রাজেকুজ্জামান রতন
মৃত্যু, মৃত্যুদণ্ড এবং তারপর?
দেশের মানুষ যখন শুনেছিল সারারাত ধরে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্রকে তারই বিশ্ববিদ্যালয়ের সহপাঠীরা পিটিয়ে পিটিয়ে হত্যা করেছে। আহত সেই ছাত্র যন্ত্রণায় কাতরেছে, অনুনয় করেছে আর না মারার জন্য, নিজের পরিচয় দিয়ে বারবার বলেছে যারা তাঁকে মারছে সেও তাদের রাজনীতি করে, মার খেতে খেতে মৃত প্রায় সেই ছাত্র তরুণ যার নাম আবরার ফাহাদ একটু পানি খেতে চেয়েছিল কিন্তু পায় নি। কিল ঘুষি শুধু নয়, ক্রিকেট খেলার স্ট্যাম্প সহ লাঠি সোটা দিয়ে মারতে মারতে যখন দেখেছে মরেই গেল তখন তোষকে মুড়িয়ে সিঁড়ির নিচে রেখে এসেছিল তাঁকে। এই বর্ণনা দিয়েছিল যারা মেরেছে তাদেরই কয়েকজন। মানুষ পত্রিকায় এসব পড়ে শিউরে উঠেছে, অনেকেই পড়তে পারেন নি। কেউ কেঁদেছেন, কেউ স্তব্ধ হয়ে ভেবেছেন, এও কি সম্ভব !
দুই বছর আগে ২০১৯ সালের ৬ অক্টোবর বুয়েটের শেরেবাংলা হল থেকে তড়িৎ ও ইলেকট্রনিকস প্রকৌশল বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র আবরার ফাহাদের আঘাতে আঘাতে প্রায় থেঁতলে যাওয়া লাশ উদ্ধার করা হয়। সারাদেশে প্রতিবাদের ঝড় উঠে। প্রথম দিকে বুয়েট এর ছাত্র ছাত্রীরা আতংকিত হলেও পরবর্তীতে তাঁরাও নেমে আসে প্রতিবাদ বিক্ষোভে। নির্যাতিত ও নিহত আবরারের বাবা সন্তান হত্যাকারীদের বিরুদ্ধে চকবাজার থানায় হত্যা মামলা করেন।
সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট, প্রগতিশীল ছাত্র জোট সহ বিভিন্ন ছাত্র সংগঠন, রাজনৈতিক মহল, সামাজিক সংগঠন দেশব্যাপী যে প্রতিবাদ গড়ে তোলে তার ফলে এই হত্যা মামলাটি দ্রুত তদন্ত করে বুয়েটের ২৫ শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে ২০১৯ সালের ১৩ নভেম্বর পুলিশ আদালতে অভিযোগপত্র দেয়। তদন্ত প্রতিবেদন আমলে নিয়ে গত বছরের ১৫ সেপ্টেম্বর আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন আদালত। আসামিদের মধ্যে ২২ জনকে গ্রেফতার করা হয়। পলাতক হয় তিনজন। ছাত্রলীগ বহিস্কার করে ঘটনার সঙ্গে জড়িত সকলকেই।
এরপর দুই বছর ধরে মামলা চলার পর সাক্ষ্য প্রমাণ শেষে বুয়েট ছাত্র আবরার ফাহাদ হত্যা মামলায় ২০ জনকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন আদালত। ৫ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। ৮ ডিসেম্বর ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-১-এর বিচারক এ রায় ঘোষণা করেন। শাস্তির রায় ঘোষণার যুক্তি হিসেবে আদালতে বিচারক বলেন, নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পুনরাবৃত্তি ঠেকাতে আসামিদের সর্বোচ্চ শাস্তির রায় দেওয়া হয়েছে।
রাগে উত্তেজনায় কাউকে আঘাত করার মধ্যে খুব একটা অস্বাভাবিকতা নেই। দুই পক্ষের সংঘর্ষে লাঠির আঘাতে বা গুলিতে কেউ মারা যাওয়া বা টার্গেট করে কাউকে হত্যা করা বা অকস্মাৎ আঘাতে মরে যাওয়া এক কথা। কিন্তু একজন সহপাঠীকে রাতভর পিটিয়ে পিটিয়ে হত্যা করার মধ্যে বিকৃত আনন্দ উপভোগ করা সম্পূর্ণ আলাদা কথা। আবরারকে পিটিয়ে অর্ধমৃত রেখে তারা রাতের খাবার খেয়েছে, খেলা দেখেছে। সবাই মিলে এ অবস্থায় যেতে পারলো কি ভাবে? এই ধরণের নৃশংসতার কোনও নজির কি আছে? অনেকেই বলেন ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের এই নৃশংসতার তুলনা হতে পারে কেবল ছাত্রলীগের সঙ্গেই। ২০১২ সালে পুরান ঢাকায় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা কুপিয়ে হত্যা করেছিল বিশ্বজিৎ দাসকে। এ দুটি ঘটনায় কোনটি বেশি নৃশংস তা নিয়ে তর্ক হতে পারে। অনেকেই বিশ্বজিৎ হত্যাকাণ্ডকেই শীর্ষে রাখবেন। কারণ, বিশ্বজিৎ হত্যাকাণ্ডটি ঘটেছিল দিনের বেলায় সবার চোখের সামনে। সব টিভির ক্যামেরায় তার ছবি আছে। এক্ষেত্রে বলা যায় ঘটনাটি তাৎক্ষনিক উত্তেজনায়, স্রেফ সন্দেহের ভিত্তিতে স্বল্পসময়ে ঘটেছে। কিন্তু আবরার হত্যাকাণ্ড তা নয়। প্রস্তুতি নিয়ে এই ভয়াবহ ও নৃশংস ঘটনা ঘটানো হয়েছে। একই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীকে রুম থেকে ডেকে নিয়ে দলবেঁধে দফায় দফায় পিটিয়ে হত্যা করার মধ্যে ঠান্ডা মাথায় নির্মমতার কি কোনও তুলনা হয়।
আবরার ফাহাদের অপরাধ ছিল, তিনি বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের সমালোচনা করে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছিলেন। এর জন্যে কি কাউকে পেটাতে হবে? ছাত্রলীগ তখন আইন হাতে তুলে নিয়ে কি বুঝাতে চেয়েছিল আওয়ামী লীগ সরকারের ওপর, আইনের শাসনের ওপর তাদের আস্থা নেই।
সাধারণত বলা হয়ে থাকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হলে অপরাধী ভয় পাবে এবং অপরাধ প্রবণতা কমবে। শাস্তি দেয়ার আইন, শাস্তি কার্যকর করার এত ব্যবস্থা সত্ত্বেও অপরাধ কি কমছে? শাস্তির ঝুঁকি আর অপরাধের ফলে অর্জিত সুবিধা এই দুইয়ের তুলনামূলক বিচারে সুবিধা পেতে শাস্তির ঝুঁকি নিতে পিছু পা হয় না অনেকেই। এর সাথে ক্ষমতার রসায়ন মিলে গেলে তো সোনায় সোহাগা। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে ছাত্রলীগের কোন কোন নেতা কর্মী শাস্তি পেয়েছে, বহিস্কার হয়েছে কিন্তু ক্ষমতার দম্ভে ছাত্রলীগের বেপরোয়া আচরণ কি কমেছে? দেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বেআইনি কর্মকাণ্ড, হল দখল, গেস্টরুম, গণরুম- নানা প্রক্রিয়ায় তারা সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর নির্যাতন চালায়। কুয়েটে তাদের নির্যাতনে প্রভোস্টের মৃত্যুর ঘটনা ঘটে গেলো। তাদের নিজেদের অন্তর্দ্বন্দ্বেও বিপর্যস্ত হয় শিক্ষার পরিবেশ, বন্ধ হয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। কেউ মৃত্যুবরণ করলে আলোচনার ঝড় উঠে কিন্তু প্রতিদিন ছাত্রলীগের নির্যাতনের অসংখ্য খবর অন্তরালে চাপা পড়ে থাকে।
এই যে আদালতের রায়ে দণ্ডিত হলো বুয়েট ছাত্রলীগের ২৫জন নেতাকর্মী তারা কিন্তু খুনি হতে বুয়েটে ভর্তি হয়নি, ভর্তি হয়েছিল প্রকৌশলী হতে এবং তারা মেধার ভিত্তিতেই ভর্তি হয়েছিল। কি প্রক্রিয়ায় বা কেন তারা এই মানসিকতা অর্জন করলো তা যদি বিচার করা না হয় তাহলে একটা দুইটা আলোচিত মামলার রায়ে মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়ে খুনি মানসিকতা তৈরির এই প্রক্রিয়া বন্ধ হবে না। যারা তাদের খুনি বানায়, তাদেরকে কি খুঁজে বের করা হয়েছে কখনো? আর অতীতেও অনেক কঠিন রায় হয়েছে কিন্তু ফলাফল কি? তাই শুধু কঠোর শাস্তির রায় হলেই অপরাধ থামবে না। সে রায় কার্যকর হবে কি না তার নিশ্চয়তা নিয়েও সংশয় আছে, ক্ষমা পাওয়ার সম্ভাবনা আছে। যেমন ৯ বছর পরও নৃশংসভাবে নিহত বিশ্বজিৎ হত্যা মামলার রায় কার্যকর হয়নি। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি নিশ্চিন্তে ঘুরে বেড়াচ্ছে এই সমাজে কারণ তাদের রাজনৈতিক সুরক্ষা আছে এবং তারা ক্ষমতা বলয়ের আশেপাশেই আছে।
রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ক্ষমতার দম্ভে বেপরোয়া হয়ে ওঠা ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীদের থামানোর আকুল আবেদন করছেন অনেকেই। কেউ আবার বলছেন ব্যবস্থা তো নেয়া হচ্ছে। কিন্তু নতুন নতুন ঘটনার কারণে এটা এখন দিনের আলোর মত পরিস্কার যে এতে কাজ হচ্ছে না। এই দুর্বৃত্তপনার উৎসের সন্ধান করতে হবে। কারণ লতিফ সিদ্দিকী, সম্রাট, পাপিয়া, সাহেদ, শোভন বা জাহাঙ্গীর আলমের পরিনতি দেখেও তো নিবৃত্ত হয়নি ডা. মুরাদ হাসান। চাঁদাবাজির অভিযোগে কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি-সাধারণ সম্পাদককে বহিষ্কার করেও তো থামানো যাচ্ছেনা ছাত্রলীগকে।
নিম্ন আদালতের রায় হয়েছে, এটা একটা দৃষ্টান্ত। আবরারের মা বলেছেন শাস্তি দেখতে চাই। আর সাজা প্রাপ্তদের বাবা রা বলছেন, চিন্তা কোরো না বাবা। উচ্চতর আদালত থেকে ছাড়িয়ে আনবোই। দুজনেই তো বাবা ! তাই শাস্তি থেকে শিক্ষা নিতে হবে। আইনের কঠোর প্রয়োগ, দ্রুত বিচার, রায় কার্যকর কি পারবে এই প্রবণতা থামাতে ? যে ব্যবস্থা ও রাজনৈতিক সংস্কৃতি একদল মেধাবী ছাত্রের মনে খুনের সংস্কৃতি গড়ে তোলে তা কি অধরাই থেকে যাবে? না কি পাল্টা রাজনীতি ও সংস্কৃতি গড়ে তোলার পথে এগিয়ে আসবেন এটিই এখন বড় প্রশ্ন। এর উত্তর খুঁজে নেয়ার মধ্যেই আছে আমাদের ভবিষ্যৎ। আবরার হত্যা মামলার রায়ের ক্ষেত্রে এই কথাটি প্রযোজ্য। এই ঘটনায় আবরার তো নির্মম হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেনই একই সঙ্গে ধ্বংস হয়ে গেলো আরও ২৫ মেধাবীর জীবন, আজীবন বেদনা বহন করবে তাদের পরিবার। দণ্ডিত ২৫ জনই বুয়েটের শিক্ষার্থী। এমন মেধাবী ২০ জনকে মৃত্যুদণ্ড এবং ৫ জনকে যাবজ্জীবন দিতে গিয়ে বিচারকের হৃদয়ও নিশ্চয়ই ক্ষণিকের জন্য হলেও কেঁদেছে। তারুণ্যের কি বেদনাময় অপচয়!
একটা কথাই ঘুরপাক খাচ্ছে অনেকের মনে। এই মৃত্যুর দায় কে নেবে ? কেউ কি নেবে ? ২০ জন তরুণকে ফাঁসির দণ্ড এবং ৫ জনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড পেতে হলো কেন? বাংলাদেশের অন্যতম সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে এসে খুনি মানসিকতা গড়ে উঠেছিল কেন তাদের? যারা এবং যে রাজনীতি তাদেরকে এই পথে এনেছিলো তাদের পরিচয় উদঘাটন করাটাও জরুরী।
লেখক: সদস্য, কেন্দ্রীয় কমিটি, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ)