চলতি বছরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হেফাজতে ৪৪ জনের মৃত্যু!
হাতিরঝিল থানায় সুমন শেখ ওরফে রুম্মন শেখের মৃত্যুর ঘটনায় বিচার চেয়ে পুলিশের বিরুদ্ধে বিভিন্নভাবে আন্দোলন করছে ওই এলাকার সাধারণ মানুষ। পরিবার ও সাধারণ মানুষের অভিযোগ, তাকে হত্যা করা হয়েছে। পুলিশ বলছে আত্মহত্যা করেছেন সুমন।
থানায় কিভাবে একজন আসামি আত্মহত্যা করে? সুমন মারা যাওয়ার সময় ডিউটিরত পুলিশ কি করছিল? এর দায় কার? এভাবে যদি থানায় মানুষ মারা যায় তাহলে মানুষের সিকিউরিটি কোথায়— বলছেন বিশেষজ্ঞরা।
আইন ও সালিস কেন্দ্রের (আসক) এক পরিসংখ্যান বলছে, চলতি বছরের জানুয়ারি মাস থেকে এ পর্যন্ত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজতে ৪৪ জনের মৃত্যু হয়েছে।
সুমনের মৃত্যু নিয়ে সোমবার (২২ আগস্ট) দিনগত রাতে রামপুরায় সড়ক অবরোধ করে আন্দোলনের সময় নিহতের পরিবার ও সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে এ বিষয়ে বেশ কিছু তথ্য উঠে এসেছে।
আপনারা কিভাবে জানেন সুমন শেখ মারা গেছেন- এমন প্রশ্নের জবাবে নিহত সুমনের স্ত্রীর বড় ভাই মোশাররফ হোসেন ঢাকাপ্রকাশ’কে বলেন, ‘পুলিশ আমাদের জানিয়েছে চুরির অভিযোগে শুক্রবার রাতে হাতিরঝিল থানায় সুমনকে গ্রেপ্তার করা হয়। গ্রেপ্তারের পর পুলিশ তার সঙ্গে আমাদের দেখা করতে দেয়নি। বিভিন্ন অজুহাত দেখায়। পরে আমরা তার জন্য খাবার পাঠায় পুলিশ সেটা গ্রহণ করে। এরপর সকাল থেকে আমরা থানার সামনে দাঁড়াই সুমনকে বের করে না পুলিশ। পরে আমাদের বলা হয় সে আত্মহত্যা করেছে’।
তিনি আরও বলেন, মনে হয় সুমনকে পুলিশ আগে থেকে অনেক মারধর করেছিল এজন্য আমাদের সঙ্গে তাকে দেখা করতে দেয়নি। তিনি বলেন, এভাবে সুমন মারা যেতে পারে না, পুলিশ তাকে হত্যা করেছে। আমরা এই ঘটনার সুষ্ঠু বিচার চাই।
সুমনের মৃত্যুতে এলাকাবাসীর সড়ক অবরোধ করে আন্দোলন
এদিকে হাতিরঝিল থানা পুলিশ বলছে, নিহতকে চুরির মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়। গ্রেপ্তারের দিন রাতে সুমন থানার মধ্যে আত্মহত্যা করেন। এরপর তার লাশ নামানোর জন্য একজন ম্যাজিস্ট্রেটকে আনা হয়। ম্যাজিস্ট্রেটের উপস্থিতিতে আমরা তার ঝুলন্ত লাশ নিচে নামিয়ে ময়নাতদন্তের জন্য শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজের মর্গে পাঠাই।
তবে পুলিশের এসব কথা মানছে না ভুক্তভোগীর পরিবার। তাদের অভিযোগ, সুমনকে মেরে ফেলা হয়েছে। আত্মহত্যার কথা বলে পুলিশ দায় এড়িয়ে যেতে চাচ্ছে।
এদিকে আইন ও সালিস কেন্দ্রের (আসক) এক পরিসংখ্যানে জানা যায়, চলতি বছরের জানুয়ারি মাস থেকে জুলাই মাস পর্যন্ত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজতে ৪০ জনের মৃত্যু হয়েছে।
আসকের আরেকটি তথ্য বলছে, চলতি মাস আগস্টে পুলিশি নিযার্তনে ৪ জন মানুষ মারা গেছে বলে অভিযোগ রয়েছে, সেটি আগস্টে শেষে বা সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে আসক গণমাধ্যমকে জানাবেন। আসকের দাবি, চলতি বছর ২০২২ সালের আগস্ট পযর্ন্ত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজতে ৪৪ জন মানুষ মারা গেছেন।
এসব বিষয়ে অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জেল-হাজতখানায় থাকা আসামির নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব হলো পুলিশের। হাতিরঝিল থানার মধ্যে সুমন শেখের মৃত্যুর ঘটনার দায় পুলিশ এড়িয়ে যেতে পারে না। এটা অবশ্যই পুলিশের একটি ব্যর্থতা। মানুষ এজন্য পুলিশের উপর থেকে আস্থা হাারিয়ে নিহতের স্বজনদের সঙ্গে মিশে বিভিন্ন আন্দোলন করছে। যা পুলিশকে একটি খারাপ বার্তা দিচ্ছে।
সুমনের মৃত্যুর বিষয়ে আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) নির্বাহী পরিচালক মো. নূর খান ঢাকাপ্রকাশ’কে বলেন, পুলিশ হেফাজতে যেহেতু হাতিরঝিল থানায় সুমনের নিহতের ঘটনাটি ঘটেছে, তাই এই দায় থানা পুলিশের উপর পড়ে।
তিনি বলেন, সিসিটিভির ভিডিও ফুটেজে দেখা গেছে, সে হয়ত আত্মহত্যার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে বা কিছু একটা করছে। পুলিশ যদি সর্তক থাকত, তাহলে এই ঘটনাটি ঘটত না। থানার মধ্যে আত্মহত্যার বিষয়টি মানুষ স্বাভাবিকভাবে মেনে নেবে না। এটি আত্মহত্যা হলেও থানায় কর্তব্যরত পুলিশের সদস্যরা এর দায় কোনোভাবেই এড়িয়ে যেতে পারবেন না।
মো. নূর খান আরও বলেন, নিহত সুমন শেখ মারা যাওয়ার পর তার লাশ নিয়ে অনেক কথা বলেছে পুলিশ। এজন্য তার পরিবার জানিয়েছে, তারা পুলিশের নামে মামলা করে, লাশ গ্রহণ করবেন। যেহেতু পুলিশ হেফাজতে থেকে সুমন মারা গেছেন এক্ষেত্রে পুলিশের একটু নিরব ভুমিকা গ্রহণ করা উচিত ছিল।
সুমনের নিহতের সিসিটিভি ফুটেজ নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ রয়েছে এমনটা জানিয়ে নিহতের স্ত্রী জান্নাত আক্তার ঢাকাপ্রকাশ’কে বলেন, আমরা সিসিটিভি ফুটেজ দেখেছি, ওইটাই যে সুমন সেটা ভালো করে বোঝা যাচ্ছে না। আপনারা লাশ নেননি কেন? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, পুলিশ লাশ নিতে বাধা দিয়েছে। এরপর আমরা পুলিশের বিরুদ্ধে মামলা করতে চেয়েছি, এখন পুলিশ বলছে তার লাশ মর্গে রয়েছে সেখান থেকে নিতে হবে।
এদিকে সুমনের মৃত্যু নিয়ে সংশ্লিষ্ট বিভাগের পুলিশ কর্মকর্তারা বলছে, সুমন শেখ থানা হেফাজতে গভীর রাতে আত্মহত্যা করেছে এতে কোনো সন্দেহ নেই। তাদের দাবি, বর্তমান প্রতিটা থানায় সিসিটিভির ফুটেজ রয়েছে কাউকে হত্যা বা নিযার্তন করা কোনোভাবেই সহজ নয়। কারণ থানার সিসিটিভির ফুটেজ পুলিশের উপরের অফিসাররা নিয়মিত দেখেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে তেজগাঁও বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার আজিমুল হক ঢাকাপ্রকাশ’কে বলেন, আপনি তো আমাদের সঙ্গে গতকাল সিসিটিভির ফুটেজ দেখেছেন সেখানে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে আসামি সুমন শেখ আত্মহত্যার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। হয়ত থানায় ডিউটিরত পুলিশ সদস্যরা অন্য কোনে কাজে ব্যস্ত ছিল, এজন্য তারাও বিষয়টি বুঝতে পারেনি, যদি পুলিশ এমনটা আগে থেকে বা কিছু একটা বুঝতে পারত তাহলে সর্তক থাকত।
তিনি বলেন, থানায় আত্মহত্যার ঘটনায় আমরা দুই পুলিশ সদস্যকে সাময়িক বরখাস্ত করেছি। আমরা আমাদের পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে ও এ বিষয়ে অ্যাকশন নিয়েছি, একই সঙ্গে এ ঘটনায় তিন সদস্যবিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটিও গঠন করা হয়েছে। তদন্ত কমিটি অবশ্যই এর সঠিক তদন্ত করবে।
আজিমুল হক আরও বলেন, সুমন শেখের মরদেহ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের মর্গে পড়ে আছে। তার পরিবার সাংবাদিকদের কাছে অভিযোগ করেছে, পুলিশ তার লাশ নিতে দিচ্ছে না। তাদের এই অভিযোগ মিথ্যা, আমরা তাদের বলেছি, মরদেহ গ্রামের বাড়িতে নিয়ে দাফন করতে হবে। এজন্য তারা মরদেহ বুঝে নিচ্ছে না। তিনি বলেন, নিহতের পরিবার হয়ত কারো ইন্ধনের কারণে মরদেহ নিচ্ছে না।
নিহত সুমনের পরিবার আদলতে হাতিরঝিল থানা পুলিশের বিরুদ্ধে মামলা করতে গিয়েছিল আপনার তাদের হুমকি দিচ্ছেন? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এটা নিয়েও নিহতের পরিবার মিথ্যা কথা বলছে। এ ধরনের কোনো ঘটনা ঘটেনি। তিনি বলেন, হয়ত নিহতের পরিবার কারো দ্বারা ভুলপথে পরিচালিত হচ্ছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে হাতিরঝিল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আব্দুর রশিদ ঢাকাপ্রকাশ’কে বলেন, সুমন শেখকে গ্রেপ্তারের সময় তার কাছ থেকে তিন লাখ ১২ হাজার টাকা উদ্ধার করা হয়। সে যদি নিরীহ মানুষ হয় তাহলে এই টাকা সে কোথায় পেল? এটা চুরির টাকা। তাকে গ্রেপ্তারের পর তিনি সব কিছু স্বীকার করেছেন।
ওসি বলেন, থানা হেফাজতে আসামিকে হত্যা করার কোনো সুযোগ নেই। কারণ সব জায়গায় সিসিটিভি রয়েছে। এটি একটি দুর্ঘটনা মাত্র।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট, অপরাধ বিশেষজ্ঞ তৌহিদুল হক ঢাকাপ্রকাশ’কে বলেন, থানা হেফাজতে বা পুলিশের নিরাপত্তায় কেউ মারা গেলে সেই দায়ভার অবশ্যই পুলিশকে নিতে হবে। অন্যথায় সাধারণ মানুষ এটাকে ভালোভাবে নেবে না।
তিনি বলেন, পুলিশ হলো জনগণের সেবক, সেই জায়গায় থেকে পুলিশকে দায়িত্ব নিয়ে কাজ করতে হবে। অন্যথায় সাধারণ মানুষ ও পুলিশের মধ্যে দ্বন্দ্ব তৈরি হবে, এতে করে মানুষ আইনের প্রতি আস্থা হারাবে।
কেএম/আরএ/