আত্মহত্যা নয়, জীবনকে ভালোবাসতে শিখি
পত্রিকার পাতা খুললে প্রায়ই চোখে পড়ে আত্মহত্যা সংক্রান্ত খবর। দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীসহ বিভিন্ন জায়গায় নানা পেশার লোকজনের আত্মহত্যা সংক্রান্ত খবর সবার মনকে বিষাদময় করে তোলে। বেসরকারি সংস্থা আঁচল ফাউন্ডেশনের জরিপ অনুযায়ী, ৩৫ শতাংশ আত্মহত্যার কারণ হচ্ছে পারিবারিক সমস্যা। যারা আত্মহননের পথ বেছে নেন তারা তুলনামূলক বয়স্ক।
২০২০ সালের মার্চ থেকে ২০২১ সালের মার্চ মাস পর্যন্ত করোনাকালে আত্মহত্যা নিয়ে ওই জরিপ করে প্রতিষ্ঠানটি। জরিপে দেখা যায়, ওই এক বছরে দেশে ১৪ হাজারের বেশি মানুষ আত্মহত্যা করেছে। জরিপে আরও দেখা যায়, দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ২৪ শতাংশ আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে সম্পর্কজনিত কারণে। আর আর্থিক কারণে আত্মহত্যার পরিমাণ ৪ শতাংশ। আর ১ শতাংশ আত্মহত্যার ঘটেছে লেখাপড়া-সংশ্লিষ্ট কারণে এবং সর্বশেষ বিভিন্ন কারণে আত্মহত্যা হয়েছে ৩২ শতাংশ। ওই জরিপে বলা হয়, সবচেয়ে বেশি আত্মহত্যা করেছে ২০ থেকে ৩৫ বছর বয়সীরা, যা মোট আত্মহত্যার ৪৯ শতাংশ। এরপরই বেশি আত্মহত্যা করেছে ৫-১৯ বছর বয়সীরা, যা ৩৫ শতাংশ। ৩৬-৪৫ বছর বয়সী ছিল ১১ শতাংশ আর ৫ শতাংশের বয়স ছিল ৪৬- ৮০ বছর। জরিপ মতে, বিশ্বের পুরুষ আত্মহত্যাকারীর সংখ্যা বেশি হলেও বাংলাদেশে নারীরা বেশিমাত্রায় আত্মহত্যা করে থাকে (নারী ৫৭ শতাংশ, পুরুষ ৪৩ শতাংশ)। কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, মূলত মানসিক স্বাস্থ্যজনিত সমস্যা থেকেই বেড়ে চলেছে আত্মহত্যার প্রবণতা।
দেশে করোনার কারণে আত্মহত্যার প্রবণতা বেড়েছে বলেও জরিপে উঠে আসে। বলা বাহুল্য, আত্মহত্যা হচ্ছে মানব জীবনের এক চরম অসহায়ত্ব। ক্ষণিক আবেগে একটি মহামূল্যবান জীবনের চির অবসান ঘটানো, যা কোনো কিছুর বিনিময়েই ফিরে পাওয়া সম্ভব নয়।
আত্মহত্যার মাধ্যমে নিজের মূল্যবান জীবনকে যেমন একদিকে শেষ করে দেওয়া হয়, তেমনি অপরদিকে একটি সম্ভাবনারও চির অবসান ঘটে। ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, অতিপ্রাচীনকাল থেকেই বিভিন্ন দেশে ‘আত্মহত্যা’ নামক এই মহাপাপ সংঘটিত হয়ে আসছে। যদিও এটিকে কোনো সমাজই কখনোই ভালো চোখে দেখেনি এবং দেখবেও না। একজন ব্যক্তির আত্মহত্যা করার পেছনে সাধারণত বিষন্নতা বা ডিপ্রেশন, আর্থিক, সামাজিক, পারিবারিক সমস্যা কিংবা নিতান্ত ব্যক্তিগত মনোকষ্ট, বাইপোলার ডিসঅর্ডার, সিজোফ্রেনিয়া (দীর্ঘদিন ধরে ব্যর্থতা, গ্লানি বা হতাশা এবং নিজের প্রতি আত্মবিশ্বাসের ঘাটতি, অনাগত ভবিষ্যত সম্পর্কে উদ্বেগ, নিঃসঙ্গতা, কর্মব্যস্ততাহীন দিনযাপন ইত্যাদি মানব মস্তিষ্ককে সিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত করে), পার্সোনালিটি ডিসঅর্ডার, এনজাইটি ডিসঅর্ডার, অ্যালকোহল ব্যবহারজনিত ডিসঅর্ডার ইত্যাদি।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) পরিসংখ্যান মতে, বিশ্বে প্রায় ১২১ মিলিয়ন মানুষ মাত্রাতিরিক্ত বিষন্নতার শিকার। ডব্লিউএইচও’র বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা প্রকাশ করছেন, ২০২০ সালের মধ্যে হৃদরোগের পরেই বিষন্নতা মানব সমাজের বিপন্নতার দ্বিতীয় কারণ হিসেবে প্রতীয়মান হবে। ডব্লিউএইচও’র জরিপ অনুযায়ী, বর্তমানে বিশ্বে প্রতি এক লাখ মানুষের মধ্যে বার্ষিক আত্মহত্যার হার ১১ দশমিক ৪ শতাংশ। জরিপে দেখা যায়, শুধু ২০১২ সালে সারা বিশ্বে আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে আট লক্ষ চার হাজারটি। প্রতি ৪০ সেকেন্ডে ১টি করে আত্মহত্যা সংঘটিত হচ্ছে। তবে এর মধ্যে ১৫-২৯ বছর বয়সীদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা সবচেয়ে বেশি। আর বাংলাদেশে বার্ষিক আত্মহত্যার সংখ্যা গড়ে দশ হাজার ২২০টি, যার মধ্যে ৫৮-৭৩ শতাংশ আত্মহত্যাকারীই নারী। খোঁজ নিলে দেখা যাবে, দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অনেক শিক্ষার্থীই হতাশা, মানসিক অশান্তি ও মানসিক অস্থিরতায় ভুগছেন। তথ্য-প্রযুক্তির অপব্যবহারসহ সঙ্গত নানা কারণে পূর্বের তুলনায় সাম্প্রতিক সময়ে শিক্ষার্থীদের মাঝে এ অবস্থা যেন অধিকমাত্রায় বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রেমে ব্যর্থতাসহ বিভিন্ন কারণে হতাশা, মানসিক অশান্তি ও মানসিক অস্থিরতার ফলে শিক্ষার্থীদের মাঝে এ ধরনের প্রবণতা বেড়েই চলছে। শিক্ষার্থীদের মাঝে আত্মহত্যার প্রবণতাসহ আত্মহত্যার চেষ্টার প্রবণতা বেড়ে চলারসহ অনেক শিক্ষার্থী মানসিক অশান্তি ও অস্থিরতায় ভুগলেও অধিকাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই নেই কোন পেশাদার পরামর্শক বা কাউন্সিলার।
কোনো শিক্ষার্থী যদি আত্মহত্যা করেন বা আত্মহত্যা করার চেষ্টা করেন, তবে তা হবে সমাজ-দেশ ও জাতির জন্য অত্যন্ত লজ্জার একটি বিষয়। কারণ, শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে তাদের পরিবারসহ সমাজ, দেশ ও জাতি ভালো অনেক কিছু আশা করেন। একজন শিক্ষার্থীকে স্কুল-কলেজ কিংবা বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে আসতে তাঁর অভিভাবকসহ ওই শিক্ষার্থীকে অনেক ত্যাগ-তিতীক্ষা ও সংগ্রাম করতে হয়। পাড়ি দিতে হয় অনেক দুর্গম ও বন্ধুর পথ। এ বিষয়গুলো প্রতিটি শিক্ষার্থীরই উপলব্ধি করা প্রয়োজন। তাঁদের স্মরণ রাখা উচিত, অনেক আশা-ভরসা নিয়ে তাঁদের বাবা-মা বা অভিভাবকরা তাঁদেরকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে লেখা-পড়া শেখাতে পাঠান।
মানুষের জীবনেই সমস্যা আসে এবং সমস্যা আসবেই-এটিই স্বাভাবিক। তার মানে এই নয় যে, জীবনে সমস্যা আসলে বা সমস্যায় পড়লে আত্মহত্যা করে জীবনকে শেষ করে দিতে হবে। বরং জীবনে সমস্যা আসলে সকলকেই আবেগ নির্ভর না হয়ে সুস্থ মস্তিস্কে ও বাস্তবতার আলোকে সেই সমস্যার সমাধান করা প্রয়োজন। প্রয়োজনে কোন মনোরোগ বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হওয়া। যখন কেউ আত্মহত্যা করেন বা আত্মহত্যার চেষ্টা করেন, তখন ধরে নেওয়া হয় যে এটি তাঁর মানসিক অস্থিরতা বা আবেগ দ্বারা তাড়িত হওয়ার ফলাফল। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে আত্মহত্যার পেছনের কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে পারিবারিক বা ব্যক্তিগত সম্পর্কের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হওয়া, সম্পর্কের বিচ্ছেদ ঘটা, পরীক্ষায় আশানুরুপ ফলাফল লাভ করতে না পারা, অপরিসীম অর্থকষ্ট, ধর্ষণ, যৌন, শারীরিক বা মানসিক নির্যাতন-নিপীড়ন, মাদকাসক্তি সংক্রান্ত সমস্যা, নানা ধরনের মানসিক অসুস্থতা ইত্যাদি।
এসবের পাশাপাশি রয়েছে প্রিয় কোন নেতা, অভিনেতা, শিল্পী, খেলোয়াড়ের আকস্মিক মৃত্যুর খবর; কর্মস্থল বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সহকর্মী বা সহপাঠীদের সাথে ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হওয়া, দীর্ঘদিনের বেকারত্ব বা হঠাৎ চাকরিচ্যুতি বা চাকরিতে পদাবনতি ঘটা, ‘এ পৃথিবীতে কেউ আমাকে চায় না’; ‘এ পৃথিবীতে বেঁচে থেকে আমার কোন লাভ নেই’-এ জাতীয় বদ্ধমূল চিন্তাভাবনা ইত্যাদি। এসব চিন্তার ফলে মনের মধ্যে সৃষ্টি হওয়া প্রচণ্ড রকমের হতাশা ও ক্ষোভের কারণে মানুষ তার নিজের প্রতি আস্থা ও সম্মানবোধ হারিয়ে ফেলে। আর তখন থেকেই সে সকলের কাছ থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিতে শুরু করে এবং একসময় আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। আবার কিছু ব্যর্থতাও মানুষকে আত্মহত্যার পথে ঠেলে দেয়। পরিবারের সকল সদস্যের মৌলিক চাহিদা পূরণ করতে না পারা, দীর্ঘদিনেও ঋণমুক্তির উপায় খুঁজে না পাওয়া ইত্যাদি। এছাড়াও প্রেমে ব্যর্থতাসহ প্রেমিক-প্রেমিকার ইচ্ছাপূরণের জন্য জেদের বশবর্তী হয়েও অনেক তরুণ-তরুণীকে আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে দেখা যায়। দু:খজনক হলেও সত্য, আমাদের দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়, স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা এক্ষেত্রে এগিয়ে রয়েছেন। বলা বাহুল্য, আত্মহত্যাজনিত মৃত্যুর অধিকাংশই প্রতিরোধযোগ্য। অধিকাংশ ব্যক্তিই আত্মহত্যার সময় কোনো-না-কোনো গুরুতর মানসিক রোগে আক্রান্ত হয়ে থাকেন। স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন, শারীরিক ও মানসিক যেকোনো অসুস্থতায় যথাযথ স্বাস্থ্যসেবা লাভের সুযোগ আত্মহত্যা প্রবণতা কমায়। পাশাপাশি আত্মহত্যা প্রতিরোধে কিছু বিষয় রয়েছে যেগুলোকে প্রোটেকটিভ ফ্যাক্টর বা রক্ষাকারী বিষয় বলা হয়। যেমন: জীবনের খারাপ সময়গুলোতে খাপ খাইয়ে নেওয়ার ক্ষমতা জন্মানো, নিজের প্রতি শ্রদ্ধা ও আত্মবিশ্বাস জন্মানো, সমস্যা সমাধানের কার্যকর দক্ষতা বাড়ানো এবং প্রয়োজনে অন্যের কাছ থেকে ইতিবাচক সহায়তা লাভের চেষ্টা করা ইত্যাদি। তাছাড়া সামাজিক ও ধর্মীয় রীতিনীতি, অনুশাসন, ভালো বন্ধু, প্রতিবেশী ও সহকর্মীর সঙ্গে সামাজিক সুসম্পর্ক প্রভৃতি আত্মহত্যাপ্রবণতা হ্রাসে সহায়তা করে। এছাড়া সুষম খাদ্য গ্রহণ, পর্যাপ্ত নিদ্রা, নিয়মিত শরীরচর্চা, ধূমপান ও মাদকাসক্তি থেকে দূরে থাকা তথা স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন এবং শারীরিক ও মানসিক যেকোনো অসুস্থতায় যথাযথ স্বাস্থ্যসেবা লাভের সুযোগ আত্মহত্যা প্রবণতা কমায়। সুতরাং, শিক্ষার্থীদের হতাশা ও মানষিক অশান্তি থেকে উত্তরণের জন্য দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দ্রুত পেশাদার কাউন্সিলর নিয়োগ করা প্রয়োজন। আর তা সম্ভব হলে শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার চেষ্টা চালানো কিংবা আত্মহত্যা করার প্রবণতা অনেকটাই কমে আসবে বলে আশা করা যায়। সর্বোপরি, আত্মহত্যার বিভিন্ন নেতিবাচক দিক তুলে ধরে নিয়মিতভাবে তা প্রচার-প্রচারণারও ব্যবস্থা করাও আবশ্যক।
শিক্ষার্থীসহ সকলকেই জীবনের গুরুত্ব ও মূল্য সম্পর্কে বুঝতে হবে। সবাইকে বুঝতে হবে যে, জীবন একটাই এবং তা মহামূল্যবান। জীবন একবার হারালে তা আর কোনো কিছুর বিনিময়েই ফিরে পাওয়া সম্ভব নয়। এবং জীবনটাকে যদি সুন্দরভাবে সাজানো যায়, তাহলে জীবনকে সুন্দরভাবে উপভোগও করা যায়। তাই আসুন, আমরা সকলেই আত্মহত্যার চিন্তা ও আত্মহত্যার পথ পরিহার করে এখন থেকেই আমাদের জীবনটাকে ভালোভাবে ভালোবাসতে শিখি।
লেখক: অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, আইন বিভাগ, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি
এসএ/