সুখরঞ্জন দাশগুপ্ত
বাংলাদেশ বিশ্বের মানচিত্রে এক উজ্জ্বল নাম
রবি ঠাকুরের সোনার বাংলা /
নজরুলের বাংলাদেশ/
জীবনানন্দের রূপসী বাংলা/
রূপের যে তার নাইকো শেষ।
বাংলার অপরূপ রূপকথা বারবার উঠে এসেছে বিভিন্ন কবির কবিতায়, গানে। বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়েছেন শুধু এদেশের নয়, বিদেশি পর্যটকেরাও। আবার অন্যদিকে সেই বাংলাকে জোর করে দখল করার চেষ্টা, আর সেই চেষ্টাকে সফল করতে প্রয়োজনে রক্তগঙ্গা বইয়ে দেওয়ার ইতিহাসও আমাদের সকলেরই জানা। জবরদখলকারী এবং হানাদারেরা বহু চেষ্টা করেছে, কখনও সাময়িকভাবে সফলও হয়েছে, কিন্তু শেষমেশ জয় হয়েছে বাংলারই। বাংলার মানুষ রুখে দিয়েছে সব আক্রমণ, সব ষড়যন্ত্র।
৩ ডিসেম্বর ১৯৭১ পাকিস্তান সেনাবাহিনী যখন ভারত আক্রমণ করে, তখন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী সর্বশক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন পাকসেনাদের রুখতে। একইসঙ্গে বাংলাদেশের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন প্রকৃত বন্ধুর মতো। ১৩দিনের প্রবল যুদ্ধের পর ১৬ডিসেম্বর পাকিস্তানের জি ও সি ইনচার্জ জেনারেল নিয়াজি ভারতের ইস্টার্ন কমান্ডের চিফ জগজিৎ সিং অরোরার কাছে ৯১ হাজার সৈন্যসহ আত্নসমর্পণ করেন। এর আগে যুদ্ধ চলাকালীনই ৬ ডিসেম্বর জেনারেল নিয়াজির আত্মসমর্পণের সঙ্গে সঙ্গেই পাক বাহিনীর যাবতীয় চেষ্টার অবসান ঘটলো। বিজয়ী হল বাংলাদেশ।জয় হল সারা পৃথিবীর কোটি কোটি বাঙ্গালির বড় গর্বের, বড় আনন্দের দিন। সেই চিরস্মরণীয় দিনটির আজ সুবর্ণজয়ন্তী। পঞ্চাশ বছর আগে পাকসেনাদের হাত থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত হয়েছিল বাংলাদেশ। পেয়েছিল স্বতন্ত্র স্বীকৃতি। বাঙালি যতদিন থাকবে,এই দিনটির কথা মনে রাখবে।
বিশ্বের যে সব দেশে বাংলাদেশের দূতাবাস রয়েছে, সেসব জায়গাতেই এ বছর বাংলাদেশের দূতাবাস রয়েছে, সে সব জায়গাতেই এ বছর বাংলাদেশের বিজয় দিবসটি যথাযোগ্য মর্যাদায় পালিত হচ্ছে। শুধু আজই নয়, যুগ যুগ ধরে বাঙালি এই দিনটি স্মরণ করবে।
ঢাকায় যারা বিগত ৯মাস ধরে বন্দি ছিলেন, তাঁরা সেই উৎসবের দিনে দলে দলে রাস্তায় নেমে এসেছিলেন, বিজয় উৎসব উদযাপনে অংশ নিয়েছিলেন। অনেকদিন আগের কথা হলেও তখনকার অনেক ঘটনাই এখনও আমার স্মৃতিতে উজ্জ্বল। এ প্রসঙ্গে একটা ঘটনার কথা বলি। ৯মাস ধরে অমানুষিক পরিশ্রম করে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের খবর কভার করার পরেও বিজয় দিবসের দিন আমার ঢাকায় উপস্থিত থাকা হয়নি, শুধুমাত্র সাদা কালোর দ্বন্দে।আমি আর যুগান্তরের চিফ রিপোর্টার অনিল ভট্টাচার্য অপেক্ষা করছিলাম যাওয়ার জন্য। কিন্তু আমরা কালো চামড়ার বলেই আমাদের নিয়ে যাওয়া হল না। পরে বলা হল,আবহাওয়া খারাপ থাকার কারণে ওইদিন আর হেলিকপ্টার যাবে না।
১৬ই ডিসেম্বর ঢাকা থেকে দিল্লীতে খবর আসার পর সংসদে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বললেন, যুদ্ধে পাকিস্তান পরাজিত হয়েছে। এজন্য আপনারা সকল কৃতিত্বের অধিকারী। আমি এর কোন কৃতিত্ব দাবী করবো না। উল্লেখ্য অটলবিহারী বাজপেয়ি সংসদে দাঁড়িয়েই সেদিন ইন্দিরা গান্ধীকে মা দুর্গার সঙ্গে তুলনা করেছিলেন। প্রখর বুদ্ধিমত্তার অধিকারিনী ইন্দিরা বলেন, আমরা যদি এখন লাহোর দখল করি , তাহলে আমরাই সমস্যায় পড়বো। লাহোরের জনসংখ্যা ১কোটির বেশি। লাহোর দখল করলে সেই সব মানুষের খাওয়া পরা এবং চিকিৎসার দায়িত্ব নিতে হবে। তাছাড়া নিয়াজির ৯১ হাজার সৈন্যকেও খাওয়াতে হবে। আমরা এত মানুষের দায়িত্ব নিতে পারবো না ।
৭ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্তি দেওয়া হয় পাকিস্তানের রাওয়ালপিন্ডি জেল থেকে। সেখান থেকে ব্রিটিশ এয়ারওয়েজের বিমানে তাকে লন্ডনে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে গিয়েই তিনি বাংলাদেশের বিজয়ের সুখবরটি পান। সেখান থেকে ইন্দিরা গান্ধী তাকে দিল্লিতে আসতে বলেন। দিল্লিতে তাকে সংবর্ধনা দেওয়া হয় এবং ইন্দিরা গান্ধী তাঁর সঙ্গে একটি গোপন বৈঠক করেন। দিল্লি থেকে ধাকায় ফিরে রমনা ময়দানে ১০ জানুয়ারি সেই ঐতিহাসিক বক্তৃতা দেন বঙ্গবন্ধু। যেখানে তিনি ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের রূপরেখার একটি স্পস্ট চিত্র তুলে ধরেছিলেন। পরবর্তীকালে সেই অনুযায়ী বাংলাদেশের সংবিধান রচিত হয়।
এরপর ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করা হয়েছিল বাংলাদেশের উন্নয়ন স্তব্ধ করে দেওয়ার উদ্দেশ্যে। কিন্তু তা সফল হয়নি।বঙ্গবন্ধু হত্যার দিন তার দুই মেয়ে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা ছিলেন জার্মানিতে। তাই তারা সেদিন বেঁচে যান। সেই সময় ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী তৎকালীন উপমন্ত্রী প্রনব মুখোপাধ্যায়কে ইন্ডিয়ান এয়ারফোর্সের ১ নম্বর বিমানে জার্মানিতে পাঠান। হাসিনা ও রেহানাকে দিল্লিতে নিয়ে আসার জন্য। সেই সময় দুইবোনকে সহায়তা করেছিলেন ইন্দিরাই। পরবর্তীকালে প্রায় ২১ বছর বাংলাদেশের ক্ষমতায় ছিল না আওয়ামী লীগ। কিন্তু প্রায় ২০ বছরের শাসনামলে শেখ হাসিনার নেতৃতে আওয়ামীলীগ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের পথেই বাংলাদেশকে নিয়ে চলেছে। মুজিবের সুযোগ্য কন্যা হিসেবে হাসিনা বাংলাদেশকে বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিশ্বের মানচিত্রে এক উজ্জ্বল স্থান করে দিয়েছেন।
লেখক: কলকাতার সিনিয়র সাংবাদিক