লোকজ সংস্কৃতি ও আগ্রাসী করপোরেট সংস্কৃতির বিশ্বায়ন
ভাষার মাধ্যমে আমরা মনের ভাব প্রকাশ করি। ভাষার ডিসকোর্স, লোকজ ভাষার উপর আগ্রাসী করপোরেট সংস্কৃতি প্রভাবকে প্রতিপাদ্য করে এবং অমর একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের প্রেক্ষাপটে কানাডা এবং বাংলাদেশের যৌথ উদ্যোগে পর্যায়ক্রমে গত ১৮ ফেব্রুয়ারি ও ৬ মার্চ অনুষ্ঠিত হয় দুটি ভিন্নধর্মী অনলাইন লাইভ আলোচনা। আলোচকরা ছিলেন কানাডার রাজধানী অটোয়া হতে লেখক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব মহাসিন বখত ও আন্তর্জাতিক মাদার ল্যাংগুজে ডের গ্লোবাল ক্যাম্পেইনার (আইএম এল ডি) সৌরভ বড়ুয়া।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের লোক প্রশাসন বিভাগের অধ্যাপক ও সমাজ বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডীন ও কথা সাহিত্যিক হোসাইন কবির, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ও লোক গবেষক ড. মোহাম্মদ শেখ সাদি, দক্ষিণ চট্টগ্ৰামের সমাজকর্মী, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও লোকজ শ্লোক গবেষক রাহিম সৈকত, কানাডার এডমন্টন আলবার্টা হতে প্রেরণা টিভির সম্পাদক, প্রধান নির্বাহী ও সমাজ কর্মী এডওয়ার্ড প্রবীর মন্ডল, হ্যালিফ্যাক্স কানাডা হতে আমি। প্রথম আয়োজনে বাঁশখালী এক্সপ্রেসের তত্ত্বাবধানে দক্ষিণ চট্টগ্রাম হতে সঞ্চালনা করেন রাহিম সৈকত ও কানাডা হতে সৌরভ বড়ুয়া। দ্বিতীয় আয়োজনের সঞ্চালনার দায়িত্বে ছিলেন কানাডার আলবার্টার প্রেরণা টিভির প্রধান নির্বাহী এডওয়ার্ড প্রবীর মন্ডল।
আলোচকরা মতামত ব্যক্ত করেন–করপোরেট সংস্কৃতির বিশ্বায়ন, নগর কেন্দ্রিক সভ্যতার বিকাশ ও উপনিবেশবাদের ক্রমাগত আগ্রাসনের ফলস্বরূপ বিভিন্ন রাষ্ট্র ও অঞ্চলের বৃহত্তর জনগোষ্ঠী লোকজ ভাষার অস্তিত্ব এখন বিস্মৃতপ্রায়। একটি দেশের আত্মপরিচয়ের মূল ভিত্তি হলো–বৃহত্তর জনগণের লোকভাষা, লোকরীতি–এক কথায় লোকজ সংস্কৃতি। লোকজ সংস্কৃতির বিকাশ ঘটে সাধারণ ও কৃষিনির্ভর, নদী ও সমুদ্রনির্ভর জনগোষ্ঠীর সহজ-সরল জীবনবোধের প্রকাশের মাধ্যমে। তবে আধুনিক পুঁজিবাদী করপোরেট যন্ত্রনির্ভর বিশ্বায়নের চাপে বাংলাদেশসহ অনেক রাষ্ট্রে স্থানীয় ভাষার সঠিক বিকাশ এবং এর স্বতন্ত্রঐতিহ্য মন্ডিত সুনির্দিষ্ট উচ্চারণ ও প্রয়োগগত দিকে বিকৃতির সৃষ্টি হয়েছে।
আলোচক অধ্যাপক হোসাইন কবির লোকজ সংস্কৃতি বিষয়ক তাঁর গবেষণার আলোকে বক্তব্যে জানান, বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী শেকড়ের লোকজ ভাষা ও কৃষ্টি সংরক্ষণের বিষয়টি জোর দেন। তিনি ‘আঞ্চলিক’ শব্দটির নেতিবাচক বোধের ইঙ্গিত করে উল্লেখ হয় তাই এর পরিবর্তে ‘লোকজ’ ভাষা এবং ‘লোক সংস্কৃতি’ হিসেবে উল্লেখ করার উপর গুরুত্বারোপ করেন। মাত্রাতিরিক্ত যন্ত্রনির্ভরতার ফলস্বরূপ আমাদের বাংলাদেশের হাওর বাওড় অঞ্চলের মাটিসংলগ্ন ভাষা, লালনের ভাষা, রংপুর, পাবনা, দিনাজপুর, সিলেট, খুলনা, চট্টগ্রাম, নোয়াখালী সহ বিভিন্ন জেলার ঐতিহ্যবাহী আঞ্চলিক ও নৃজাতিগোষ্ঠীর সহজ, বর্ণিল ভাষা ও সংস্কৃতির সুরভী মুছে যাচ্ছে।
বাংলাদেশের বৃহত্তর লোকসংস্কৃতির যাত্রা, নৃত্য ও খেলাধুলা, গম্ভীরা, প্রবাদ প্রবচন, শ্লোক, জারি গান ও নাচ, সারি গান, মাগনেরগীত, বিবাহেরগীত, হুদমার গীত, ভাটিয়ালি, ভাওয়াইয়া, মুর্শিদী, মারফতি, বাউল, গম্ভীরা, কীর্তন, ধামালিপ্রভৃতি গান, সিলেটের নাগরী লিপি, পুঁথি পাঠ ইত্যাদি সুবিস্তৃত লোকজ সংস্কৃতির ক্ষেত্রটি আমাদের আত্মপরিচয়ে শিকড় বহন করে। আলোচকদের মতে, বিশ্বায়নের নেতিবাচক প্রভাবে বর্তমানের যন্ত্রনির্ভর করপোরেট সংস্কৃতিতে একটি-দুটি প্রচলিত ভাষার অধীনে আনার পরোক্ষ অপচেষ্টা চলছে, যা দেশে ও প্রবাসের লোকজ ভাষার বৈচিত্রময় স্বতন্ত্র রূপকে বিনষ্ট করছে।
অধ্যাপক হোসাইন কবির বিদেশি ভাষাকে পরিহার না করে নিজের বৃহত্তর লোকজ সংস্কৃতিতে সংরক্ষণে সার্বিক ভাবে সচেতন ইংরেজি বা অন্যভাষা নিয়ে কাজ করার আহ্বান জানান। তার মতে, মাটি সংলগ্ন ভাষার সঙ্গে আমাদের পরিচিতির প্রয়োজনীতা অসীম। বক্তাদের মতে, বাংলা ভাষার প্রমিতরীতি অনুসারীর সংখ্যা সীমিত তারচেয়ে অনেকবেশি সংখক মানুষ যে লোকসাহিত্যতে কথা বলেন, মনের ভাব প্রকাশ করেন তার আবেদন অনেক বেশি। তাই লোকজ কৃষ্টি আমাদের ঐতিহ্যের ধারক। কথা সাহিত্যিক সৈয়দ শামসুল হকের অনন্য সৃষ্টি ইংরেজ উপনিবেশিক সরকারের বিরুদ্ধে অমিত শক্তিধারী কৃষকনেতা নুরুরলদীনের সারা জীবন হতে অধ্যাপকহোসেন কবির ও শেখ সাদী ‘জাগো বাহে কোন ঠে সবাই’ জাগরণের কালজয়ী আহ্বান উদ্ধৃত করেন। তাদের মতে, বাংলাদশের রংপুর ওদিনাজপুর জেলার লোকজ ভাষার এই হৃদয়গ্রাহী আবেদন কোন বিকল্প যান্ত্রিক এলগরিদম প্রণালীনির্ভর অথবা প্রমিত, প্রচলিত আধুনিক একক কোন ভাষার মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলা অসম্ভব।
সৌরভ বড়ুয়া আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ইউনেস্কো পরিচালিত কয়েকটি কনফারেন্স সম্বন্ধে কিছুটা আলোকপাত করেন যার বিষয় বস্তু ছিল বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্রের যান্ত্রিকতার চাপে স্থানীয় ভাষার গুলির অবলুপ্তি। তিনি কানাডার মূলধারার স্থানীয় অভিবাসী ও আদিবাসী সংস্কৃতির শেকড়ের ভাষার চর্চা বজায় রাখার পাশাপাশি কানাডা স্থানীয় আঞ্চলিক ভাষার চর্চার ক্ষেত্রে কানাডা সরকারের শিক্ষা ক্ষেত্রে বিভিন্ন উদ্যোগের দিক আলোকপাত করেন।
আলোচক মহসিন বখত মানব সভ্যতার ক্রমবিকাশের বিভিন্ন পর্যায়েআদি যুগ হতে হাজার বছরের ভাষার ক্রমবিকাশের নিয়ন্ত্রণে আগ্রাসী শক্তির ভূমিকাবিষয়ক আলোকপাত করেন।
ড. মোহাম্মদ শেখ সাদী তার বক্তব্যে শেকড়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত ভাষা কে মূল ভাষাবলেউল্লেখ করে রাজা রামমোহন রায়, কথা সাহিত্যিক আল মাহমুদের সাহিত্য সৃষ্টির লোকজ আবেদন, বাউল শাহআব্দুল করিমের অসাম্প্রদায়িক মানবতাবাদী জীবন দর্শনের অনন্য উদাহরণ আলোকপাত করেন। তিনি পশ্চিমের অনেক দার্শনিক চিন্তাবিদদের চিন্তার সঙ্গে বাংলার হাজার বছরের বাউল সাধকদের চিন্তার একাত্মতার কয়েকটি ক্ষেত্র উত্থাপন করেন। তার মতে, সঠিক প্রচার, সচেতনতার এবং গবেষণার অভাবে আমাদের এই বৃহত্তরলোকজ সংস্কৃতির বিশেষ প্রাধান্য পাচ্ছে না যেভাবে সর্বত্রই পশ্চিমা ভাষা চিন্তাবিদের সৃষ্টিশীলতা প্রাধান্য পাচ্ছে। তিনি বৃহত্তর লোকজ জনগোষ্ঠী হতে জাতীয় সংসদের বেশি মাত্রায় প্রতিনিধিত্বের দিকটির প্রাধান্য দেন।
আলোচক প্রবীর মন্ডল বিশেষভাবে কানাডার ব্রিটিশ কলাম্বিয়ায় কানাডার মূলধারার একটি নৃ জাতিগোষ্ঠীর একটি উপর তার পর্যবেক্ষণমূলক গবেষণার বিষয়টি তুলে ধরেন। আমাদের মায়ের বাংলা ভাষায় গবেষণামূলক আন্তর্জাতিক মানের জার্নাল ও গবেষণায় বাংলায় ভাষা বিভিন্ন প্রকাশনার দিকটা প্রাধান্য দেন। কানাডায় ঔপনিবেশিক শক্তি মূল ভূখণ্ডের আদিবাসী জনগোষ্ঠীর শিশুদের কীভাবে রেসিডিয়াল স্কুলের যুক্ত করে পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন করে ভাষাগত ও কৃষ্টিভিত্তিক নিপীড়ন করেছে ইতিহাসের সেই বিষয়টি আলোচকরা তুলে ধরেন।
এই আয়োজনে দক্ষিণ চট্টগ্রাম হতে অংশগ্রহনকারী আলোচক রাহিম সৈকতের আলোচনায় উল্লেখ করেন তিনি চট্টগ্রামের বৃহত্তর লোকজ সংস্কৃতির প্রায় বিস্মৃত কয়েকশো শ্লোক, লোকগাঁথা, গল্প সংগ্রহ ও গবেষণা করছেন যার দ্বারা বাংলাদেশের এই দক্ষিণাঞ্চল সহ হাজার বছরের সমাজ সংস্কৃতির প্রেক্ষাপট সম্পর্কে সম্যক ধারণা লাভ করা সম্ভব। আমি আমার বক্তব্যে বাংলার লোকজ সংস্কৃতির সঠিক প্রসারে এবং আমার কানাডার সাহিত্য অনুবাদ ও আমাদের গণমাধ্যমের দায়িত্বশীলতার বিষয়টি কিছুটা আলোচনা করি। কানাডার হ্যালিফ্যাক্সে মিউনিসিপ্যাল পর্যায়ে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতির প্রেক্ষপটে আমাদের উদ্যোগের দিকটা আলোচনা করি।
প্রযুক্তিনির্ভরতার চাপে হারিয়ে যাচ্ছে হাজার বছরের লালিত বাংলাদেশ সহ বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্রের লোকজ ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, লোকাচার ও লোকভাষা। এই পরিস্থিতির দ্রুত নিরসন কল্পে এবং আমাদের কৃষ্টিনির্ভর অস্তিত্বের রক্ষার স্বার্থে বৃহত্তর লোকজ কৃষ্টি ও সাহিত্য, ভাষা সংরক্ষণে দেশে প্রবাসে সবার সদিচ্ছা এবং উদ্যোগ অব্যাহত রাখা বিশেষ প্রয়োজন।
হ্যালিফ্যাক্স, কানাডা
লেখক: প্রবাসী লেখক
এসএ/