পাহাড়ে বাঙালিদের নেওয়া হয়েছে খারাপ উদ্দেশ্যে: বিচারপতি নাসিম
পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তি বাস্তবায়ন নিয়ে এক আলোচনা সভায় বিচারপতি মো: নিজামুল হক নাসিম বলেছেন, পার্বত্য চুক্তিতে ৪ টি খন্ড ও ৭২ টি ধারা। এই ২৫ বছরে তার কতটুকু বাস্তবায়ন হয়েছে তার প্রেক্ষিতে দুটি পক্ষের বক্তব্যের মধ্যে পার্থক্য আছে। সরকার বলছে এই চুক্তির অধিকাংশ ধারায় বাস্তবায়ন হয়েছে। অপরদিকে জনসংহতি সমিতি বলছে পার্বত্য চুক্তির ৭২ টি ধারার মধ্যে এ পর্যন্ত মাত্র ২৫ টি ধারা সম্পূর্ণরূপে বাস্তবায়িত হয়েছে এবং ১৮ টি ধারা আংশিক বাস্তবায়িত হয়েছে। অবশিষ্ট ২৯ টি ধারা সম্পূর্ণ অবাস্তবায়িত অবস্থায় রয়েছে। কাজেই এই দুই বক্তব্যের মধ্যে বিরাট পার্থক্য আছে।
শনিবার (৮ এপ্রিল) জাতীয় প্রেসক্লাবের তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া হল রুমে ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নে দেশবাসীর দায় ও করণীয়’ শীর্ষক এক মতবিনিময় সভায় তিনি এসব কথা বলেন।
পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন আন্দোলন এর আয়োজনে উক্ত প্লাটফর্মের যুগ্ম সমন্বয়কারী ও মানবাধিকার কর্মী জাকির হোসেন এর সঞ্চালনায় মতবিনিময় সভায় আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. এম এম আকাশ, একই বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক ড. মেসবাহ কামাল, এএলআরডি’র নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদা, কবি ও সাংবাদিক সোহরাব হাসান, ডাকসু’র সাবেক সাধারণ সম্পাদক ডা. মুশতাক হোসেন প্রমুখ। মূল বক্তব্য উপস্থাপন করেন পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন আন্দোলন এর যুগ্ম সমন্বয়কারী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. খায়রুল ইসলাম চৌধুরী।
বিচারপতি নিজামুল হক নাসিম বলেন, পার্বত্য চুক্তির (ক) খন্ডের ৪ ধারায় বলা হয়েছে যে, এই চুক্তি উভয়পক্ষ কর্তৃক সম্পাদিত ও সই করবার তারিখ হতে বলবৎ থাকবে। বলবৎ হবার তারিখ হতে এই চুক্তি অনুযায়ী উভয়পক্ষ হতে সম্পাদনীয় সকল পদক্ষেপ সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত এই চুক্তি বলবৎ থাকবে। কাজেই এই চুক্তির মৌলিক বিষয়সমূহ যেহেতু এখনো বাস্তবায়িত হয় নাই, কাজেই এই চুক্তি এখনও বলবৎ আছে।
তিনি বলেন, আমি মনে করি, পার্বত্য চুক্তি নিয়ে পাহাড়ের মানুষ ঐক্যবদ্ধ। পার্বত্য চুক্তি নিয়ে পাহাড়ের মানুষের দৃষ্টি ভঙ্গি এখনও তাই। এই চুক্তি নিয়ে তাদের মধ্যে রাজনৈতিক বিরোধ থাকলেও মৌলিক কোনো বিভেদ নাই। পাহাড়ের সকল মানুষ চুক্তি বাস্তবায়ন চায়।
তিনি আরও বলেন, ১৯৭৯ সাল থেকে পাহাড়ে যে বাঙালি সেটলারকে নেয়া হয়েছে, তাদেরকে কার জায়গায় বসানো হয়েছিল। পাহাড়ীদের জায়গা ভাগ করে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু যাদেরকে নেওয়া হয়েছে তার পেছনে উদ্দেশ্যই ছিল খারাপ। উদ্দেশ্য ছিল পাহাড়ীদের নাম্বার কমিয়ে দিয়ে বাঙালিদের নাম্বার বাড়িয়ে দেয়া।
তিনি আরও বলেন, আমি আমার বন্ধু আনোয়ারুল হক (পার্বত্য ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশনের চেয়ারম্যান)কে জিজ্ঞেস করেছিলাম কমিশনের খবর কী। তিনি বলেছিলেন, পাহাড়ে তো যেতেই পারি না। গেলেই হরতাল ডাকে, অবরোধ দেয়। আমি তাকে পরামর্শ দিয়েছিলাম অন্তত মিটিংগুলো যেন ঢাকায় করে। আমি জানিনা, তারা করতে পারবে কী না।
অধ্যাপক ড. এম এম আকাশ বলেন, আমরা যে এটাকে শান্তি চুক্তি বলেছি, তার মানে এর আগে একটা অশান্তি ছিল। কেন অশান্তি ছিল কারণ তৎকালীন সরকার পাহাড়ে বাঙালিদের মেজোরিটি বানিয়ে সেখানে পাহাড়ীদেরকে প্রান্তিক করে দুই জনগোষ্ঠীর মধ্যে একটা সংঘাত বাধিয়ে দেওয়া। এই সংঘাত থেকে মুক্তির জন্য যে চুক্তি হয়েছিল তা এখনও বাস্তবায়িত হয়নি।
অধ্যাপক ড. মেসবাহ কামাল বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যাটা শুধু পাহাড়ের সমস্যা নয়। এটা একটা জাতীয় সমস্যা, এই সমস্যার নিষ্পত্তি রাজনৈতিকভাবে করতে হবে। তার জন্য স্বাক্ষরিত পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন করতে হবে। এর জন্য যদি নাগরিকদের মধ্যে তাড়না তৈরী করা না যায় তাহলে এই চুক্তির বাস্তবায়নে চাপ তৈরী হবে না।
এএলআরডি’র নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদা বলেন, জাতিসংঘের একটি পরিসংখ্যান আছে যে, পুরো পৃথিবীতে ৫ ভাগ আদিবাসী। এই ৫ ভাগ আদিবাসীই পুরো পৃথিবীর ৮০ ভাগ জীব বৈচিত্র্য রক্ষায় ভূমিকা রাখছে। কাজেই পুরো পৃথিবী রক্ষার জন্য এই আদিবাসীদেরকে রক্ষা করতে হবে।
পাহাড়ে যত বেশি আর্মি ক্যাম্প ও ক্যান্টনমেন্ট কমবে তত বেশি শান্তি ফিরবে দাবী করে তিনি আরো বলেন, পাহাড়ে সিভিল প্রশাসন কাজ করতে পারে না। পাহাড়ে কাজ করে সামরিক প্রশাসন। এটা শুধু অন্যায় না। এটা অসাংবিধানিক এবং অঘোষিত।
কবি ও সাংবাদিক সোহরাব হাসান বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির মৌলিক শর্তগুলোয় বাস্তবায়ন হয়নি। বলা হয়েছিল পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চল ‘উপজাতি’ অধ্যুষিত অঞ্চল হবে। কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রাম এখন বাঙালি সংখ্যা গরিষ্ঠ হয়ে গেছে। কাজেই চুক্তি করে যারা চুক্তি ভঙ্গ করেছে তাদের বিরুদ্ধে এই ধরণের মত বিনিময় সভা করে খুব একটা লাভ হবে না।
তিনি আরও বলেন, পাহাড়ের প্রধান সমস্যা ভূমি। এই সমস্যা সমাধানের জন্য একটি ভূমি কমিশন গঠিত হয়েছে। কিন্তু এই কমিশন একটি সভা করতে পারে না। সভা ডাকলে হরতাল, অবরোধ ডাকা হয়। কাজেই বুঝতে হবে, সরকার চুক্তি বাস্তবায়নে তার দৃষ্টি ভঙ্গি থেকে সরে গেছে। কেন শুধুমাত্র আমলাদের দায়ী করব। পাহাড়ে কত বুদ্ধিজীবি, পেশাজীবি, রাজনৈতিক নেতা জমি কিনে ভূমি দখল করছে তারও তালিকা করা জরুরী। পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন না হলে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হবে বলেও মনে করেন তিনি।
ডাকসু’র সাবেক সাধারণ সম্পাদক ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, পাহাড়ে চুক্তি হয়েছে। কিন্তু পাহাড়ে ভূমি হারানো আদিবাসীরা কেন তাদের জমি ফেরত পাবে না। সেখানে কেন পাহাড়ীদেরকে উচ্ছেদ করে বাঙালিদেরকে প্রতিস্থাপন করা হবে। আমার টাকা থাকলে যে ইচ্ছামত জমি কিনতে পারবো তা কীভাবে হবে। কুমিল্লার মানুষ যদি বরিশালের সমস্ত জায়গা কিনে নেয় তখন কী বরিশালের মানুষ মেনে নেবে? পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন না করে যদি আরো বিভেদ তৈরী করা হয় তবে সংকট আরো ঘনীভূত হবে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে দেশের জনমতকে যদি চুক্তি বাস্তবায়ন আন্দোলনে সম্পৃক্ত করতে না পারি তাহলে চুক্তি বাস্তবায়ন করাটা কঠিন বলেও মনে করেন ডাকসুর সাবেক সাধারণ সম্পাদক।
এনএইচবি/এএস