বাধা হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল বিশ্বব্যাংক
পদ্মা সেতুর প্রাক-সম্ভাব্যতা যাচাই হয় দেশীয় অর্থায়নে। ১৯৯৮ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদ্মা নদীতেও একটি সেতু নির্মাণের উদ্যোগ নেন। ১৯৯৯ সালের মে মাসে পদ্মা সেতু প্রকল্পের জন্য প্রাক-সম্ভাব্যতা যাচাই সমীক্ষা (প্রি-ফিজিবিলিটি স্টাডি) শুরু হয়। বলা যায়, এটাই দালিলিকভাবে পদ্মা সেতু নির্মাণ প্রকল্পের প্রথম সূত্রপাত। কিন্তু ২০০১ সালে চারদলীয় জোট ক্ষমতায় আসার পর সেতুর উদ্যোগ থেকে থাকে।
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতা গ্রহণের পর পদ্মা সেতু নির্মাণে অর্থ সহায়তা দিতে এগিয়ে আসে বিশ্বব্যাংক। ২০১১ সালে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে ১২০ কোটি ডলারের চুক্তি স্বাক্ষর করে সংস্থাটি। জাপান সরকারের দাতা সংস্থা জাইকা ৪০ কোটি, এশিয় উন্নয়ন ব্যাংক ৬৪ কোটি এবং ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংক ১৪ কোটি ডলারের সহায়তা দেবে বলেও চুক্তি স্বাক্ষর করে। তাদের মধ্যে বিশ্বব্যাংক ১২০ কোটি ডলার ঋণ দিতে চুক্তি করে ২০১১ সালের ২৮ এপ্রিল। ক্যানাডার এসএনসি লাভালিন কোম্পানি পদ্মা সেতু নির্মাণের কাজ পায়।
অনেকটা আকস্মিকভাবে ২০১১ সালে বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির যড়যন্ত্রের অভিযোগ করে। অভিযোগে বলা হয়, তখনকার যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন, সেতু বিভাগের সচিব মোশাররাফ হোসাইন ভূঁইঞা এবং পদ্মা সেতু প্রকল্প পরিচালক রফিকুল ইসলাম পরামর্শকের কাজ পাইয়ে দেওয়ার বিনিময়ে এসএনসি-লাভালিনের কাছে ১০ শতাংশ অর্থ কমিশন চেয়েছিলেন। প্রকল্পে পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের জন্য বরাদ্দ ছিল চার কোটি ৭০ লাখ ডলার।
পদ্মা সেতু নিয়ে প্রথম শঙ্কা তৈরি হয় ২০১১ ও ২০১২ সালে। এসময় বিশ্বব্যাংক প্রকল্পের নির্মাণকাজ তদারকির জন্য পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগ প্রক্রিয়া চলাকালীন কানাডার একটি কোম্পানি এসএনসি-লাভালিন এর কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের অভিযোগ আনে। একই সঙ্গে বিশ্বব্যাংকসহ একাধিক উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা চুক্তি স্থগিত করে।
বিশ্বব্যাংক দাবি করে, ‘সেতু নির্মাণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকারের কর্মকর্তা, কানাডার পরামর্শক প্রতিষ্ঠান এবং বেসরকারি ব্যক্তিদের মধ্যে যোগসাজশে বিভিন্ন সূত্র থেকে দুর্নীতির বিশ্বাসযোগ্য তথ্য-প্রমাণ তাদের হাতে এসেছে। এসব তথ্য-প্রমাণ বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তৎকালীন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত এবং দুর্নীতি দমন কমিশনের কাছে দেওয়া হয়েছে বলে বিশ্বব্যাংকের বিবৃতিতে বলা হয়। ২০১১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে এবং ২০১২ সালের এপ্রিল মাসে এসব তথ্য-প্রমাণ দেওয়া হয়।’
চুক্তির প্রায় ছয় মাসের ব্যবধানে বিশ্বব্যাংক চুক্তি স্থগিত করে দেয়। কারণ বিশ্বব্যাংকের কাছে প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগ গিয়েছিল ই-মেইলযোগে। তবে বিশ্বব্যাংকের এসব অভিযোগ প্রথম থেকেই প্রত্যাখ্যান করেছিল বাংলাদেশ। কিন্তু তাতে কান দেয়নি বিশ্বব্যাংক।
সমালোচনার মুখে ২০১১ সালের ডিসেম্বরে পদ থেকে সরানো হয় যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন, সেতুসচিব মোশাররাফ হোসাইন ভূঁইঞা এবং সেতু বিভাগের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী কাজী মো. ফেরদৌসকে। এদের মধ্যে মোশাররাফ হোসাইন ভূঁইঞা, কাজী ফেরদৌসকে গ্রেপ্তার এবং সাময়িক বরখাস্তও করা হয়েছিল। মোশাররাফ, কাজী ফেরদৌস এবং এসএনসি-লাভালিনের কর্মকর্তাসহ সাতজনকে অভিযুক্ত করে ২০১২ সালের ১৭ ডিসেম্বর বনানী থানায় মামলা করে দুদক। প্রধান আসামি করা হয় সেতু বিভাগের সাবেক সচিব মো. মোশাররাফ হোসাইন ভূঁইঞাকে। অন্য আসামিরা হলেন সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী রিয়াজ আহমেদ জাবের, ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড প্ল্যানিং কনসালট্যান্ট লিমিটেডের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক, বাংলাদেশে কানাডীয় পরামর্শক প্রতিষ্ঠান এসএনসি-লাভালিনের স্থানীয় প্রতিনিধি মোহাম্মদ মোস্তফা, এসএনসি-লাভালিনের সাবেক পরিচালক মোহাম্মদ ইসমাইল, আন্তর্জাতিক প্রকল্প বিভাগের সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট রমেশ শাহ ও সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট কেভিন ওয়ালেস।
ওই ঘটনায় তদন্তে নেমেছিল দুদকও। অভিযুক্ত ব্যক্তিদের জবানবন্দি নেওয়া এবং যাচাই-বাছাই করে তদন্ত শেষ করে দুদক। ২০১৪ সালের ৩ সেপ্টেম্বর দুদক মামলার সাত আসামির সবাইকে অব্যাহতি দিয়ে আদালতে উপস্থাপনের জন্য চূড়ান্ত প্রতিবেদন অনুমোদন করে। তদন্ত শেষে দুদক জানায়, বিশ্বব্যাংকের অভিযোগ ছিল উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।
গুজব ও অনুমানের পক্ষে কোনো তথ্য-উপাত্ত ছিল না: কানাডার অন্টারিও সুপিরিয়র কোর্টের বিচারক ইয়ান নর্ডহেইমার তার রায়ে বলেন, ২০১১ সালে আরসিএমপি ফোনে আড়ি পাতার জন্য আদালতের অনুমোদন পেতে যে তিনটি আবেদন করেছিল তা নিয়েই তার প্রবল আপত্তি ছিল। আরসিএমপির আবেদনে অনুমান, গুজব ও রটনার বাইরে কিছুই ছিল না। তদন্ত করার মতো এবং গুজব ও অনুমানের পক্ষে কোনো তথ্য-উপাত্তও ছিল না।
বিচারক ইয়ান নর্ডহেইমার বলেন, আড়ি পাতার জন্য আবেদনের অনেক তথ্য এসেছিল বিশ্বাসযোগ্য নয় বা অজ্ঞাতপরিচয় তিন ব্যক্তির কাছ থেকে ইমেইলের মাধ্যমে।
তিনি বলেন, তথ্যদাতারা কিছু ব্যক্তির নাম উল্লেখ করলেও পুলিশ তাদের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করেনি। তাদের সঙ্গে পুলিশের কথা বলা উচিত ছিল। আরসিএমপি দাবি করেছিল, কিছু ব্যক্তি ঘুষের বিষয়ে পরিকল্পনা করার জন্য দুবাই গিয়ে একটি বৈঠকে অংশ নিয়ে থাকতে পারেন। বিচারক এ বিষয়টির সমালোচনা করেছেন। কারণ আড়ি পাতার অনুমতির জন্য আবেদনে ওই তিন ব্যক্তির ভ্রমণ ইতিহাস উল্লেখ করা হয়েছিল। তারা তিনজনই ২০১১ সালের মার্চ মাসে কানাডার বাইরে গিয়েছিলেন বলে সেখানে তথ্য রয়েছে।
বিচারক বলেন, ওই ব্যক্তিরা কোথায় গিয়েছিলেন সে ব্যাপারে আরসিএমপির আবেদনে উল্লেখ করা হয়নি। কেভিন ওয়ালেস দুবাইয়ে কখনো যাননি—এ বিষয়টি জানা সত্ত্বেও আরসিএমপি তার দ্বিতীয় ও তৃতীয় আবেদনে এটি উল্লেখ করেনি এবং প্রথম আবেদন সংশোধনও করেনি।
কানাডার সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন মতে, আরসিএমপি শুরুতে পাঁচজনের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ এনেছিল। তবে মোহাম্মদ ইসমাইল ও আবুল হাসান চৌধুরীর বিরুদ্ধে অভিযোগ পরে প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়। অন্য তিনজন এসএনসি-লাভালিনের জ্বালানি ও অবকাঠামো শাখার সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট কেভিন ওয়ালেস, আন্তর্জাতিক উন্নয়নবিষয়ক ভাইস প্রেসিডেন্ট রমেশ শাহ এবং বাংলাদেশি-কানাডিয়ান ব্যবসায়ী জুলফিকার আলী ভুঁইয়া রায়ে খালাস পেলেন।
শেষ পর্যন্ত ২০১২ সালের জুনে ওই ঋণচুক্তি বাতিল করে। পরে প্রকল্প থেকে একে একে সরে দাঁড়িয়েছিল এডিবি, জাইকা, আইডিবি। কিন্তু বিশ্বব্যাংকের এমন বিস্ময়কর ঘোষণার আগের দিন গোটা দুনিয়াকে হতবাক করে দিয়ে পদ্মা সেতুর মত বৃহৎ প্রকল্প নিজস্ব অর্থায়নে করার ঘোষণা দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
জেডএইচ/এসজি/