মেয়াদ উত্তীর্ণ জেলা পরিষদ এবং প্রশাসক নিয়োগ বিষয়ে পর্যালোচনা
স্থানীয় সরকার, টেকসই উন্নয়ন এবং তৃণমূল রাজনীতি সংশ্লিষ্ট গবেষক হিসেবে ৬১টি জেলা পরিষদ ভেঙে দেওয়া এবং অন্তর্বর্তীকালীন ব্যবস্থাপনা হিসেবে প্রশাসক নিয়োগের বিষয়ে সরকারের সিদ্ধান্ত অনুসরণ করছিলাম। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের পরিপত্রে বলা হয়েছে, যথাসময়ে নির্বাচন না হওয়ায় জেলা পরিষদ ভেঙে দেওয়া হয়। ২০১৬ সালের ২৮ ডিসেম্বর দেশের ৬১টি জেলায় প্রথমবারের জেলা পরিষদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচিত প্রতিনিধিরা ২০১৭ সালের ১১ জানুয়ারি শপথ নেন। সেই বছরের জানুয়ারিতে জেলা পরিষদের প্রথম সভা অনুষ্ঠিত হয়। ফলে চলতি বছরের জানুয়ারিতে পরিষদের পাঁচ বছরের মেয়াদ শেষ হয়। তবে সংসদে পাস হওয়া সদ্য সংশোধিত আইন অনুযায়ী প্রশাসক নিয়োগ করার কথা।
জেলা পরিষদ (সংশোধন) আইন-২০২২’ গত ৬ এপ্রিল সংসদে পাস হয়েছে। জেলা পর্যায়ের স্থানীয় সরকার সংস্থার পাঁচ বছরের মেয়াদ শেষ হলে প্রশাসক নিয়োগের বিধান অন্তর্ভুক্ত করে বিলে বলা হয়েছে, কোনো অজুহাতে পাঁচ বছরের মেয়াদের পর কোনো জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান বা সদস্য পদে থাকবেন না। সরকার পরবর্তী কাউন্সিল গঠন না হওয়া পর্যন্ত স্থানীয় সংস্থা পরিচালনার জন্য প্রশাসক নিয়োগ করবে যা আইনে বলা হয়েছে। জেলা পরিষদ আইন ২০০০ একটি নির্বাচিত কাউন্সিল গঠন না হওয়া পর্যন্ত জেলা পরিষদে একজন প্রশাসক নিয়োগের অনুমতি দেয়, তবে পরিষদের চেয়ারম্যান বা সদস্যের মেয়াদ শেষ হওয়ার পরে প্রশাসক নিয়োগের কোন বিধান নেই। প্রশাসকের সময়কাল ১৮০ দিনের বেশি হবে না এবং কেউ একবারের বেশি প্রশাসক হতে পারবেন না, বিলে বলা হয়েছে।
আমি ২০২২ সালে সংশোধিত জেলা পরিষদ আইন নিয়ে সংসদে বিরোধী দলের সংসদ সদস্যদের বিতর্ক শুনছিলাম। বিলের বিরোধিতা করে জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্যরা বিলটিকে অসাংবিধানিক আখ্যা দিয়ে বলেছেন যে এটি সংবিধানের ১১ অনুচ্ছেদের পরিপন্থী যা 'সর্বস্তরে প্রশাসনে তাদের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করেছে। নির্বাচিত প্রতিনিধি ছাড়া একদিনও জেলা পরিষদ রাখা ঠিক হবে না। সংবিধানে বলা আছে, নির্বাচিত প্রতিনিধি ছাড়া কোনো কর আরোপ করা যাবে না। তাহলে ভোট না দিয়ে প্রশাসক থাকবেন কেন, প্রশ্ন করেন জাতীয় পার্টির একজন সংসদ সদস্য। বিএনপির সংসদ সদস্য বলেছে, জেলা পরিষদে আওয়ামী লীগ নেতাদের নিয়োগের জন্য বিলে এই বিধান রাখা হয়েছে। সংসদে বিরোধী দলের সংসদ সদস্যদের সমালোচনার জবাবে স্থানীয় সরকারমন্ত্রী বলেন, অনেক জনপ্রতিনিধির ফাইল মেয়াদ শেষ হওয়ার পর আদালতে যায় এবং আদালতের আদেশ পেয়েও ২০ বছর পদে বহাল থাকে। মন্ত্রী বলেন, ‘এ ধরনের প্রবণতা ঠেকাতে সরকার প্রশাসক নিয়োগের পদক্ষেপ নিয়েছে।
সত্যি বলতে, সংসদে এমপি-মন্ত্রীর বিতর্ক আমাকে এ বিষয়ে আমার পর্যবেক্ষণ লিখতে অনুপ্রাণিত করেছে। প্রসঙ্গক্রমে, আমি সংবিধানের ৫৯(১) অনুচ্ছেদ সম্পর্কে কথা বলি যেখানে উল্লেখ করা হয়েছে ‘প্রজাতন্ত্রের প্রতিটি প্রশাসনিক ইউনিটে স্থানীয় সরকার আইন অনুসারে নির্বাচিত ব্যক্তিদের সমন্বয়ে গঠিত সংস্থার কাছে ন্যস্ত করা হবে’। নিশ্চয়ই জেলা পরিষদে প্রশাসক রাখা একটি অন্তর্বর্তী ব্যবস্থা। এটি একটি অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য চলতে পারে না যা আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি। 'জেলা পরিষদ (সংশোধন) আইন, ২০২২' অনুযায়ী, সরকার পরবর্তী পরিষদ গঠন না হওয়া পর্যন্ত স্থানীয় সংস্থার কার্যাবলী সম্পাদনের জন্য একজন উপযুক্ত ব্যক্তি বা একজন সরকারি কর্মকর্তাকে প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ দেবে। পরবর্তী জেলা পরিষদ গঠিত না হওয়া পর্যন্ত প্রশাসক দায়িত্বে থাকবেন। যাইহোক, প্রশাসকের মেয়াদ ১৮০ দিনের বেশি হবে না এবং কেউ একবারের বেশি প্রশাসক হতে পারবে না।
এদিকে, চলতি বছরের জানুয়ারিতে ৬১টি জেলা পরিষদের পাঁচ বছরের মেয়াদ শেষ হলেও নির্বাচন কমিশন এখন নির্বাচন করতে প্রস্তুত নয়। ইসি সূত্রে জানা গেছে, বাকি ২০০টি ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) নির্বাচন শেষ হলেই ভোটার তালিকা চূড়ান্ত করে জেলা পরিষদ নির্বাচনের প্রক্রিয়া শুরু করবে কমিশন। আইন অনুযায়ী, সিটি করপোরেশন থেকে ইউপি পর্যন্ত সব স্থানীয় সরকার সংস্থার নির্বাচিত প্রতিনিধিরা জেলা পরিষদের ভোটার। ফলে ইউপি নির্বাচন সম্পন্ন না হলে চূড়ান্ত ভোটার তালিকা প্রণয়ন সম্ভব হবে না। যেহেতু একজন প্রশাসক ১৮০ দিনের বেশি জেলা পরিষদের দায়িত্ব পালন করতে পারবেন না, কাজেই নির্বাচন কমিশন কে এখন থেকে অন্তত পরবর্তী চার মাসের মধ্যে বাকি ২০০টি ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন পরিচালনার জন্য সক্রিয় হতে হবে বলে আমি মনে করি। সরকারকে নিশ্চিত করতে হবে যে, সব জেলা পরিষদ নির্বাচন এই বছর সেপ্টেম্বরের মধ্যে অনুষ্ঠিত হবে।
আমি মনে করি, জেলার উন্নয়ন কর্মকাণ্ড জোরদার করতে জেলা পরিষদের প্রশাসকদের আরও ক্ষমতা দেওয়া উচিত। একই সঙ্গে স্থায়ী কমিটিগুলোকে সক্রিয় করার মাধ্যমে জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। এদিকে, ঢাকাপ্রকাশ-এ গত মাসে প্রকাশিত আমার একটি লেখায় আমি জেলা পরিষদের কার্যকারিতার ওপর জোর দিয়েছিলাম। মানুষের মতামত শোনা এবং তাদের অংশগ্রহণের অধিকারকে সম্মান করার মাধ্যমে গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করা যায়। স্থানীয় সরকার সংস্থাগুলোকে শক্তিশালী না করলে এবং তাদেরকে সুষ্ঠুভাবে কাজ করতে না দিলে তৃণমূল পর্যায়ে উন্নয়ন নিশ্চিত করা যাবে না। দারিদ্র্যমুক্ত গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য একটি শক্তিশালী স্থানীয় সরকার গঠন অপরিহার্য। ফলস্বরূপ, স্থানীয় সরকারে সামগ্রিক সংস্কার আনা এখন একটি গুরুত্বপূর্ণ দাবি।
নির্বাচনের আগ পর্যন্ত অন্তর্বর্তীকালীন সময়ে প্রশাসককে তা নিশ্চিত করতে হবে, জনসেবার পরিমাণগত ও গুণগত উন্নতির পাশাপাশি সাধারণ মানুষ যাতে কোনও বিড়ম্বনা ছাড়াই সেসব সেবা-সুবিধা গ্রহণ করতে পারে। এক্ষেত্রে সবচেয়ে ভালো কর্মদক্ষতা দেখানো স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোকে মানদণ্ড হিসেবে চিহ্নিত করা যেতে পারে। স্থানীয় সরকার অবশ্যই তার নাগরিকের প্রতি দায়বদ্ধ। তাদেরকে সততার সাথে জনস্বার্থ সুরক্ষার নিশ্চয়তা দেওয়া উচিত। আবারও আমি জোর দিয়ে বলতে চাই, গণমানুষের সক্রিয় অংশগ্রহণের মাধ্যমে জেলা পরিষদকে কার্যকার করা ছাড়া নতুন সংশোধিত আইন বা নতুন কোনো বিধান জনগণের ভাগ্য পরিবর্তনে কাজে আসবে না ।
লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় এবং ভিজিটিং স্কলার (অক্সফোর্ড ও কেমব্রিজ)।
ই-মেইল: t.islam@juniv.edu