প্রশ্নবিদ্ধ বিজেপি-বিরোধী জোট এবং একজন ‘পিকে’
কৃষক আন্দোলনের কাছে পরাজিত আদানি-আম্বানির টাকায় ভোটে লড়া বিজেপি পরদিনই গদি মিডিয়াদের নামিয়ে দিয়েছে মাঠে। এই টিভি চ্যানেলে তৃণমূলের মূল উপদেষ্টা ভোট ব্যবসায়ী প্রশান্ত কিশোর পান্ডে মোদির বিরাট প্রশংসা করে বলেছেন, ৪৫ বছরের রাজনৈতিক জীবনে [১৫ বছর আরএসএসের (রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ) প্রচারক] মোদির যা অনুভব ও মানুষ সম্পর্কে অভিজ্ঞতা, ভারতে এই মুহূর্তে আর কারও নেই। তিনিই দেশটির সবচেয়ে শক্তিশালী রাজনৈতিক নেতা।
আবার এদিকে যথারীতি কংগ্রেসকে আক্রমণ করে পান্ডে বলেন, তার কংগ্রেসে যোগদান প্রায় চূড়ান্ত হয়ে গিয়েছিল; কিন্তু শেষ মুহূর্তে কোনো কারণে হয়নি। হয়তো কংগ্রেস নেতৃত্ব তার মতলব বুঝে দলে নেয়নি। সেইসঙ্গে প্রশান্ত কিশোরের মত, ২০১৪ সালের পর কংগ্রেস আর একা ক্ষমতায় আসেনি। এই কংগ্রেসকে দিয়ে আর কিছু হবে না।
প্রশ্ন হলো–তাহলে কাকে দিয়ে হবে? তৃণমূলকে দিয়েই হবে। তাই তৃণমূলকে দিয়ে বিজেপিকে পরাজিত করা যাবে বলে পান্ডে আর তার সঙ্গীরা কোটি কোটি টাকা প্রচারে খরচ করছে। পান্ডে চান, তৃণমূলের নেতৃত্বে বিজেপি বিরোধী জোট।
তার আসল নাম প্রশান্ত কিশোর পান্ডে, বিহারি ব্রাক্ষণ। ‘পিকে’ নামে পরিচিত। এখন প্রশ্ন হলো–যে কংগ্রেসকে দিয়ে মোদি এন্ড কোম্পানিকে ২০২৪ সালে হারানো যাবে না, কেন সেই দলে তিনি যোগ দিতে গিয়েছিলেন? কার্যত তিনি এখন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং অমিত শাহের মধ্যস্থতাকারী। তার রাজনৈতিক মতাদর্শ বলে কিছু নেই। তিনি প্রফেশনাল ভোট ম্যানেজার। ২০১২ সালে গুজরাটের ভোট বা ২০১৪ সালে লোকসভা ভোটে তিনি ছিলেন মোদির সঙ্গে। ২০১৫ সালে লালু-নীতিশের মহাজোট করে ভোটে লড়ার সময় তিনি ছিলেন নীতিশ কুমারের সঙ্গে। পরে তার দলের ভাইস প্রেসিডেন্ট। আবার লালুকে ছেড়ে বিজেপির সঙ্গে সরকার গড়ার পর সুবিধাবাদী নীতিশ তাকে দল থেকে তাড়িয়ে দিলে প্রশান্ত কিশোরের স্থান হয় কলকাতায়। এখন তিনি ভবানীপুর কেন্দ্রের ভোটার।
দিল্লির মিডিয়া যেমন মোদিময়, বাংলার মিডিয়া তেমনি দিদিময়। ২০০৯ সালে যে বার দুই শতাধিক আসন পেয়ে সরকার গড়েছিল কংগ্রেস জোট, মানে ইউপিএ দুই, তখন কংগ্রেসের ভোট ছিল ২৮ শতাংশ। ২০১৯ সালে কংগ্রেস জিতেছে মাত্র ৫২টি আসনে; কিন্তু ভোট পেয়েছে ২০ শতাংশ, অর্থাৎ প্রতি পাঁচ ভোটারের একজন এই দুঃসময়েও কংগ্রেসকে ভোট দিয়েছেন। আর ১৯৬টি আসনে কংগ্রেস ছিল দ্বিতীয় স্থানে। অর্থাৎ, দেশের ৫৪৫টি আসনের মধ্যে ২৪৮টি আসনে কংগ্রেস একাই লড়তে পারে। তার মধ্যে ১০টি বড় রাজ্যে বিজেপির প্রধান প্রতিপক্ষ কংগ্রেস। আর ২০১৯ সালে তৃণমূল ২২টি আসন জিতেছিল। ২০টি আসনে দ্বিতীয় হয়েছিল। ভোট ছিল ৪ শতাংশ।
হিন্দিতে একটি কথা প্রায়ই রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলেন–‘ক্রনোলজি সামঝিয়ে‘। অর্থাৎ ঘটনার পরম্পরা দেখে বোঝা যায় জল কোন দিকে গড়াচ্ছে। মাস দুয়েক আগেই তৃণমূল সাংসদ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়কে দিল্লিতে ডেকে দীর্ঘক্ষণ জেরা করা হয়। জেরা শেষে বেরিয়ে অভিষেক বিজেপিকে প্রথম শত্রু হিসেবে আক্রমণ করার পরিবর্তে হঠাৎ কংগ্রেসকে আক্রমণ করে। কংগ্রেসের অনেক দোষ থাকতে পারে; কিন্তু তারা বিজেপির চাপে তাদের সঙ্গে সমঝোতা করছে, অতিশত্রুও এমন কথা বলবে না। অভিষেকের এই আক্রমণে অনেকেই অবাক হয়ে যায়, যেখানে সোনিয়া-মমতা আগস্ট মাসেই দিল্লিতে কথা হয়েছিলেন।
এরপরই জল দ্রুত গড়াতে থাকে। গোয়ায় কংগ্রেস থেকে প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী লুইজিনহো ফেলেইরো, আসামের শিলচরের সুস্মিতা দেব তৃণমূলে যোগ দেন। দুজনই বাংলা থেকে তৃণমূলের টিকেট পান। উত্তর প্রদেশে কংগ্রেসের ব্রাহ্মণ মুখ অমরমনি ত্রিপাঠি তৃণমূলে যোগ দেন। সবশেষে মেঘালয়ের কংগ্রেসের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী মুকুল সাংমা ১২ জন বিধায়ক নিয়ে তৃণমূলে যোগ দেন এবং প্রতিটি ক্ষেত্রেই আলোচনা করেন প্রশান্ত কিশোর। পান্ডেজি এখন কলকাতার ভোটার।
গতমাসে দিল্লিতে মোদি-মমতা একান্তে বৈঠক করেন। মমতা জানান, রাজ্যের আর্থিক দাবি নিয়ে কথা হয়েছে। বাংলার বিজনেস সামিট উদ্বোধন করতে মোদি রাজি হয়ে যান। সোনিয়ার সাথে দেখা না করে মমতা বলেন, দিল্লিতে এলেই তার সঙ্গে দেখা করতে হবে কোথায় লেখা আছে? এখানে একটা কথা পরিষ্কার, মুম্বাই হচ্ছে ক্যাপিটালিস্ট বা পুঁজিপতিদের রাজধানী। সেখানে মুকেশ আম্বানি কোনো ব্যপারে হাঁ অথবা না বললে তার বিরাট অর্থ হয়। গোটা দেশের রাজনৈতিক মহলে তার প্রভাব পড়ে। ইদানীং গৌতম আদানিও সমান বা বেশি শক্তির দাবিদার। মোদির সৌজন্যে। তাদের কাছেই কাঁচা টাকা সবচেয়ে বেশি এবং মুকেশ আম্বানি চাইছে বলেই মহারাষ্ট্র শিবসেনা-এনসিপি-কংগ্রেসের জোট ক্ষমতায় আছে। না হলে কবে সরকার পড়ে যেত!
মমতা মুম্বাইয়ে দাঁড়িয়ে পরিষ্কার বুঝিয়ে দেন, তিনি কংগ্রেসের সঙ্গে আর নেই। প্রশ্ন তোলেন, কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ইউপিএর অস্তিত্ব নিয়ে। বাংলা মিডিয়া তা ফলাও করে প্রচার করে। কলকাতায় ফিরেই নবান্নে গৌতম আদানির সঙ্গে বৈঠক করেন। যেখানে অভিষেক আর পান্ডেজি দুজনই ছিলেন। আদানি এই মুহূর্তে আন্দোলনকারী কৃষকদের কাছে ভিলেন। তারা মনে করছে ,আদানির কারণেই তিন কৃষি বিল আনা হয়েছিল। মমতা পরোয়া করেননি। কারণ, তিনি মনে করেন–দেশে কৃষকদের পাশাপাশি আদানিরও দরকার আছে।
পরিস্থিতি যেদিকে যাচ্ছে, কলকাতা বা হাওড়া পুর ভোটে বিজেপি আরও কত দম নিয়ে লড়বে, তা বোঝাই যাচ্ছে। সম্ভবত কেন্দ্রীয় নির্দেশেই তাদের ছন্নছাড়া অবস্থা। তৃণমূল একচেটিয়া জিতবে। মালদহ, মুর্শিদাবাদ, উত্তর দিনাজপুর–কোথাও কংগ্রেস বা বাম একটি আসনও জিতেনি। সবাই বুঝতে পারছে আর মুসলিম ভোটাররা বুঝতে পারবেন না, এটা কোনোদিন হয়? তাহলে কিন্তু বিপদ আছে।
মহারাষ্ট্র সরকারের দুইজোট শরিক শিবসেনা আর এনসিপি শনিবার (১৮ ডিসেম্বর) পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দিয়েছে, কংগ্রেস ছাড়া কোনো বিজেপি বিরোধী জোট তৈরি করা সম্ভব নয়। কারণ, দেশের সব প্রদেশেই বিজেপি-বিরোধী জোট তৈরি করা সম্ভব নয়। বেশিরভাগ প্রদেশেই বিজেপি-বিরোধী প্রধান শক্তি কংগ্রেস। স্পষ্ট বার্তা দেওয়া হয় তৃণমূল সুপ্রিমো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে। অন্যদিকে, ওই দিনই তৃণমূলের মুখপত্র ‘জাগো বাংলা’ লিখেছে, কংগ্রেস ডিপ ফ্রিজে চলে গেছে, অর্থাৎ মৃত।
বাস্তব পরিস্থিতি কী বলছে? উত্তরদিক থেকেই শুরু করা যাক। পাঞ্জাবে কংগ্রেস এককভাবেই রয়েছে ক্ষমতায়। হিমাচল প্রদেশ আর উত্তরাখণ্ডে বিজেপি ক্ষমতায়। বিরোধী কংগ্রেস। হরিয়ানার বিজেপি জোট সরকার চালাচ্ছে। কংগ্রেস বিরোধী দল। দিল্লিতে কংগ্রেস আর বিজেপি দুই দলই অস্তিত্ব রক্ষার চেষ্টা করছে। ছত্তিসগড়ে সরকারে কংগ্রেস। বিরোধী দল বিজেপি। মধ্যপ্রদেশে কংগ্রেস সরকারে ছিল। সিন্ধিয়াকে দিয়ে দল ভাঙিয়ে বিজেপি সরকারে এসেছে। মহারাষ্ট্রে কংগ্রেস জোট সরকারে আছে। গুজরাটে কংগ্রেস বিরোধী দল। গোয়াতেও তাই। গতবার কংগ্রেস বেশি আসনে জিতেছিল। দল ভেঙে বিজেপি সরকার গড়ে। কর্ণাটকে কংগ্রেস সরকারে ছিল। দল ভেঙে বিজেপি সরকার গড়ে। কংগ্রেস প্রধান বিরোধী দল। তেলেঙ্গানায় টিআরএস-ওয়েসি জোট ক্ষমতায়। কংগ্রেস বিরোধী দল। তামিলাডুতে কংগ্রেস-ডিএমকে জোট ক্ষমতায়। কেরালায় সিপিএম জোট ক্ষমতায়। কংগ্রেস বিরোধী দল।
অন্ধ্রপ্রদেশে কংগ্রেস দুর্বল। তবে বিজেপি থেকে শক্তিশালী। ওড়িশায় নবীন ক্ষমতায়। কংগ্রেস ও বিজেপি দ্বিতীয় স্থান নিয়ে লড়ছে। ঝড়খণ্ডে কংগ্রেস জোট ক্ষমতায়। বিহারে আরজেডির সঙ্গে কংগ্রেস বিরোধী শক্তি। আসামেও কংগ্রেস বিরোধী দল। মনিপুরে বিজেপি জোট ক্ষমতায়। বিরোধী কংগ্রেস। মেঘালয় রাজ্যে দুজন মাত্র বিধায়ক নিয়ে বিজেপি জোট সরকারে। ১৮ জন বিধায়ক নিয়ে কংগ্রেস বিরোধী ছিল। কংগ্রেসের বিধায়কদের দলে টেনে এখন তৃণমূল কংগ্রেস বিরোধী দল। ভোটের শতাংশের হিসাবে গত লোকসভা ভোটে ত্রিপুরায় কংগ্রেস দ্বিতীয় দল ছিল।
লেখক: ভারতের জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক
এসএ/