর ৩৬ দশমকি ৬৩)। রিপোর্ট অনুযায়ী বাংলাদেশ পিছিয়েছে দশ ধাপ, অর্থাৎ ঝুঁকি বেড়েছে আগের বছরের তুলনায় বেশি। ২০২১ সাল সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১৫২তম (স্কোর ৫০ দশমকি ২৯)। আর ২০২০ সালের সূচক বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১৫১তম। র্অথাৎ গত দুই বছর আগের সূচকেও বাংলাদেশের এক ধাপ অবনতি হয়েছিল।
আর এবারের সূচকে প্রতিবেশি দেশগুলোর মধ্যে মিয়ানমার ছাড়া সবার নিচে বাংলাদেশের অবস্থান। সূচকে বাংলাদেশের চেয়ে তুলনামূলকভাবে ভালো অবস্থানে রয়েছে ভারত (১৫০), পাকিস্তান (১৫৭), শ্রীলঙ্কা(১৪৬), আফগানিস্তান (১৫৬), নেপাল (৭৬), মালদ্বীপ (৮৭), ভুটান (৩৩)। এখান থেকে বুঝা যায় গত বছররে তুলনায় শুধু বাংলাদেশ পিছিয়েছে তাই নয়, এই অঞ্চলের দেশগুলোর সকলের অবস্থান উদ্যেগজনক। সামরিক শাসনে থাকা মিয়ানমারে্র অবস্থান এবার ১৭৬, গত বছর ছিল ১৪০। এবারে্র সূচকে ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, আফগানিস্তান ও মালদ্বী্পের অবস্থা্নেরও অবনতি হয়েছে। ভারত পিছিয়েছে আট ধাপ, পাকিস্তান পিছিয়েছে ১৭ ধাপ, শ্রীলঙ্কা ১৯ ধাপ, আফগানিস্তান পিছিয়েছে ৩৪ ধাপ আর মালদ্বীপ পিছিয়েছে ১৫ ধাপ। এই দেশগুলো পিছালেও কেউ কি উন্নতি করেনি? উন্নতি হয়েছে। দুটি দেশের যেমন উন্নতি হয়েছে ভুটান ৩২ ধাপ এগিয়েছে আর নেপাল এগিয়েছে ৩০ ধাপ। ঢাকার বাসে হেলপাররা যেমন বলত, পিছন দিকে এগিয়ে যান। বাংলাদেশও কি তেমনি পিছন দিকে এগিয়ে?
সব খবর যেমন জানা যায় না, সব খবর তেমন প্রচারিত হয় না। তবে যতটুকু তথ্য আছে বিশ্লেষণ করে সেন্টার ফর গভর্নেন্স স্টাডিজ গবেষণা করে জানিয়েছে, ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি র্পযন্ত ২৬ মাসে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে ৮৯০টি মামলা হয়। প্রথম ১৫ মাসে গড়ে ৬০ জনের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছিল আর পরর্বতী ৯ মাসে গড়ে ১৪৭ জনের বিরুদ্ধে মামলা হয়। আর একক গোষ্ঠী বা সম্প্রদায় হিসেবে সাংবাদকিদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। জরিপ থেকে ১৩ দশমিক ৬৮ শতাংশ মামলা হয়েছে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে। রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে ১৩ দশমিক ৩৯ শতাংশ, বেসরকারি চাকরিজিীবী ২ দশমিক ১৮ শতাংশ, ব্যবসায়ী ২ দশমকি ১৮ শতাংশ, সরকারি চাকরিজীবী ১ দশমকি ৭৫ শতাংশ ও আইনজীবী শূন্য দশমিক ৪৪ শতাংশ। মামলা করা হয়েছে যাদের বিরুদ্ধে তারা বিভিন্ন পেশার মানুষ হলেও মামলা যারা করেছেন র্অথাৎ বাদীরা প্রায় সবাই ক্ষমতাসীন কোনো সংগঠনের নেতা-র্কমী অথবা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনিীর সদস্য। এই আইন সম্পর্কে শুরু থেকেইে আপত্তি ছিল। ২০১৮ সালে নির্বাচনের আগে আইনটি জারি করার সময় সরকার একাধিক মন্ত্রী বলেছিলেন, ডিজিটিাল মাধ্যমে অপরাধ দমন করতেই ডিজিটিাল নিরাপত্তা আইন প্রণয়ন করা হচ্ছে।
নিশ্চিন্তে থাকুন,সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে এই আইন ব্যবহার করা হবে না। কিন্তু তারা যে কথা রাখেন না, উপরের পরিসংখ্যান দেখলে তা বুঝতে অসুবধিা হবে না কারও। শারীরিক হামলা, চাকুরীর অনিশ্চয়তাতো আগে থেকেই ছিল এখন যুক্ত হয়েছে আইনগত হয়রানি।
দৃষ্টান্ত দেখলেই বুঝা যায়, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন কীভাবে সাংবাদিক তথা নাগরিকদের হাত-পা বেধে দেয়। ডিজিটাল মাধ্যম ব্যবহার করে আক্রমণাত্মক, মিত্থা, ভীতিপ্রর্দশক তথ্য-উপাত্ত প্রকাশ, মানহানিকর তথ্য, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত, আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটানো, ঘৃণা প্রকাশ, অনুমতি ছাড়া ব্যক্তিগত তথ্য সংগ্রহ, প্রকাশ ব্যবহার করলে দোষী ব্যক্তির ৩ থেকে ৭ বছরের কারাদণ্ড, জরিমানা উভয় দণ্ডের বিধান রয়েছে এই আইনে। যেকোনো আইন যদি এই উদ্দেশেই করা হয় যে, গণতান্ত্রিক অধিকার সংকুচিত করা হবে তাহলে সেই আইনকে গণতান্ত্রকি বলা যায় না। এই আইনটি বেশির ভাগ ধারা জামিন অযোগ্য। গ্রেপ্তারের ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই আদালতে হাজির করে তাকে কারাগারে প্রেরণ করা হয়, ফলে অভিযুক্ত ব্যক্তি কারাগারে থেকে প্রমাণ করতে হয় তিনি নিরপরাধ। আবার এটাও দেখা এ পর্যন্ত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে যাদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে, খুব কমক্ষেত্রেইে তাদের বিচার হয়েছে। অর্থাৎ বিচার করা এ আইনের প্রধান উদ্দশ্য নয়; মূল্য উদ্দেশ্য হলো ভয় পাইয়ে দেওয়া।
অর্থাৎ এই আইনের মাধ্যমে এক ধরনরে ভয়ের সংস্কৃতি তৈরি করা হয়েছে এবং সে উদ্দেশে অনেকাংশেই সফল হয়েছে। ক্রমাগত ভয় দেখানোর ফলে এখন নিজের থেকে ভয় পাওয়ার সংস্কৃতি দিন দিন শক্তিশালী হচ্ছে ।
সামগ্রকিভাবে যেটি গণতান্ত্রিক পরিবেশকে দুর্বল করে দিয়েছে। রাষ্ট্রের তিনটি স্তম্ভ। আইন সভা বা সংসদ যেখানে আইন প্রণীত হয়, বিচার বিভাগ যেখানে আইন অনুযায়ী বিচার করা হয়, প্রশাসন যা রাজনতৈকি সিদ্ধান্ত অনুযায়ী কর্ম সম্পাদন করে এই তিনস্তম্ভের উপর ভর করে রাষ্ট্র দাঁড়িয়ে থাকার কথা। কিন্তু আইন যদি গণতান্ত্রিক না হয়, বিচার বিভাগ যদি যথাযথ দায়িত্ব পালন না করে, প্রশাসন জনগণের উপর নিপীড়ন হাতিয়ার হয়ে উঠে তাহলে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয় জনসাধারণ। তখন সংবাদ মাধ্যম হয়ে উঠে সমাজের ভারসাম্য রক্ষার অন্যতম হাতিয়ার। যে কারণে সংবাদ মাধ্যমকে বলা হয় রাষ্ট্রের চর্তুথ স্তম্ভ। সংবাদ মাধ্যম যদি আতঙ্কে থাকে আর সংবাদকর্মীরা যদি ঝুঁকিতে থাকে তাহলে সমাজের ভারসাম্য নষ্ট হওয়ার বিপদ এড়ানো যাবে না কোনোভাবেই।
লেখক: সদস্য, কেন্দ্রীয় কমিটি, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ)