ধারাবাহিক উপন্যাস: পর্ব ৮
শরণার্থীর সুবর্ণরেখা
সবাই মিলে ভদ্রা নদীর দিকে তাকিয়ে থাকে। তিনটি গানবোট নিয়ে পাকিস্তান আর্মির সেনারা যাচ্ছে। হরেন্দ্রনাথের মনে হয় তারা জায়গা জরিপ করছে। এরপরে আক্রমণ করবে। এমন একটি ধারণা নিয়ে হরেন্দ্রনাথ সবাইকে নিয়ে ঘরে যায়। ছেলেদের বলে, তোরা আর কখনো এদিক-ওদিক যাবি না। ওই যে নৌকা দেখেছিস ওর মধ্যে মিলিটারি আছে, বন্দুক আছে। মানুষকে গুলি করে মেরে ফেলবে ওরা।
–কেন? কেন মেরে ফেলবে বাবা? তাহলে আমরা এখন থেকে আর নদীর ধারের দিকে যাবনা। নৌকাতো নদী দিয়ে আসবে।
–ওটা নৌকা না। ওটাকে গানবোট বলা হয়।
–গানবোট? আচ্ছা আমরা মনে রাখব। এখন থেকে গানবোট বলব।
–ঠিক আছে। এটাও একটা শেখা তোদের।
–দিদি আমাদের শেখা হলো না কেন?
–ওরে আমিও জানতামনা। বাবার কাছ থেকে শিখেছি।
–আমরা এখন কি করব?
–চল, রান্নাঘরে যাই আমরা। মায়ের কাছে বসি।
চারজন রান্নাঘরে ঢুকে পিঁড়ি টেনে বসে পড়ে। মায়ারাণী জিজ্ঞেস করে, কিছু খাবি তোরা?
–হ্যাঁ, মা খাব।
–পিঠা ভেজেছি। নে, পিঠা খা।
মায়ারাণী ওদের দিকে ভাজা পিঠার বাটি এগিয়ে দেয়। বীথিকা বাটি হাতে নিয়ে বলে, বাবাকেও ডাকি। বাবাও পিঠা খাবে।
–এখানে ডাকতে হবে না। এখানে বসার জায়গা নাই। তোরা বারান্দায় যা।
–তুমিও চলো মা। আমরা সবাই মিলে খাব। খুব মজা হবে।
–হ্যাঁ, ঠিক, ঠিক।
বলতে বলতে বাটি থেকে একটা পিঠা তুলে একলাফে রান্নাঘর থেকে নেমে যায় নিরঞ্জন। কৃষ্ণপদ আর অমলও তাই করে। তিন ভাই দৌড়ে গিয়ে বারান্দায় বসে। হরেন্দ্রনাথকে ডাকে।
–বাবা, বাবা আমাদের সঙ্গে বসতে আস। আমরা এখন পিঠা খাব। মায়ের বানানো পিঠা আমাদের মন জুড়িয়ে দেয়।
হরেন্দ্রনাথ বারান্দায় এসে বসে।
–কি রে ময়নারা তোরা পিঠা খাওয়ার জন্য।
–পাগল হয়ে গেছি। সবাই মিলে না খেলে মজা লাগেনা। মা আসবে, দিদি আসবে। ততক্ষণে ওরা দেখতে পায় মায়ারাণী আর বীথিকা থালাভর্তি পিঠা নিয়ে আসছে। ছেলেদের সামনে রাখলে ওরা খেতে শুরু করে।
–মজা, মজা। মায়ের আশীর্বাদ। নিরঞ্জন বাবার মুখের কাছে একটি পিঠা ধরে বলে, খাও বাবা। আমার হাতে খাও।
কৃষ্ণপদ মায়ের মুখে দেয়। অমল দেয় বীথিকাকে। ওদের হাত থেকে পিঠা খেয়ে বীথিকা বলে, এবার আমি সবাইকে খাওয়াব। কেউ নিজের হাতে পিঠা তুলবে না।
বীথিকা সবাইকে পিঠা খাইয়ে দিয়ে ভাইদের বলে, চল আমরা বাইরে থেকে হেঁটে আসি।
তিন ভাইকে নিয়ে বেরিয়ে গেলে হরেন্দ্রনাথ চিন্তিত দৃষ্টিতে মায়ারাণীর দিকে তাকায়। মায়ারাণী অবাক হয়ে বলে, তুমি কি ভাবছ গো?
–অবস্থা খুব খারাপের দিকে যাচ্ছে। মিলিটারি গানবোট নিয়ে ঢুকেছে আমাদের এলাকায়। নদীতে ঘোরাঘুরি করে চলে গেছে। কবে আক্রমণ করতে আসবে কে জানে?
–তাহলে আমরা ভারতে যাওয়ার জন্য গুছিয়ে ফেলি। আমরা দুজনে মরে গেলে যাব, কিন্তু ছেলেমেয়েদের মৃত্যু দেখতে পারবনা।
–মায়ারাণী তুমি অনেক বড় কথা বলেছ। চল আমরা শরণার্থী হবো।
বীথিকা আর তিন ছেলে দৌড়ে ঘরে ঢুকে বলতে থাকে, মিলিটারি ঢুকেনি, কিন্তু ঘরে ঘরে আগুন লাগাচ্ছে গ্রামের মানুষেরা। দাউদাউ আগুন জ্বলছে চারদিকে। মাগো কেউ কেউ বলছে, যারা আগুন দিচ্ছে এরা সবাই পাকিস্তানিদের দালাল। ঘরে আগুন দেয়ার আগে ওরা ঘরের জিনিসপত্র লুটপাট করে।
–আমরা কালকেই ভারতে চলে যাব।
হরেন্দ্রনাথ সায় দিয়ে বলে, আমিও তাই চিন্তা করেছি। এখন যাই, একটা নৌকা ঠিক করে আসি। তোমরা খাবারদাবার আর কাপড়-চোপড় গুছিয়ে নাও।
–বাবা, আমরা তোমার সঙ্গে যাব।
–আয়, আমার হাত ধর। এদিক-ওদিক দৌড়াবিনা তোরা।
–না, আমরা দৌড়াবনা বাবা। তোমার হাত ধরেই থাকব। তোমার হাত আমাদের শক্তি।
তিন ভাই একসঙ্গে কথা বলে। খলখলিয়ে হাসে। হাসতে হাসতে ঘাসের ওপর পা দাপায়। হরেন্দ্রনাথ ওদের উচ্ছ্বাস দেখে বেশ আনন্দ পায়। দেশ ছেড়ে ভারতে যেতে হচ্ছে এই চিন্তায় তার মন খারাপ ছিল। ছেলেদের হাসিতে মন ভালো হয়ে যায়।
নদীর ঘাটে দাড়িয়ে একজন মাঝির সঙ্গে কথা হয় হরেন্দ্রনাথের। অজয় মাঝি জিজ্ঞেস করে, কতদূর যাবেন কাকু?
–ভারতে যাব। আমাদের এখানে ঘরবাড়ি জ্বালাও-পোড়াও শুরু হয়েছে।
–হ্যাঁ, চলে যান। দেশ স্বাধীন হলে ফিরবেন। আমি আপনাদের নিয়ে যাব। আপনাদের চারটা নদী পার হতে হবে–ভদ্রা, শিবসা, ইছামতি, বুড়িগোয়ালিনী।
–হ্যাঁ, আমিও জানি চারটা নদী পার হতে হবে।
–কখন রওনা করবেন?
–কালকে সকালে। তুমি এখানে থাকবে। আমরা এখানে আসব।
–আচ্ছা, ঠিক আছে। অজয় মাথা নেড়ে বলে, আমার ভাড়াটা ঠিকমতো দিবেন। আমিতো নৌকার ভাড়া দিয়ে ভাত খাই।
–হ্যাঁ, হ্যাঁ পাবে। ভেবো না। আমি তোমার ভাড়া আলাদা করে রাখব। ভাড়া নিয়ে একটুও চিন্তা করবে না।
–আচ্ছা। আমি সকালে এখানে এসে বসে থাকব।
তিন ছেলে লাফ দিয়ে নৌকায় উঠে বলে, আমাদেরকে একটু ঘুরিয়ে দেন। বাবা টাকা দিয়ে দিবে। অমল বাবার হাত টেনে ধরে বলে, বাবা তুমিও চল।
হরেন্দ্রনাথ ছেলেদের নিয়ে উঠে বসে। ওদের ইচ্ছাপূরণ করতে ভালোবাসে সে। কখনো ছেলেমেয়েদের বিরূপ করেনা। অজয়কে বলে, অল্প একটু ঘুরে তুমি ঘাটে লাগাও।
অজয় এপাশে-ওপাশে চক্কর দিয়ে ঘাটে চলে আসে। তিন ছেলে নৌকা থেকে লাফ দিয়ে নেমে দৌড়াতে শুরু করে। হরেন্দ্রনাথ ওকে পাঁচ টাকা দিয়ে নেমে যায়। ছেলেরা পেছন ফিরে যখন দেখে বাবা অনেকদূরে ওরা আবার দৌড়াতে দৌড়াতে এসে বাবার হাত ধরে।
বাড়ি ফিরে দেখতে পায় মা-মেয়ে কাপড় গুছিয়ে নিয়ে পোটলা বানিয়েছে। পাশে আর একটি পোটলা রাখা আছে। হরেন্দ্রনাথ জিজ্ঞেস করে, এটার মধ্যে কি নিয়েছ?
–শুকনা খাবার। চিড়া-গুড়-মুড়ি এইসব।
–এইরকম আরও দুইটা পোটলা বানাও। আমাদেরতো চার নদী পার হয়ে যেতে হবে। সময় লাগবে। ছেলেরা যেন খিদায় কাঁদে না।
–ঘরে যা ছিল তাই পোটলা বেঁধেছি। তুমি আরও কিছু কিনে আন।
–সন্ধ্যা হয়ে আসছে। এখনই যাই।
(চলবে)
এসএ/