মালয়েশিয়ার উন্নতি ও প্রবাসী বাংলাদেশিদের অবস্থা
মালয়েশিয়া ২০৩০ সালের মধ্যে উন্নত রাষ্ট্র ঘোষণার লক্ষ্যে এগিয়ে যাচ্ছে। তবে এরই মধ্যে চোখ ধাঁধানো উন্নয়নের অবকাঠামো, সারি সারি বহুতল ভবন, আর নৈসর্গিক সৌন্দর্য যেমন চোখে পড়ে, তেমনি শতভাগ শিক্ষা ও মাথাপিছু জিডিপি ২৭,৩৭০ ডলারে পৌঁছেছে । আর এই লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে চলা সহজ ছিল না। ১৯৫৭ সালের ৩১ আগস্ট বৃটেনের কাছ থেকে স্বাধীনতা অর্জন করে মালয়েশিয়া। কিন্তু পরবর্তী কয়েক দশক সে রকম কোন অর্থনৈতিক অগ্রগতি হয়নি। বেশিরভাগ মানুষ ১৯৭০ সালেও দারিদ্রসীমার নিচে ছিল। মূলত ১৯৮১ সাল থেকে ২০০৩ পর্যন্ত এক টানা ২২ বছর প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মাহাথির মোহাম্মদের সফল নেতৃত্ব মালয়েশিয়াকে অভাবনীয় উন্নতির পর্যায়ে নিয়ে আসে।
আর এ সময়ে অর্থনৈতিক অগ্রগতির সাথে সাথে সেখানে বাংলাদেশিদের বিচ্ছিন্নভাবে যা্ওয়াও শুরু হয়। তবে এখান থেকে দলবদ্ধভাবে প্রথম ৫’শ জন অভিবাসী শ্রমিক যায় ১৯৮৬ সালের দিকে। তারা সেখানে যায় বৃক্ষরোপন কাজের জন্য । সরকারিভাবে মালয়েশিয়ার সাথে বাংলাদেশী কর্মী নিয়োগের আনুষ্ঠানিক চুক্তি হয় ১৯৯২ সালে। এর পর থেকে নানা টানাপোড়ের মধ্যে বাংলাদেশ থেকে বৈধ-অবৈধভাবে শ্রমিক যা্ওয়া অব্যাহত আছে। নুতন করে চলতি বছরের মধ্যে শ্রমিক পাঠাতে সরকারি পর্যায়ে দুই দেশের মধ্যে চুক্তির প্রক্রিয়া নিয়ে এখন টানাপোড়েন চলছে।
শ্রমিকের বাইরে নানা শ্রেণি পেশার বহু বাংলাদেশি এখন সেখানে অবস্থান করছে। এর মধ্যে সেকেন্ড হোম কর্মসূচির অধীনে যায় অনেকে। ধনী ব্যবসায়ী ও অবৈধ অর্থের মালিকরা এই সুযোগ নেয়।
সম্প্রতি মালয়েশিয়া ভ্রমণে গিয়ে সেখানে অবস্থানরত অনেক বাংলাদেশির সঙ্গে আলাপ হয়। তারা জানায়, মূলত: বাংলাদেশ থেকে বিমানে মাত্র ৪ ঘণ্টার মধ্যে সহজ যাতায়ত, মুসলিম দেশ হওয়া, প্রাইভেট টিউশনির উপর নির্ভরতা ছাড়া ভালো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সন্তানদের লেখা পড়ার সুযোগ থাকায় তারা এখানে এসেছে । এ ছাড়া তুলনামূলকভাবে উন্নত জীবন যাপন হলেও খরচ কিন্তু বাংলাদেশের তুলনায় বেশি নয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে কমই। সর্বপোরি রয়েছে সবার জন্য নিরাপত্তার নিশ্চয়তা। আইন মেনে চলার সংস্কৃতি। ভেজাল খাবার বা ব্যাংকের ঋণ লোপাট সম্ভব নয়। এখানে যে দুর্নীতি একবারে নেই তা নয়। তবে তা আছে সহনীয় মাত্রায়।
এদিকে সেকেন্ড হোম কর্মসূচির অধীনে যারা সেখানে গিয়েছে তারা সন্তানদের লেখাপড়া নিয়ে কিছুটা বিড়ম্বনায় আছে। মালেয়েশিয়ায় বিদেশিদের ক্ষেত্রে ১৮ বছরের বেশি যাদের বয়স তাদেরকে স্টুডেন্ট ভিসায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি হতে হয়। তাই সন্তানদের এই সেকেন্ড হোম কর্মসূচি ত্যাগ করে আবার স্টুডেন্ট ভিসায় ভর্তি করা নিয়ে দিতে হয় দৌড় ঝাঁপ। আবার এই কর্মসূচির অধীনে ১০ বছর করে ভিসা রিনিউ করার সুযোগ থাকলেও স্থায়ী নাগরিকত্ব দেওয়া হয় না। তা ছাড়া সরাসরি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খুলে ব্যবসা করারও সুযোগ নেই। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর মত এখানে স্থানীয় কোনো মালয়ীকে ৫১ শতাংশ শেয়ার দিয়ে ব্যবসা করতে হয়। এক্ষেত্রে সব সময় টেনশনে থাকতে হয় কখন না ওই মালয়ী বিগড়ে বসে। আবার আরব নাগরিকদের মত স্থানয়ীদের বিশ্বাস করাও কঠিন। পশ্চিমের কোনো দেশে এত দিন থাকলে সহজে নাগরিকত্ব পাওয়া সম্ভব। তাই অনেকে ভিন্ন চিন্তা করতে বাধ্য হচ্ছে বলেও জানায়। এ কারণে আবার অনেক বাংলাদেশী স্থানীয় মালয়িদের বিয়ে করে সেখানে স্থায়ী হয়ে যাচ্ছে। জোহরবারুতে দেখেছি, অনেক বাংলাদেশি মালয়ী স্ত্রীর নামে জমি লিজ নিয়ে চাষাবাদ করে, দোকান বা রেস্টুরেন্ট দিয়ে ব্যবসা করছে।মালয়েশিয়ায় বিদেশিদের বাড়ি বা ফ্ল্যাট কেনা বেচা নিয়েও বিড়ম্বনা অনেক। বিদেশিরা মূল কুয়ালালামপুরে ১ মিলিয়ন রিঙ্গিত এবং সংলগ্ন সেলাঙ্গুরসহ অভিজাত এলাকায় ২ মিলিয়ন রিঙ্গিতের কমে কোনো বাড়ি বা ফ্ল্যাট কিনতে পারে না। এতে করে তারা বৈষম্যের শিকার হচ্ছে। এখন কোভিডের কারণে অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত অনেকে ফ্ল্যাট বা বাড়ি বিক্রি করতে চেয়ে এই দামে ক্রেতা পাচ্ছে না। তাই তারা কম দামে বিক্রি করতেও বাধ্য হচ্ছে।
এক প্রবাসী বললেন, মালয়েশিয়া সরকার এমন আইন করেছে যাতে বিদেশ থেকে অবাধে বৈধ অবৈধভাবে ডলার ঢুকলে সমস্যা হবে না। কিন্তু ডলার বাইরে সহজে নেওয়া যাবে না। আর অভিভাসন আইনও এমনভাবে করেছে, যাতে ইচ্ছেমত বৈদেশিক মুদ্রা নিয়ে এসে এখানে আনন্দ ফূর্তি করতে আপত্তি নেই। কিন্তু সহজে নাগরিকত্ব দেওয়া যাবে না। অথচ ৩ লাখ ৩০ বর্গকিলোমিটারের এই দেশের ৩ কোটি ২৯ লাখ জনসংখ্যা বেশি নয়। আর এই জনসংখ্যার ৬০ ভাগ মালয়ী, ২৮ ভাগ চীনা, ৮ ভাগ ভারতীয় ও ৪ ভাগ অন্যান্য নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠি। পাসপোর্টেও তাদের জাতিগত পরিচয় উল্লেখ থাকে।
জীবনমানে পশ্চিমাদের সঙ্গে তুলনীয়। রোজার সময় সেখানে দেখেছি হোটেল, রেস্টুরেন্ট দিনের বেলায়ও খোলা। আমাদের দেশের মত পর্দা দেওয়া নেই। চাইনিজ বা অন্যান্য জাতি গোষ্ঠীর লোকজন অবাধে খাওয়া দাওয়া করছে। কোন বাধা নেই। শুধু মুসলমানদের জন্য একটি আইন আছে। তাহলো রোজার সময় মুসলমানরা দিনের বেলায় প্রকাশ্য খাওয়া দাওয়া করতে পারে না। তবে কিনে নিয়ে যেতে পারে। আর তা তারা মেনে চলে। অপরদিকে বোরকা বা হিজাব পরা মালয়ী মহিলাদের সঙ্গে হাফ প্যান্ট, খোলামেলা পোষাকে চাইনিজ মেয়েরা অবাধে মেলামেশা করছে। কোনো সমস্যা নেই।
মালয়েশিয়ার পথে ঘাটে সব জায়গায় বাংলাদেশি শ্রমিকদের চোখ পড়ে। বিশেষ করে পরিচ্ছন্নতার কাজে। বর্তমানে বেশ কয়েক লাখ বৈধ অবৈধ শ্রমিক সেখানে আছে। বাংলাদেশি শ্রমিকদের মাসিক গড় আয় দুই থেকে তিন হাজার রিঙ্গিত। বাংলাদেশি টাকায় ৪০ থেকে ৬০ হাজার টাকা। যারা অবৈধ, তাদের আয় এর থেকে কম। আর সব শ্রমিকরা কোন প্রতিষ্ঠানে ফ্রি থাকা ও খাওয়া, আবার কোনো প্রতিষ্ঠানে শুধু থাকা বা খাওয়া ফ্রি পায়। সে হিসেবে কেউ কেউ তেমন কোনো অর্থই খরচ করে না। সবই দেশে স্বজনদের কাছে পাঠিয়ে দেয়। আর তাদের পাঠানো হাড়ভাঙা পরিশ্রমের রেমিট্যান্সে আমাদের ডলারের মজুদ বা অর্থনীতি ফুলে ফেঁপে উঠে।
ইব্রাহিম আজাদ: লেখক ও সাংবাদিক