পরিকল্পনা এবং বাস্তবায়নে অসংগতি পরিবেশ দূষণের মূল কারণ
প্রথমত আমি মনে করি যে, পৃথিবীর এমন কোনো জটিল সমস্যার মধ্যে আমরা নেই, যেটির কোনো সমাধান আমাদের কাছে নেই। সব কিছুরই সমাধান আছে। যে বিষয়টি নিয়ে আমরা কথা বলছি, অর্থাৎ ঢাকা শহরের বায়ুদূষণ, শব্দদূষণ, পানিদূষণ ইত্যাদিসহ আজকের ঢাকা যে মানুষের বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়ছে, সে বিষয়েও আমরা প্রচুর কথা বলেছি, সমাধানের পথ খুঁজে বের করেছি। কিন্তু সুষ্ঠু সমাধান কিন্তু আজ অব্ধি হয়নি। যারা কথা বলছেন এবং যারা কথা শুনছেন তারা কিন্তু কথা ও কাজগুলোকে একীভূত করার বিষয়ে কিছু বলছেন না।
এই যে ঢাকা শহরে জলাবদ্ধতার কথাই যদি বলা হয়, সবাই জানে আমাদের জলাধারগুলোকে উদ্ধার করে খালের যে নেটওয়ার্কগুলো রয়েছে, সেটি উদ্ধার করে নদীর সঙ্গে কানেক্টিভিটি নিশ্চিত করা দরকার ছিল। যদিও তখন আমাদের পরিকল্পিত নকশা হয়ত ছিল না, তারপরেও কিছু কিছু জলাধার তারা সংরক্ষণ করেছিলেন। সমস্ত কিছু এখন বেদখল হয়ে ভরাট হচ্ছে। আমরা এগুলোর বিরুদ্ধে আলাপ আলোচনা করলাম, ডকুমেন্টারি করলাম, অনেক গল্প করলাম। কিন্তু একটিও কাজ করলাম না। এর কারণ, এই বিষয়গুলো যারা শাসক শ্রেণি অর্থাৎ ধনী ব্যবসায়ী তাদের সবার নিজস্ব স্বার্থের বিষয়। এভাবে চললে এখান থেকে বেরুবার কোনো পথ আছে কি না, আমার জানা নেই। সঠিক পথ অবলম্বন করতে পারছি না বলে আজকের এই দুরাবস্থা।
আমরা যদি ঢাকা শহরের যানজটের দিকে তাকাই, এ বিষয়ে তিনটি জিনিস আমি বলেছি। কোনো ম্যাজিকের আমাদের দরকার নেই। আমাদের দৈনন্দিন চলাফেরার পরিস্থিতিতে প্রায় সোয়া চারকোটি ট্রিপ তৈরি হয়। ট্রিপ মানে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যাওয়া। এই চারকোটি বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে যে,আমাদের অতি ঘনত্বের ঢাকা অন্য কোনো শহর থেকে সরাসরি কপি করে সমাধান করা যাবে না। বরং অনেকগুলো দেশের সুন্দর কিছু সমাধান আছে যেটি হলো মৌলিক কিছু বিষয় আমাদের সমাধান করতে হবে। তা হলো, ব্যক্তিগত গাড়ি, ব্যক্তিগত যান সেটিকে পরিহার করে অথবা নিয়ন্ত্রণ করে, গণপরিবহনের উপর ভিত্তি করে সেটিকে সাজানো। অর্থাৎ পুরো শহরে বাস অথবা এ ধরনের যানবাহন অগ্রাধিকার পাবে, ফুটপাতগুলো ১৫ফিটের নিচে একটিও হবে না। প্রাইভেটকার একটু কস্ট করে হলেও এক লেন অথবা দুই লেনের মধ্যে যাবে। এটি পরীক্ষা নিরীক্ষা করার জন্য দেওয়া হলে সেটি করে ড্রয়িং ডিজাইন করে এনিমেশন করে দেখিয়েছি যে, এটি সম্ভব। কিন্তু কেউই এই পথে হাটতে রাজি না! যদিও সবাই জানে ৯ শতাংশ থেকে ১০ শতাংশ লোক প্রাইভেটকারে চড়ে না। ৯০ শতাংশ লোককে অসহায়ের মতো, এই ব্যক্তিগত গাড়ির মালিকদের কাছে সমর্পণ করলে সমাদর কোথা থেকে আসবে। কেন আমরা করোনার মধ্যে মোটরসাইকেলের মতো একটি যানকে গণপরিবহন বানালাম? যেখানে মাত্র দুটি লোক। যেখানে একটি বাস দিয়ে ৫০টি মোটর সাইকেল রিপ্লেস করা যেতে পারে।
এই যে অপরিকল্পিত একটি ব্যবস্থা সেটি দূরীকরণে কাজ না করে শুধুমাত্র আলোচনা করে কোনো লাভ নেই। ইমাম সাহেব বলবেন আর আপনি টুপিটা মাথায় দিয়ে শুনে এসে যা খুশি তাই করবেন তা হবে না। তাহলে আপনি কি আশা করেন? কাজেই আমি পরিষ্কার ভাষায় বুঝি আমাদের কথা ও কাজের মধ্যে সংগতি না থাকাটিই একটি সমস্যা। পরিকল্পনা এবং বাস্তবায়নের মধ্যে সংগতি না থাকাটাই সমস্যা। সংখ্যার দিক থেকে গরিষ্ঠকে লঘিষ্ঠের হাতে পরাভূত করার মধ্য দিয়েই আজকে এই সব সমস্যার সমাধান না হওয়া। এখানে শাসন চলছে সংখ্যা লঘিষ্ঠের এবং তারা সংসদে ভরে আছে। তারা বিভিন্ন পদে আছে। প্রাইভেটকার যারা চড়েন, তারাই আসলে দেশ চালান। তারাই সচিব। তারাই বি আর টি আই এর চেয়ারম্যান। দুষ্টের পালন এবং শিষ্টের দমনেরও একটি প্রক্রিয়া এক্ষেত্রে চলছে। পরিষ্কার কথা আমরা জানি কি করতে হবে, কিন্তু না করার মধ্য দিয়েই আমরা আজকে এরকম একটি পরিস্থিতির মধ্যে আছি।
আমি মনে করি, যেখানে সমাধান আছে সেটি করা সম্ভব না হলে আমি হতাশ। কিন্তু যেখানে সমাধান আছে সেখানে সমাধান না করা অসভ্যতা। আমরা জীবন যাপনে একটি অসভ্যতার নিয়মনীতির মধ্যে বসবাস করছি। আমি এই অসভ্যতাকে অসহায়ত্বের চাদরে আবৃত করতে চাই না।
লেখক: নগর পরিকল্পনাবিদ ও স্থপতি
আরএ/