দীর্ঘমেয়াদী বায়ুদূষণে কমছে গড় আয়ু: ইপিআইসি’র গবেষণা
বাংলাদেশকে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি বায়ু দূষণের শিকার দেশ বলছেন যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব শিকাগোর এনার্জি পলিসি ইনস্টিটিউটের (ইপিআইসি) গবেষকরা। একইসঙ্গে তারা বলছেন,দীর্ঘমেয়াদী বায়ু দূষণের কারণে বাংলাদেশিদের আয়ু কমছে গড়ে সাত বছর করে।
ইপিআইসি প্রবর্তিত এয়ার কোয়ালিটি লাইফ ইনডেক্স (একিউএলআই) নির্ণয়ে গবেষকেরা বাতাসে পিএম২.৫ (ক্ষতিকর ভাসমান কণা যা ফুসফুসের ক্ষতি করে) এর মাত্রা হিসাব করতে স্যাটেলাইট তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করেছেন। মঙ্গলবার (১৪জুন) এই গবেষণা প্রতিবেদনটি প্রকাশ করে ইপিআইসি।
বায়ু দূষণের এই সূচকের হিসাবে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি দূষণের শিকার পাঁচটি দেশের মধ্যে চারটিই হচ্ছে দক্ষিণ এশিয়ায়। আর বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত রাজধানী হচ্ছে ভারতের নয়া দিল্লি।
ইপিআইসি’র গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, বায়ু দূষণের কারণে বৈশ্বিক গড় আয়ু মাথাপিছু দুই বছর এবং দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে গড় আয়ু পাঁচ বছর করে কমছে।
ওই গবেষণা প্রতিবেদন নিয়ে রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বের ৯৭ শতাংশ মানুষ এমন এলাকায় বসবাস করছে, যেখানে বায়ু দূষণের মাত্রা সহনীয় সীমা ছাড়িয়ে গেছে। আর তা মানুষের গড় আয়ু কমার ক্ষেত্রে যে ভূমিকা রাখছে, তা ধূমপান, এইডস কিংবা সন্ত্রাসী হামলায় মৃত্যুর চেয়ে অনেক বেশি।
গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, যদি বাংলাদেশে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) বেঁধে দেওয়া বায়ু দূষণের সীমা (দূষণকারী কণার পরিমাণ প্রতি ঘনমিটারে ৫ মাইক্রোগ্রাম) প্রয়োগ করে হিসাব করা হয়, তাহলে দেশে মাথাপিছু গড় আয়ু ৬ বছর ৯ মাস করে কমছে। আর কিছু এলাকায় দূষণের মাত্রা এতই বেশি যে সেখানে গড় আয়ু কমার পরিমাণ ৯ বছর। বায়ু দূষণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের নিজেদের নির্ধারিত সীমা (প্রতি ঘনমিটারে দূষণকারী কণার উপস্থিতি ১৫ মাইক্রোগ্রাম) এবং ডব্লিউএইচওর সীমা - দুটোই অতিক্রম করে গেছে।
ইউনিভার্সিটি অব শিকাগোর এই বায়ু দূষণ জীবনকাল সূচক অনুযায়ী, বাংলাদেশে সবচেয়ে দূষিত শহর ঢাকার বাসিন্দারা গড়ে ৮ বছর করে আয়ু হারাচ্ছেন। চট্টগ্রামে আয়ু কমছে সাড়ে ছয় বছর করে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশের ৬৪ জেলার সবক’টিতেই বাতাসে দূষণকারী কণার উপস্থিতি ডব্লিউএইচওর সহনীয় সীমার বেশি।
দক্ষিণ এশিয়ার বিপুল জনসংখ্যা এবং জনসংখ্যার ঘনত্বের কারণে এই অঞ্চলের গড় আয়ু হ্রাসের পরিমাণ বিশ্বের মোট আয়ুষ্কালের ৫২ শতাংশ এবং এটা হচ্ছে কারণ এখানকার বাতাসে ডব্লিউএইচওর নির্দেশিত সীমার চেয়ে অনেক বেশি পরিমাণে দূষণকারী কণা উপস্থিতি।
গবেষণা প্রতিবেদনে ভারতের কয়েকটি এলাকায় সবচেয়ে বেশি দূষিত বায়ুর উপস্থিতি শনাক্ত করা হলেও সার্বিকভাবে সবচেয়ে বেশি বায়ু দূষণকারী দেশ হচ্ছে বাংলাদেশ।
স্যাটেলাইটের নতুন তথ্যউপাত্ত অনুযায়ী বাংলাদেশে ২০২০ সালে প্রতি ঘনমিটার বাতাসে পিএম২.৫ এর উপস্থিতি ছিল ৭৮ দশমিক ৮ মাইক্রোগ্রাম। কোভিড-১৯ মহামারীকালে লকডাউন চলার সময়েও এই দূষণকারী কণার উপস্থিতি বেড়েছে ১৩ দশমিক ১ শতাংশ।
তবে এই বৃদ্ধি ‘অস্বাভাবিক’ নয় যেহেতু গত এক দশক ধরেই এদেশের বাতাসে দূষণকারী কণার উপস্থিতি ডব্লিউএইচওর নির্ধারিত সীমার চেয়ে ১২ থেকে ১৫ গুণ বেশি রয়েছে। ২০১৯ সালে প্রতি ঘনমিটার বাতাসে পিএম২.৫ এর পরিমাণ ছিল ৬৭ মাইক্রোগ্রাম এবং গত এক দশকে তা ৬৩ থেকে ৭৭ মাইক্রোগ্রামের মধ্যে ওঠানামা করেছে।
গবেষণায় উল্লেখ করা হয়েছে, বায়ু দূষণের পেছনে গত দুই দশকে এই অঞ্চলে শিল্পায়ন, অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও জনসংখ্যার বৃদ্ধি বড় ভূমিকা রেখেছে।
ক্রমবর্ধমান উন্নয়নের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বিপুল পরিমাণে জীবাশ্ম জ্বালানির চাহিদা। শুধু ভারত ও পাকিস্তানের রাস্তায় ২০০০ এর শুরু থেকে এই পর্যন্ত মোটরগাড়ি বেড়েছে চারগুণে। আর বাংলাদেশে ২০১০ থেকে ২০২০ এর মধ্যে মোটরযান তিন গুণ বেড়েছে।
এছাড়া বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল ও পাকিস্তানে জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন ১৯৯৮ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে বেড়ে তিন গুণ হয়েছে।
গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, বিশ্বজুড়ে জনস্বাস্থ্যের জন্য বায়ু দূষণের হুমকিকে খাটো করে দেখা হয়েছে এবং এই সঙ্কট মোকাবেলায় পর্যাপ্ত তহবিলও বরাদ্দ করা হয় না।
এই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, বায়ু দূষণ রোধে আশা করা যাচ্ছে বাংলাদেশ তাদের পর্যবেক্ষণ সক্ষমতা বাড়াবে। বর্তমানে চার শহরে চালু থাকা তাৎক্ষণিক পরিমাপ ব্যবস্থা বাড়িয়ে আট শহরে বিস্তৃত করার হবে।
প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, ঢাকার ৬০ শতাংশ দূষণের জন্য এসব ইটভাটা দায়ী। এছাড়া ২০২৫ সালের মধ্যে সরকার ইটের পরিবর্তে কংক্রিট ব্লক ব্যবহারের লক্ষ্য বাস্তবায়নে কাজ করছে, যা বায়ু দূষণ কমানো এবং জমির উপরিভাগের মাটি সংরক্ষণে সহায়ক হবে।
গবেষণাপত্রে আরও বলা হয়, 'অবশ্য এই নীতিগুলোর আদৌ সফল হয়েছে কি না, তা বোঝা যাবে বাতাসে দূষণকারী কণা কমেছে কি না সেটা নিণর্য়ের মাধ্যমে। এজন্য আসন্ন বছরগুলোতে এসব দেশের বাতাসের মান বিষয়ক তথ্যউপাত্তের গণনাভিত্তিক মূল্যায়ন দরকার হবে আমাদের।'
ইপিআইসির এয়ার কোয়ালিটি লাইফ ইনডেক্সের পরিচালক ক্রিস্টা হাসেনকফ বলেন, “দূষণের প্রভাব সম্পর্কে আমাদের বোঝাপড়া বাড়ায় এখন সরকারগুলোর জন্য জরুরি ভিত্তিতে নীতি বদলানোর পক্ষে একটি শক্তিশালী কারণ উপস্থাপন করা সম্ভব হবে।”
এনএইচবি/এমএমএ/