সম্ভাবনার নতুন দুয়ার পদ্মা সেতু-১৪
সোনালী সম্ভাবনার হাতছানি বরগুনাবাসীর সামনে
উপকূলের জেলা বরগুনার মানুষকে 'পদ্মা সেতু' স্বপ্ন দেখাচ্ছে সোনালি সম্ভাবনার। সেতু তাদের ভাগ্যের চাকা ঘুরিয়ে দেবে- সেই আশায় মুখিয়ে আছেন পুরো জনপদের মানুষ। সামুদ্রিক মাছের আঁধার হিসেবে পরিচিত বরগুনার মানুষের মধ্যে এখন উৎসবের আমেজ। দক্ষিণাঞ্চলের অন্য জেলাগুলোর মতই উপকূলের এই জেলাও উন্নয়নের পথে হাঁটতে শুরু করবে পদ্মা সেতুর কল্যাণে। তাই বরগুনাবাসীর কাছে আর্শীবাদের আরেক নাম হচ্ছে 'পদ্মা সেতু'।
বরগুনার রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী, সাধারণ মানুষ সবাই বলছেন, সেতু শুধু রাজধানী ঢাকার সঙ্গে তাদের যোগাযোগই সহজ করবে না, এই সেতুর কারণে বদলে যাবে বরগুনার মানুষের আর্থসামাজিক অবস্থা। পাল্টে যাবে জীবনযাত্রার মান। মৎস্য, কৃষি ও পর্যটন ব্যবসায় নিয়ে আসবে আরও নতুন নতন সম্ভাবনা। বাড়বে ব্যবসা-বাণিজ্য ও কর্মসংস্থান। দূর হবে অভাব-অনটন। ছোয়া লাগবে আধুনিকতার। গড়ে উঠবে নতুন শিল্পকারখানা বিশেষ করে প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প।
আগামী ২৫ জুন বাংলাদেশের সক্ষমতার প্রতীক ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ পদ্মা সেতুর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এর পরদিন অর্থাৎ ২৬ জুন থেকে সেতুটি খুলে দেওয়ার হবে যানবাহন চলাচলের জন্য। যার মধ্য দিয়ে রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশের সঙ্গে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোর সরাসরি সড়ক যোগাযোগ স্থাপন হবে। ঘুচবে দীর্ঘ দীনের আক্ষেপ।
স্বপ্নের পদ্মা সেতু নিয়ে নতুন নতুন পরিকল্পনা, ভাবনায় ব্যস্ত বরগুনার মানুষ। তারা বলছেন, পদ্মা সেতু দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের জন্য ঢাকায় আসা-যাওয়া সহজ করার পাশাপাশি অর্থনীতিতে বিপ্লব ঘটাবে। বিশেষ করে ইলিশসহ বরগুনায় যে সামুদ্রিক মাছ আহরণ করা হয় তা সহজেই পাঠানো রাজধানী ঢাকাসহ দেশের অন্তত ৪০টি জেলায়। উপকৃত হবেন জেলে, আড়ৎদার ,পাইকার এবং বিভিন্ন পর্যায়ের মাছ ব্যবসায়ীরা।
জানা যায়, বরগুনায় দেড় লাখ জেলে সহ মৎস্যের উপর নির্ভরশীল জনগোষ্ঠির সংখ্যা প্রায় ৬ লাখ। আর পাথরঘাটার মৎস্য উন্নয়ন কর্পোরেশন (বিএফডিসি) হচ্ছে দেশের দ্বিতীয় সর্ববৃহৎ মৎস্য অবতরণ কেন্দ্র। এখানকার মৎস্য উন্নয়ন কর্পোরেশনে বিক্রিত প্রতি ১০০ টাকার মাছ থেকে এক টাকা রাজস্ব পায় সরকার।
এখানকার মৎস্যজীবীরা বলছেন, পদ্মা সেতুর ফলে তাজা সব মাছ সরবরাহ করা যাবে রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে। কম টাকায় সামুদ্রিক মাছ খেতে পারবে সবাই। আর মৎস্য উন্নয়ন কর্পোরেশনের কর্মকর্তারা বলছেন, পদ্মা সেতুতে যান চলাচল শুরু হলে এখানকার মৎস্য অবতরণ কেন্দ্র থেকে রাজস্ব আয়ের পরিমানও বাড়বে।
পাথরঘাটা মৎস্য উন্নয়ন কর্পোরেশনের আড়ৎদার কামাল হোসেন বলেন, 'যে টাকা দিয়ে জেলেদের থেকে মাছ ক্রয় করি তা ঢাকায় পাঠাতে প্যাকিং, বরফ ও পরিবহনে প্রায় সমপরিমান খরচ হয়। মাছ নিয়ে যাওয়ার সময় মাওয়া ঘাটে ফেরীর সিরিয়ালের জন্য ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা দিতে হয়। এর পুরো প্রভাবটা পড়ে মাছের উপরে। এ কারণে মাছের দামও বাড়তি থাকে বছর জুড়ে। এবার আমাদের সেই সমস্যার সমাধান হতে যাচ্ছে। পদ্মা সেতু উদ্ভোধনের পর আর ঘাটের চাঁদা দিতে হবে না। সারাদেশে কম দামে মাছ বিক্রি করতে পারবেন মৎস্য ব্যবসায়ীরা।'
বাংলাদেশ মৎস্যজীবী ট্রলার মালিক সমিতির সভাপতি গোলাম মোস্তফা চৌধুরী বলেন, 'এখন পাথরঘাটা মৎস্য উন্নয়ন কর্পোরেশনে মাছ ক্রয় করতে আসা পাইকারদের বেশিরভাগ উত্তরাঞ্চলের। মাওয়া ফেরীর কারনে ঢাকার পাইকার ও বড় বড় ব্যবসায়ীরা চট্টগ্রাম থেকে মাছ ক্রয় করে। কিন্তু পদ্মা সেতু উদ্ভোধনের আগেই ঢাকার বড় বড় মৎস্য ব্যবসায়ীরা এখনই আমাদের সাথে মাছ ক্রয়ের চুক্তি করতে যোগাযোগ শুরু করেছে।'
বাংলাদেশ মৎস্য উন্নয়ন কর্পোরেশন (বিএফডিসি) পাথরঘাটা'র ব্যবস্থাপক লে. মো. লুৎফর রহমান (বি এন) বলেন, 'যোগাযোগ ব্যবস্থা খারাপ থাকায় বরগুনার অনেক ট্রলার চট্টগ্রাম ও খুলনা অঞ্চলে গিয়ে মাছ বিক্রি করতো। কিন্তু পদ্মা সেতু চালু হলে চট্টগ্রাম, বাগেরহাট, পটুয়াখালী ও নোয়াখালীর জেলেরাও মাছ শিকার শেষে পাথরঘাটা অবতরণ কেন্দ্রে এসে মাছ বিক্রি করবে। এতে করে বিপুল পরিমানে অর্থ রাজস্ব পাবে সরকার।'
বরগুনা চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রিজ এর সভাপতি ও জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আলহাজ্ব মো. জাহাঙ্গীর কবির বলেন, 'প্রক্রিয়াজাতকরণের তেমন কোন ব্যবস্থা না থাকায় এ অঞ্চলের মৎস্য ও কৃষি সামগ্রী ঢাকায় পৌঁছানো যেত না। পদ্মা সেতুর কারনে এ অঞ্চলে গড়ে উঠবে প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প। ফলে প্রক্রিয়াজাত সামগ্রী দ্রুত ঢাকাসহ সারাদেশে পৌঁছানো যাবে, সরাসরি বিদেশেও পাঠানো যাবে।'
এমও/এনএইচবি/এএজেড