ঢাকাপ্রকাশ-এর দর্পণে প্রকাশিত হোক প্রতিটি মুখ
এরশাদুল আলম প্রিন্স
গণমাধ্যম আধুনিক রাষ্ট্রের এক অপরিহার্য অংশ। গণমাধ্যম সমাজের দর্পণ ও একই সঙ্গে এটি সমাজের ইতিবাচক পরিবর্তনের ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, স্বপ্ন দেখায় আদর্শিক সমাজ, রাষ্ট্র ও বিশ্ব বিনির্মাণের।
একুশ শতকের পরিবর্তনশীল এই বিশ্বে পরিবর্তন হচ্ছে গণমাধ্যমেরও। গণমাধ্যমের এই পরিবর্তন বহুমাত্রিক। ক্রমে এর বিকাশ ঘটছে। আমাদের দেশেও গণমাধ্যমের বিকাশ ঘটছে এবং তা বহুমাত্রিক। দেশের আজ থেকে তিন দশক আগের গণমাধ্যম আর আজকের গণমাধ্যম এক নয়। এ শতাব্দীর শুরুতে আমাদের এখানে পুরোপুরি অনলাইন ভিত্তিক সংবাদপত্রের সূচনা। যদিও তারও আগে থেকেই কয়েকটি কাগজের পত্রিকার অনলাইন ভার্সন চালু ছিল। পাঠক তখনও পুরোপুরি অনলাইন নির্ভর হয়ে ওঠেনি।ফলে,কাগজেরপত্রিকাগুলোও তখন পুরোপুরি অনলাইন নির্ভর হয়ে ওঠেনি। ধীরে ধীরে অবস্থার পরিবর্তন হতে থাকে। সব পত্রিকা অনলাইন ভার্সন চালু করে এবং পাঠকও অনলাইন নির্ভর হয়ে ওঠে। এছাড়া কাগজের পত্রিকা গুলোর কিছু করারও ছিল না। আত্মরক্ষার প্রয়োজনেই নতুনভাবে আত্মপ্রকাশ।
এক সময়ে বাঙালি মধ্যবিত্ত পরিবার মানেই সংবাদপত্রের গ্রাহক। ঘরে সংবাদপত্র না থাকলে ওই পরিবারকে আধুনিক ও প্রাগ্রসর নয় বলে সন্দেহের চোখে দেখা হতো। কিন্তু আজকে অবস্থা অনেকটাই ভিন্ন। এখন সংবাদপত্র বাসায় থাকলে অনেক ক্ষেত্রেই মনে করা হয় বুঝিবা পরিবারটি এখনও পুরোপুরি ডিজিটাল হয়ে ওঠেনি।
কাজেই, গণমাধ্যমের ডিজিটালাইজেশনই আজকের বাস্তবতা। সব ধরনের গণমাধ্যমের মূল প্লাটফর্মই আজ অনলাইনে। যেকোনো গণমাধ্যমের অনলাইন ভার্সনই পাঠক পড়ে। কাগজের পত্রিকার সঙ্গে কালে-ভদ্রে তার সাক্ষাৎ হয়। টেলিভিশনের অনুষ্ঠানও দর্শক এখন অনলাইনেই দেখে নেয়। সময় করে টিভির সামনে বসে অনুষ্ঠান দেখার দিন প্রায় শেষ। টিভিগুলোও তাদের সব অনুষ্ঠান অনলাইনে প্রচার করছে। গণমাধ্যম যে শুধু অনলাইন নির্ভর হয়েছে তা নয়, সবাই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কেন্দ্রীভূত হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নিজের উপস্থিতি জানান দিতে পারাটাই মূল কথা।
হাতের মুঠোতেই আজ বিশ্ব। হাতের মুঠোতেই আজ গণমাধ্যম। যেভাবেই হোক পাঠকের হাতের মুঠোর মধ্যে থাকতে পারাটাই আজকের গণমাধ্যমের টিকে থাকার মূল লড়াই। টিআরপি বলি অথবা অ্যালেক্সা র্যাংকিং-সবই নির্ধারিত হয় পাঠকের হাতের মুঠোয়। টেক্সট, ভিডিও, ইউটিউব বা অডিও-যে মাধ্যমই হোক না কেন ফেসবুকে গণমাধ্যমের কন্টেন্ট রয়েছে কিনা সেটাই আসল কথা। একুশ শতকের পাঠক কারো ইউটিউব চ্যানেলে গিয়ে অনুষ্ঠান দেখবে সেরকম নয়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গণমাধ্যমকেই তার কন্টেন্ট নিয়ে হাজির থাকতে হবে প্রতিনিয়ত।
একুশ শতকে সংবাদপত্র বা গণমাধ্যমের পাঠক কম, শ্রোতাও কম, কিন্তু দর্শক বেশি-তাই মাল্টিমিডিয়া গণমাধ্যমই ভোক্তাবান্ধব। গণমাধ্যমের এ বহুমাত্রিক শাখাবিস্তার কঠিনই বটে। বিশ্বাস করি, এই কঠিনেরে ভালোবেসেই ঢাকাপ্রকাশ আত্মপ্রকাশ করলো। তবে, এ বাস্তবতা কঠিন হলেও একই সঙ্গে যথেষ্ট সম্ভাবনাময়ও। অনলাইন ও মাল্টিমিডিয়ার কল্যাণেই গণমাধ্যমের জন্য খুলে গেছে সম্ভাবনার নতুন নতুন দ্বার। বাংলাদেশ তথা বিশ্ব গণমাধ্যমের বিকাশ অথবা অস্তিত্ব দুটোর জন্যই দায়ী এই অনলাইন। গত এক দশকে বিশ্বের নামি-দামি ও ঐতিহাসিক অনেক সংবাদপত্র বন্ধ হয়ে গেছে। অনলাইন ভার্সনেই হয়তো কেউ কেউ এখনও টিকে আছে। টিকে থাকা ও বিকাশের এটাই পথ।
বিশ্বে অর্থনীতির বর্ধনশীল একটি খাত হিসেবে দাঁড়িয়েছে গণমাধ্যম শিল্প। গণমাধ্যমকে গণমাধ্যমের কর্তাব্যক্তিরা শিল্প হিসেবে বিবেচনা করতেই ভালোবাসেন। বাংলা ভাষায় শিল্প শব্দটির দুটি দিক রয়েছে। সুকুমার শিল্পও একটি শিল্প আবার উৎপাদন ও বাণিজ্যিক কর্মযজ্ঞও একটি শিল্প। গণমাধ্যমকে যখন শিল্প বলি তখন আশ্চর্যজনকভাবে এখানে শিল্পের দুটি বিষয়ের এক মেলবন্ধন দেখতে পাই। মূলত এই মেলবন্ধন না ঘটলে গণমাধ্যমকে শিল্প বলাই অর্থহীন। পুঁজিবাদী বিশ্বে গণমাধ্যমকে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে শিল্প বলতে অনেকে পছন্দ করেন। কাজেই, সংবাদ এখানে একটি পণ্য। এমনকি পাঠকের কাছেও পুরো পত্রিকা বা অনলাইন পোর্টালটিই একটি পণ্য। পাঠকের কাছে এই পণ্যের মান, গুণ ও রূপ তিনটিই গুরুত্বপূর্ণ।
এদিকে এই পাঠক বা গ্রাহকের হাতে সময়ও খুবই কম আবার তার হাতে পন্যের (গণমাধ্যমের) সরবরাহও অনেক বেশি। উপরন্তু এই বাজারে নিত্য নতুন সরবরাহকারীরা ঢুকে পড়ছেন। প্রকৃত গণমাধ্যমের সঙ্গে সঙ্গে ঢুকে পড়ছেন কিছু ফড়িয়া ও ফটকা ব্যবসায়ীরাও। ফলে, অনলাইন মাল্টিমিডিয়া গণমাধ্যমের বাজার কিছুটা অস্থিরই বলা যায়। এমন একটি অস্থির বাজারে ‘সততাই শক্তি, সুসাংবাদিকতায় মুক্তি’ এই ব্রত নিয়ে গুণ ও মানসম্পন্ন পণ্যের পসরা সাজিয়ে বাজারে নিজের অস্তিত্ব জানান দেওয়ার কাজটি সহজ কিছু নয়।
এই পাথর সময়ে ঢাকাপ্রকাশের আত্মপ্রকাশ সততার শক্তিকে ভালোবাসারই নামান্তর। সততার শক্তিকে ভালো না বাসলে প্রকৃত গণমাধ্যমের জন্মই হয় না। পুঁজি খাটিয়ে সংবাদপণ্য উৎপাদন, সংগ্রহ ও সরবরাহ বাণিজ্যের মাধ্যমে যা তৈরি হয় তা প্রকৃত অর্থে গণমাধ্যম হয়ে উঠতে পারে না। এগুলো হয়ে ওঠে পুঁজিপতিদের কাছে যেমন বাণিজ্যিক পণ্য, তেমনি পাঠকের কাছে শেষমেষ স্ক্রাপ আইটেম। ভুঁইফোড় অনলাইন পোর্টালগুলো কিছুদিনের জন্য বাজার তোলপাড় করে তোলে, কিন্তু সময়ের কাছে হেরে যায়। পাঠক দীর্ঘ মেয়াদে এদেরকে বর্জন করে।
বর্তমান বিশ্বে সাংবাদিকতার চ্যালেঞ্জ গণমাধ্যমের চ্যালেঞ্জের চেয়েও বেশি। কর্তৃত্ববাদীতার বাহ্যিক চ্যালেঞ্জতো এখানে আছেই। কিন্তু সমাজের আর দশটি ক্ষেত্রে মান-গুণ-রুচি ইত্যাদির যে নিম্নগামী প্রবণতা দেখা যাচ্ছে, সাংবাদিকতাও তার থেকে বাদ যায়নি। অতীতে সাংবাদিকতা থেকে সততাকে আলাদা করা যায়নি। এখন সততার সঙ্গে সাংবাদিকতার সম্পর্ক থাকলে ভালো, না থাকলে যেন আরও ভালো। এমন একটি বিরহ সময়ে ঢাকাপ্রকাশ সততার সঙ্গে গণমাধ্যমের সেই পুরনো,শাশ্বত ও অবিনশ্বর প্রেমের কথাটি সবাইকে স্মরণ করিয়ে দিল। ঢাকাপ্রকাশ বলছে, সততাই শক্তি। হ্যা, সততাই গণমাধ্যমকে ভেতর থেকে শক্তি যোগায় বাইরের প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে লড়াই করতে, ঠিক যেমন প্রেম মানুষকে বেঁচে থাকার অণুপ্রেরণা জোগায়। সততায় ঋদ্ধ যে পেশা তার নাম সাংবাদিকতা।
সততার সঙ্গে গণমাধ্যমের সম্পর্কের চিড় ধরায় শিল্প বা প্রতিষ্ঠান হিসেবে শুধু যে গণমাধ্যমই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তা নয়, পেশা হিসেবে সাংবাদিকতাও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। প্রকারান্তরে প্রকৃত গণমাধ্যম শ্রমিক বা শিল্পীরা হয়েছেন ক্ষতিগ্রস্ত।
সাংবাদিকরা সমাজের চিকিৎসক। দমবদ্ধ সমাজে অক্সিজেন সরবরাহ করেন সাংবাদিক, মড়ক লাগা সমাজে মলম সরবরাহ করেন সাংবাদিক। সততাই তাদের শক্তি। কিন্তু সাংবাদিকরাই যদি মহামারিতে আক্রান্ত হন তবে সমাজের ব্যাধি সাড়াবে কে?
সততা বিচ্যুতির ফলে সাংবাদিকতা হয় অবরুদ্ধ। কুসাংবাদিকতার শুরু এখান থেকেই। সুসাংবাদিকতা প্রশ্নটির অবতারণা হয় কুসাংবাদিকতার অস্তিত্ব থেকে। সমাজে কুসাংবাদিকতা আছে বলেই সুসাংবাদিকতার অবকাশ রয়েছে। কুসাংবাদিকতার হাত থেকে গণমাধ্যমকে বাঁচাতে সুসাংবাদিকতার পুনঃবিকাশ জরুরি। সুসাংবাদিকতায় সবারই মুক্তি। এই মুক্তি সাংবাদিকতার, গণমাধ্যম তথা গণমানুষের। ঢাকাপ্রকাশ সুসাংবাদিকতায় মুক্তি- এ কথা বিশ্বাস করে।
সুসাংবাদিকতাই এদেশে গণমানুষের মুক্তির আন্দোলনকে ত্বরান্বিত করেছিল। এদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে গণমাধ্যমের ভূমিকা আমরা ভুলি কী করে? আমাদের সংবাদপত্রের রয়েছে গৌরবোজ্জ্বল অতীত। সততার শক্তির ওপর ভর করেই সুসাংবাদিকতার মাধ্যমে তারা একটি জাতিকে পরাধীনতার হাত থেকে মুক্ত করেছেন। সততার শক্তি থাকলে মানুষের মুক্তি কথা বলা যায়, এমনকি মানুষের মুক্তির জন্য জীবনও দেওয়া যায়। শহীদ সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেন, শহীদুল্লাহ কায়সার, খোন্দকার আবু তালেব, নিজামুদ্দীন আহমদ,এস এ মান্নান (লাডু ভাই), আ ন ম গোলাম মোস্তফা, সৈয়দ নাজমুল হক, শহীদ সাবের, আবুল বাশার, শিবসাধন চক্রবর্তী, চিশতী শাহ্ হেলালুর রহমান, মুহাম্মদ আখতার, সেলিনা পারভিন-এরা সবাই দেশের মানুষের মুক্তির জন্য জীবন দিয়েছেন, নির্যাতন ভোগ করেছেন, তাদের সেই আত্মত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত বিজয়ের মাস। এ মাস সেই সততার শক্তির চুড়ান্ত বিজয়ের মাস।
ঢাকা আমাদের রাজধানী, প্রাণের শহর। মান-অভিমান, পাওয়া-না পাওয়া,অভাব-স্বপ্ন ও সম্ভাবনার শহর। ঢাকাই দেশের দর্পন। ঢাকাপ্রকাশের দর্পনে প্রকাশিত হোক এদেশের প্রতিটি মুখ।
এরশাদুল আলম প্রিন্স: আইনজীবী ও কলাম লেখক