মহামারি ও যুদ্ধের কারণে সৃষ্ট ঝূঁকি মোকাবিলায় বাংলাদেশের করণীয়
ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম সম্প্রতি 'দ্য গ্লোবাল রিস্কস রিপোর্ট ২০২২' প্রকাশ করেছে। উল্লেখ করা যেতে পারে যে এই প্রতিবেদনটি সারা বিশ্বের ব্যবসায়িক নেতা, রাজনীতিবিদ, সরকার প্রধান, ঝুঁকি বিশেষজ্ঞ এবং বিশ্বের সুশীল সমাজের নেতাদের মতামতের ওপর ভিত্তি করে তৈরি করা হয়। এ বছর সংস্থাটি অর্থনৈতিক, পরিবেশগত, ভূ-রাজনৈতিক, সামাজিক এবং প্রযুক্তিগত পাঁচটি বিভাগে ঝুঁকি পরীক্ষা করে। প্রতিবেদনের মূল অনুসন্ধানগুলি দেখায় যে কভিড-১৯ মহামারি শুরু হওয়ার পর থেকে সামাজিক এবং পরিবেশগত ঝুঁকিগুলি সবচেয়ে বেড়েছে। “জলবায়ুর চ্যালেজ্ঞ মোকাবিলায় ব্যর্থতা”, "সামাজিক সংহতি ক্ষয়" এবং "জীবিকার সংকট" ঝুঁকি তালিকার শীর্ষে রয়েছে। উল্লেখযোগ্যভাবে খারাপ হিসাবে চিহ্নিত অন্যান্য ঝুঁকিগুলি হল "ঋণ সংকট", "সাইবার নিরাপত্তা ব্যর্থতা", "ডিজিটাল অসমতা" এবং "বিজ্ঞানের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া"।
চরম আবহাওয়া, জীবিকা সংকট, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলায় ব্যর্থতা, সংক্রামক রোগ, সামাজিক সংহতির অবনতি, মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতি, সাইবার নিরাপত্তায় ব্যর্থতা, ঋণ সংকট, ডিজিটাল অসমতা, মুদ্রার অবমূল্যায়নসহ অনিচ্ছাকৃত মাইগ্রেশনকেও স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদে ঝুঁকি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
সমীক্ষার উত্তরদাতাদের মধ্যে, মাত্র ১১ শতাংশ উল্লেখ করেছেন যে ২০২৪ সালের দিকে বিশ্ব একটি দ্রুত পুনরুদ্ধারের পথে চালিত হবে। কিন্তু উত্তরদাতাদের একটি বৃহৎ অংশই (৮৯ শতাংশ) মনে করেন যে সামনের দিনগুলো ক্রমশ অস্থির, ভঙ্গুর বা ক্রমবর্ধমান বিপর্যয়মূলক বলে তাদের কাছে প্রতীয়মান হচ্ছে । অন্যদকে ৮৪ শতাংশ উত্তরদাতা দীর্ঘমেয়াদে ভবিষ্যত সম্পর্কে নেতিবাচক অনুভূতি প্রকাশ করেছেন যার অর্থ বিশ্বের ভবিষ্যত নিয়ে তারা "উদ্বিগ্ন" বা "চিন্তিত" । তারা মনে করেন এই পরিস্থিতি ব্যাপক হতাশা ও মোহভঙ্গের একটি চক্র তৈরি করতে পারে যা কভিড-১৯ এর ক্ষত পুনরুদ্ধার আরও বেশি চ্যালেঞ্জিং করে তুলতে পারে।
"সামাজিক সংহতির ক্ষতি", "জীবিকার সংকট" এবং "মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতি" আগামী দুই বছরে বিশ্বের জন্য সবচেয়ে উদ্বেগজনক হুমকি হিসেবে দেখা দিবে বলে তারা মনে করেন। এই সামাজিক ক্ষতগুলো জাতীয় নীতি-নির্ধারণকে চ্যালেঞ্জ করে, রাজনৈতিক পুঁজিকে সীমিত করে, বৈশ্বিক নেতাদের উপর চাপ তৈরি করতে পারে বলে তারা উল্লেখ করেছেন। এক্ষেত্রে তারা মনে করেন বিশ্বব্যাপী চ্যালেঞ্জগুলোতে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা জোরদার করার জন্য জনসাধারণের সমর্থন প্রয়োজন।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদে জলবায়ু ঝুঁকি একটি বড় বৈশ্বিক উদ্বেগ। স্বল্পমেয়াদী উদ্বেগের মধ্যে রয়েছে সামাজিক বিভাজন, জীবিকার সংকট এবং মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতি। করোনার কারণে এসব ঝুঁকি বেড়েছে। জরিপে অংশগ্রহণকারী অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করেন যে বিশ্ব অর্থনীতির পুনরুদ্ধার স্থিতিশীল হবে না এবং এই ধরনের অসম পুনরুদ্ধার আগামী তিন বছর অব্যাহত থাকতে পারে। দশ জনের মধ্যে একজন উত্তরদাতা মনে করেন অর্থনীতি স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসবে। তবে, বেশিরভাগ উত্তরদাতা মনে করেন যে আগামী পাঁচ বছরের জন্য সামাজিক ও পরিবেশগত ঝুঁকিই প্রধান।
প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০২০ সালে বিশ্ব অর্থনীতি ৩.১ শতাংশ সংকুচিত হয়েছে৷। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম অনুমান করেছে যে ২০২১ সালে, বিশ্বব্যাপী প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৫.১ শতাংশ যা ২০২২ সালে ৪.৯ শতাংশে নেমে এসেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মহামারী না ঘটলে বিশ্ব অর্থনীতি যেখানে থাকত তার তুলনায় ২০২৪ সালে বিশ্ব অর্থনীতি ২.৩ শতাংশ সংকুচিত হয়ে যাবে।
কভিড-১৯ মহামারির শুরু থেকেই সরবরাহ সংকট একটি বড় সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছিল। ২০২০ সালের তুলনায়, পণ্যের দাম ৩০ শতাংশ বেড়েছে। জ্বালানি সংকট নিয়ে ইউরোপ, রাশিয়া ও চীনের মধ্যে দ্বন্দ্ব পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটাতে পারে। তবে সারা বিশ্বে এখন যে উচ্চ মূল্যস্ফীতি দেখা যাচ্ছে তার প্রধান কারণ সরবরাহ সংকট। অর্থাৎ মুদ্রাস্ফীতি চাহিদা-চালিত নয়, সরবরাহ-চালিত। অনেক দেশই পণ্য মজুদ শুরু করেছে এবং বৈশ্বিক রপ্তানি বন্ধ করে দিয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২২ সালেও সরবরাহ সংকট অব্যাহত থাকবে। মহামারীর কারণে বেশিরভাগ দেশই রাজস্ব হারিয়েছে। উন্নত দেশগুলো অনেক প্রণোদনা দিয়েছে। ২০২২ সালে, বিভিন্ন দেশে সরকারি ঋণ ১৩ শতাংশ বেড়ে জিডিপির ৯৭ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। এর ফলে ডলারের বিপরীতে উন্নয়নশীল দেশগুলোর মুদ্রার অবমূল্যায়ন হতে পারে। এবং এইসব দেশে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য সংকট ও মূল্য বৃদ্ধি পেতে পারে।
বাংলাদেশের অর্থনীতিতে প্রধান ঝুঁকি হল জীবিকা ও কর্মসংস্থান। প্রতিবেদনে অর্থনৈতিক ঝুঁকির পাশাপাশি সামাজিক-রাজনৈতিক ও পরিবেশগত ঝুঁকির কথাও উল্লেখ করা হয়েছে। কর্মসংস্থান ও জীবিকা ছাড়াও বাংলাদেশকে কৌশলগত ভূ-রাজনৈতিক দেশ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। প্রতিবেদনে চিহ্নিত অন্যান্য ঝুঁকিগুলি হল পরিবেশ, সাইবার দুর্বলতা, ডিজিটাল অসমতা ইত্যাদি।
অন্যদিকে, বিশ্বব্যাপী ঝুঁকি ও কৌশলগত উপদেষ্টা সংস্থা ভেরিস্ক ম্যাপলেক্রফট ১৩২টি দেশের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে আগামী ছয় মাসের জন্য নাগরিক অস্থিরতা সূচক প্রকাশ করেছে। এতে বলা হয়েছে, জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি বিশ্বজুড়ে সরকারের ওপর চাপ বাড়াচ্ছে। মধ্যম আয়ের দেশগুলো বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে। তাদের সূচকে, উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ দেশের দুই-তৃতীয়াংশকে নিম্ন-মধ্যম বা উচ্চ-মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে বিশ্বব্যাংক তালিকাভুক্ত করেছে।
অর্থনৈতিক সঙ্কটের কারণে জনরোষের মুখে প্রধানমন্ত্রীসহ শ্রীলঙ্কার মন্ত্রিসভার বেশিরভাগ সদস্য পদত্যাগ করেছেন। পাকিস্তানে সরকার পরিবর্তন হয়েছে। কাজাখস্তানে কয়েক মাস ধরে রাজনৈতিক অস্থিরতা চলছে। এ বছর এমন অস্থিতিশীলতার ঝুঁকি বিবেচনায় বাংলাদেশসহ ১০টি উদীয়মান অর্থনীতির দেশ তালিকায় রয়েছে। যে ১০টি দেশকে আলাদাভাবে পর্যবেক্ষণ করা হবে সেগুলো হলো আর্জেন্টিনা, ব্রাজিল, মিশর, তিউনিসিয়া, লেবানন, সেনেগাল, কেনিয়া, পাকিস্তান, বাংলাদেশ এবং ফিলিপাইন।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মহামারী চলাকালীন এই দেশগুলো তাদের জনগণকে সামাজিক নিরাপত্তা দিয়েছে। কিন্তু তারা চাহিদা মেটাতে হিমশিম খাচ্ছে। খাদ্য ও জ্বালানির দাম বৃদ্ধি এশিয়ার দেশগুলোর জন্য অস্থিতিশীলতার কারণ হতে পারে।
রাশিয়া ইউক্রেনে আগ্রাসনের পর থেকে বিশ্ব খাদ্যের দাম দ্রুত বেড়েছে। জ্বালানির দামও বাড়ছে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে আমদানিনির্ভর দেশগুলো। ম্যাপেলক্রফ্ট উল্লেখ করেছে যে ক্রমবর্ধমান জীবনযাত্রার ব্যয়ের সংকট ২০২৩ সাল পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে, কারণ এই মুহূর্তে কোনও সমাধান নেই।
সংস্থাটির মতে, নাগরিক অস্থিরতা দেশগুলোর অর্থনীতির পুনরুদ্ধারকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে। এ ছাড়া বিনিয়োগকারীরা ভবিষ্যতে এসব দেশে বিনিয়োগ করবে কিনা তাও অনিশ্চয়তার মুখে পড়তে পারে।
স্বাস্থ্য ও অর্থনৈতিক বিপর্যয় উদ্ভূত সামাজিক বিভাজন প্রকাশ পাচ্ছে। এটি উদ্বেগে বাড়াচ্ছে। কারণ করোনার প্রভাব থেকে বেরিয়ে আসতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সহযোগিতার বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করার জন্য, বিশ্ব নেতাদের একসাথে কাজ করতে হবে এবং একটি বহুপাক্ষিক পদ্ধতির সন্ধান করতে হবে।
তবে প্রতিকূল ভবিষ্যদ্বাণী সত্ত্বেও কিছু ইতিবাচক ফলাফল আশা করার কারণ রয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে কভিড-১৯ মহামারী মোকাবিলার শিক্ষা নিয়ে ক্রমবর্ধমান জলবায়ু পরিবর্তন ঝুঁকি মোকাবেলা, সাইবার অপরাধ দমন, ক্ষুধা ও দারিদ্র্য নিরসনে বৃহত্তর সহযোগিতার সম্পর্ক গড়ে তোলা। সেইসাথে সরকারি উদ্যোগে অপরাধ দমনে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা।
কভিড-১৯ ও রাশিয়া- ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে সাম্প্রতিককালে আমাদের দেশে দ্রব্যমূল্যের ঊর্দ্ধগতি, তেলসহ অন্যান্য পণ্য সামগ্রীর অবৈধ মজুত, সড়ক দুর্ঘটনা, আমদানি ও রপ্তানিতে ঘাটতি, রেমিট্যান্স প্রবাহ কমে আসা, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর চাপ, হাওড় অঞ্চলে ফসল হানি, অকাল বন্যা, ডেঙ্গুসহ অন্যান্য সংক্রামক রোগের প্রার্দুভাব, বেকারত্ব, অবৈধ অভিবাসন সহ সামাজিক অস্থিরতাও অনেক বেড়ে গেছে। একটি স্থিতিশীল রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিবেশকে বিঘ্নিত করতে এসব বিষয় মারাত্মক ঝুঁকি হিসেবে কাজ করতে পারে।
সুতরাং, একথা বলা যায়, এসব বিষয়ে কার্যকর ব্যবস্থা না নিলে সমাজে অস্থিরতা বৃদ্ধি পাবে। অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক উন্নয়ন ব্যাহত হবে। এমনকি রাজনৈতিক ব্যবস্থারও পরিবর্তন হয়ে যেতে পারে। যেমনটি আমরা আমাদের পাশ্ববর্তী দেশসহ বিভিন্ন দেশে দেখতে পাচ্ছি। সুতরাং, এখনই এসব বিষয়ে আরও বেশি মনোযোগী হওয়া প্রয়োজন বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।
লেখক: গবেষক ও উন্নয়নকর্মী।