স্বপ্নের পদ্মা সেতুর দ্বার খুলছে আজ
এক কথায় রূপকথার গল্পকেও হার মনিয়েছে। সকল অসম্ভবকে মাটিচাপা দিয়ে পদ্মার বুকে ৪২টি পিলারের উপর ৪১টি স্প্যানে সগৌররে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে স্বপ্নের ‘পদ্মা সেতু’। অপেক্ষা করছে তার উপর দিয়ে যানবাহন চলাচলের।
আর মাত্র কয়েক ঘণ্টা। তারপর দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান। প্রত্যাশীত সেই শুভক্ষণের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে পুরো জাতি। সবার দৃষ্টি এখন প্রমত্তা পদ্মা তীরে। দেশের সক্ষমতার প্রতীক, অহংকার, গর্বের প্রতীক, নিজস্ব অর্থায়নে নির্মিত দেশের সবচেয়ে বড় যোগাযোগ অবকাঠামো ‘পদ্মা সেতু’র দ্বার খুলছে। সবকিছু ঠিকটাক থাকলে সকাল ১১টায় মুন্সীগঞ্জের মাওয়া প্রান্তে পদ্মা সেতুর ফলক উম্মোচন ও মোনাজাত করে দ্বার খুলবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সেই শুভক্ষণের মধ্য দিয়ে বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশ পৌঁছাবে এক অন্য উচ্চতায়।
পদ্মা সেতুর উদ্বোধনকে কেন্দ্র পুরো বাংলাদেশ এখন এক সুতোয় আবদ্ধ। পদ্মার দুই তীরে উৎসবের আমেজ। মাওয়াপ্রান্তে হবে সুধী সমাবেশ। আর শরীয়তপুরের জাজিরাপ্রান্তে ফলক উম্মোচন ও মোনাজাত করে প্রধানমন্ত্রী মাদারীরপুরের শিবচরে যোগ দিবেন স্মরণকালের সবচেয়ে বড় সমাবেশে। যেখানে ১০ লক্ষাধিক মানুষের সমাগম ঘটবে বলে প্রত্যাশা করা হচ্ছে।
দেশি-বিদেশী নানান ষড়যন্ত্র আর বাধা-বিপত্তিকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে, কথিত দুর্নীতির অভিযোগকে অসাড় প্রমাণ করে সম্পূর্ণ নিজস্ব অর্থায়নে এক অসম্ভবকে সম্ভব করে নির্মাণ করা হয়েছে দেশের সবচেয়ে বড় যোগাযোগ অবকাঠামো পদ্মা সেতু। আমাজনের পর বিশ্বের দ্বিতীয় খরশ্রোতা প্রমত্তা পদ্মায় সেতু নির্মাণ ছিল সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। তার চেয়েও বড় চ্যালেঞ্জ ছিল কথিত দুর্নীতির অভিযোগ তুলে বিশ্বব্যাংকসহ উন্নয়ন সহযোগিদের এই প্রকল্প থেকে হটাৎ করে সরে দাঁড়ানোর বিষয়টি। যা বাংলাদেশের স্বপ্নের প্রকল্পকে অনিশ্চয়তার মধ্যে ফেলে দেয়।
২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর নিরঙ্কুশ বিজয়ের মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার। নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি অনুযায়ি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রথম অগ্রাধিকার প্রকল্প হিসেবে হাত দেন পদ্মা সেতু নির্মাণ কাজে। তৎকালীন যোগাযোগ মন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন পরামর্শক নিয়োগ প্রক্রিয়া, পরামর্শক নিয়োগে দরপত্র আহ্বান, মূল সেতুর প্রাকযোগ্য দরপত্র আহ্বান করার কাজ শেষ করেন। সেতুর অর্থায়ন সংস্থা বিশ্বব্যাংক, জাপানের জাইকা, ইসলামী উন্নয়ন সংস্থা এবং এডিবির সঙ্গে ঋণচুক্তি স্বাক্ষরের উদ্যোগ নেন। স্বল্পসময়ে ভূমি অধিগ্রহণ কাজেও বড় অগ্রগতি হয়। ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ দেওয়া, ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনসহ যাবতীয় কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে নিয়ে আসেন। এমনকী প্রাকযোগ্য দরদাতা নির্বাচন প্রক্রিয়াও শেষ করেন। মাত্র দু’বছরে পদ্মা সেতুর প্রস্তুতির কাজ শেষ করা হয়। টার্গট ছিল ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে সেতুর কাজ শেষ করা।
পদ্মা সেতু প্রকল্পের নকশা চূড়ান্ত হওয়ার পর ২০১১ সালের এপ্রিল থেকে জুনের মধ্যে সেতু প্রকল্পে অর্থায়নের বিষয়ে বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি), জাইকা ও ইসলামি উন্নয়ন ব্যাংকের (আইডিবি) সঙ্গে ঋণচুক্তি সই করে সরকার। কিন্তু নির্মাণকাজের তদারক করতে পরামর্শক নিয়োগে দুর্নীতির কথিত অভিযোগ তুলে বিশ্বব্যাংক ২০১২ সালে ১২০ কোটি ডলারের ঋণ সহায়তা চুক্তি বাতিল করে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় যোগাযোগ অবকাঠামো নির্মাণের প্রকল্প থেকে সরে দাঁড়ায়। এরপর অন্যান্য উন্নয়ন সহযোগিরাও সরে যায়। দেখা দেয় অনিশ্চয়তা।
ঋণ দাতাদের চাপে তৎকালীন যোগাযোগ মন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনকে পদত্যাগ করতে হয়। দুর্নীতির অভিযোগে জেলে যেতে হয় সেতু বিভাগের তৎকালীন সচিব মোশাররফ হোসেন ভূইয়াকে। প্রকল্প পরিচালক রফিকুল ইসলামকে সরিয়ে দেওয়া হয়। প্রধানমন্ত্রী অর্থনৈতিক উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমানের বিরুদ্ধেও অভিযোগ উঠে। মামলা হয় কানাডার আদালতে। বিশ্বব্যাংকের প্রতিনিধিরা তদন্তে আসেন বাংলাদেশে। যদিও শেষ পর্ন্ত দুর্নীতির কোন অভিযোগই প্রমাণিত হয়নি। কানাডার আদালত সবাইকে খালাস দেয়।
কিন্তু এই সময়ে দেশের রাজনীতিতে অনেক জল ঘোলা হয় পদ্মা সেতুর কথিত দুর্নীতি নিয়ে। বিশিষ্টজনরাও সরকারের তুমুল সমালোচনা করেন। পদ্মা সেতু হবেনা, এটা প্রায় সবাই বলতে থাকেন। তৎকালীন অর্থমন্ত্রী চেষ্টা করেন বিশ্বব্যাংককে ফিরিয়ে আনার। কিন্তু সব চেষ্টা ব্যর্থ হয়।
এতোসব অনিশ্চয়তা আর নানান চাপের মধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দৃঢ় মনোবল, সাহস আর আত্মপ্রত্যয় সেই অনিশ্চয়তাকে দূরে ঠেলে দিয়ে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণে সাহস দেখায় সরকার। শুরু হয় সেতু নির্মাণের প্রক্রিয়া।
সেতুর পিলার তৈরির জন্য ২০১৫ সালে ১ মার্চ প্রথম পরীক্ষামূলক পাইলিং শুরু হয়। ওই বছরের ১২ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কাজের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন। তারপর আর থেমে থাকতে হয়নি। একে একে নির্মাণ হতে থাকে একেকটি পিলার। ২০১৭ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর শরীয়তপুরের জাজিরা প্রান্তে স্বপ্নের পদ্মা সেতুর ৩৭ ও ৩৮ নম্বর পিলারের ওপর বসানো হয় প্রথম স্প্যান।
এভাবেই ধীরে ধীরে এগোতে থাকে সেতুর কাজ। ২০২০ সালের নভেম্বর মাসে সেতুর ৪২টি পিলারের সবকটির নির্মাণকাজ শেষ হয়। ২০২০ সালের ১০ ডিসেম্বর সর্বশেষ স্প্যান বসানোর মধ্য দিয়ে পদ্মার এপার-ওপার একিভূত হয়। শতভাগ দৃশ্যমান হয় ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ পদ্মা সেতু।
পদ্মা সেতুর নকশা তৈরি করে যুক্তরাষ্ট্রের বহুজাতিক কোম্পানি এইকম। আর পদ্মা সেতুর মূল নকশাবিদ ছিলেন বৃটিশ নাগরিক রবিন শ্যাম। সেতুর নির্মাণকাজে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান হচ্ছে চায়না মেজর ব্রীজ কোম্পানি লিমিটেড। প্রায় সাত বছরের পরিশ্রম শেষে পদ্মা সেতুর মূল কাজ শেষ হয় চলতি জুনে। গত বৃহস্পতিবার ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান সেতু কতৃপক্ষকে সেতুটি বুঝিয়ে দেয়। আজ সেই স্বপ্নের পদ্মা সেতু উদ্বোধন হবে আর মাত্র কয়েক ঘন্টা পর। যার প্রতীক্ষায় পুরো দেশ।
দোতলা এই সেতুর নিচ তলায় চলবে ট্রেন। তবে মূল সেতু অর্থাৎ সড়ক সেতুকে অগ্রাধিকার দিয়ে নির্মাণ কাজ শেষ করায় রেল অংশের কাজ শ্লথ হয়। যার ফলে সেতুর উপর রেললাইনের কাজ শুরু হবে আর কিছু দিনের মধ্যে। আশা করা হচ্ছে ২০২৩ সালের জুনে পদ্মা সেতু দিয়ে ট্রেন চলাচল করবে।
এনএইচবি/