ধারাবাহিক উপন্যাস: পর্ব ৬
দ্য ফার্স্ট ম্যান
সেন্ট ব্রিউক এবং মালান (জে জি)
সেদিন সন্ধ্যায় ডিনারে বসে জ্যাক করমারি তার পুরনো বন্ধুর খাওয়া দেখছিল: ভেড়ার পায়ের মাংসের দ্বিতীয় খণ্ড সে বিরক্তিকর রকমের রাক্ষুসে কামড় দিচ্ছে। সমুদ্র তটের দিকে চলে যাওয়া রাস্তার ধারের ওই এলাকার ওই বাড়িটাতে যে বাতাস ঢুকছে সে বাতাসও যেন নিচু ছাদঅলা বাড়ির ভেতর মৃদু গর্জন তুলছে। বাড়িতে ঢোকার সময় জ্যাক খেয়াল করেছে, ফুটপাতের পাশে পয়োনালিতে বেশ কয়েক টুকরো শুকনো শেওলা পড়ে আছে। শেওলার টুকরোগুলোর লবণাক্ত গন্ধ থেকে বুঝতে পেরেছে, ধারে কাছেই সমুদ্র আছে।
ভিক্টর মালান তার কর্মজীবনের পুরোটাই শুল্ক প্রশাসনের কাজে ব্যয় করে অবসরে গেছে এই ছোট শহরে। অবসরের জন্য সে নিজে এই জায়গা বেছে নেয়নি; তবে এর পক্ষে তার সাফাই হলো, তার নিঃসঙ্গ ধ্যানমগ্নতা থেকে কোনো কিছুই তার মনোযোগ নষ্ট করতে পারবে না: না বাড়তি সৌন্দর্য, না বাড়তি কদর্যতা, না খোদ নির্জনতার আতিশয্য। বিভিন্ন বিষয়ের প্রশাসন এবং মানুষজনকে বিভিন্নভাবে ব্যবস্থাপনায় নিয়ে আসার অভিজ্ঞতা থেকে তার অনেক কিছুই শেখা হয়েছে। তবে প্রথমত এবং বাহ্যত আমাদের জানার পরিধি খুবই সীমিত পরিসরের। তারপরও অভিজ্ঞতা থেকে মালানের শিক্ষাদীক্ষা অনেক হয়েছে। জ্যাক করমারি তার প্রশংসা করে থাকে খোলা মনেই। বিশেষ করে যখন উল্লেখযোগ্য মানুষদের মামুলিত্ব খুব বেশি চোখে পড়ার মতো তখন মালান তার নিজস্ব চিন্তা চেতনার জন্য নিজেকে এক আলাদা ব্যক্তিত্বে পরিণত করতে পেরেছে। যে করেই হোক, তার আপাত বিভ্রান্তিকর আনুকূল্য প্রদর্শনীর মধ্য দিয়ে বাইরের অবস্থার ভেতরে আসলে সে নিজস্ব মতামতের ব্যাপারে আপোষহীনভাবেই অবিমিশ্র।
মালান বলে, বৎস, তুমি যেহেতু তোমার মাকে দেখতে যাচ্ছ তোমার বাবার ব্যাপারেও খোঁজ-খবর করে দেখার চেষ্টা করো। তারপর ফিরে এসে তাড়াতাড়িই আমাকে জানাও পরবর্তীতে কী ঘটেছে। সব কিছু হেসে উড়িয়ে দেওয়ার মতো বলে মনে হয় না আমার।
জ্যাক বলে, হ্যাঁ, ব্যাপারটা তো সেরকমই। তবে এখন আমার আগ্রহ যেহেতু জেগে উঠেছে আমি আরো কিছু তথ্য যোগার করার চেষ্টা করতে পারি। আমি যে এতদিন এ ব্যাপারে উদাসীন ছিলাম সেটাই আসলে রোগ নির্ণয়ের মতো বিষয়।
না, সেরকম নয় মোটেই। এখানে বরং প্রজ্ঞার কথা বলতে পারো। তুমি তো মার্থাকে চিনতে। ওর সঙ্গে আমার বিবাহিত জীবন ত্রিশ বছরের। চমৎকার মানুষ একজন। এখনও ওর কথা খুব মনে পড়ে। আমি আগে সব সময়ই মনে করতাম, মার্থা নিজের বাড়ি খুব পছন্দ করে।
অন্য দিকে তাকিয়ে মালান আরো বলে, সন্দেহ নেই, তোমার কথা ঠিকই। জ্যাক মনে মনে অপেক্ষা করতে থাকে; তার অনুমোদনের বিপক্ষে আপত্তি আসবেই।
মালান আাবার শুরু করে, তা সত্ত্বেও আমি নিশ্চিত, জীবন যতদূর আমাকে শিখতে দিয়েছে তার চেয়ে বেশি কিছু শেখার ব্যাপারে আমি নিজেকে নিবৃত্ত করেছি। অবশ্য আমি জানি, হয়তো সেটা আমার ভুলই হয়েছে। তবে এ ক্ষেত্রে আমি একটা খারাপ উদাহরণ, তাই না? যখন সবকিছু বলা হয়ে গেছে এবং করা হয়ে গেছে তখন আমি আর কোনো চেষ্টা করিনি; মানে দোষটা আসলে আমারই। আর তুমি, তুমি তো বেশ করিৎকর্ম হে। শেষের কথাগুলো বলার সময় মালানের চোখ সামান্য দুষ্টুমিতে নেচে ওঠে।
মালানের চেহারা চীনাদের মতো:
গোলাকার মুখ, নাক খানিকটা চ্যাপটা, চোখের ওপরে ভ্রু নেই বললেই চলে, চুলের কেতা তার মাথায় অনেকটা পুডিংয়ের বাটি সদৃস চেহারা দান করেছে। আর তার গোঁফ বিরাট হলেও মোটা ইন্দ্রিয়জ ঠোঁটকে আড়াল করতে ব্যর্থ হয়েছে। তার নরম গোলাকার শরীর, মাংসল হাত এবং বেঁটে খাটো আঙুলগুলো পায়ে হাঁটতে নারাজ কোনো মান্দারিন পর্যটকের কথা মনে করিয়ে দেয়। আয়েশ করে খাওয়ার সময় সে যখন চোখ বন্ধ করে তার চেহারা দেখে মনে না করার উপায় নেই, সে সিল্কের পোশাক পরে চপস্টিক হাতে খাচ্ছে না। তবে তার ভঙ্গি বদলেও যায়: তার অস্থির এবং আকস্মিক একাগ্র কালো চোখ সত্ত্বেও যখন কোনো বিশেষ বিষয় নিয়ে তার মন নিবিষ্ট থাকে তখন মনে হয় এই চোখ জোড়া মহান সংবেদনশীলতা আর সংস্কৃতির ধারক বাহক কোনো পাশ্চাত্যের মানুষের।
বৃদ্ধা এক চাকরানী একটা পনিরের ট্রে নিয়ে এল। মালান পনিরের দিকে চোখের কোণা দিয়ে লোলুপ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। মালান বলল, আমি একজনকে চিনতাম; তার স্ত্রীর সাথে ত্রিশ বছর কাটিয়েছে...., আমি এরকম একজনকে চিনতাম ....,, কিংবা, এক বন্ধুকে আমি চিনতাম...., একজন ইংরেজ একবার আমার সহযাত্রী হয়েছিলেন.... মালান যখনই এরকম বলা শুরু করে জ্যাক তখন আরো বেশি মনোযোগ দিয়ে শোনে। যেমন .... ওই লোকটা পেস্ট্রি পছন্দ করত না। তার স্ত্রীও কোনো দিন পেস্ট্রি খেত না। বিশ বছর এক সঙ্গে কাটানোর পর লোকটা তার স্ত্রীকে একদিন পেস্ট্রির দোকানে পেয়ে গেল। তারপর স্ত্রীর ওপর নজর রেখে দেখতে পেল, সে ওখানে সপ্তাহে বেশ কয়েকবার করে যায় কফির কেক খেতে। হ্যাঁ, লোকটা মনে করেছিল, তার স্ত্রী মিষ্টি পছন্দ করে না, অথচ সে কফির কেক খেতে যায়।
জ্যাক বলল, তাহলে আমরা কাউকেই ভালো করে চিনি না।
সেটাই মনে করতে পারো। সবকিছু ইতিবাচক বলে বর্ণনা করার ব্যাপারে আর্মা নিজের দোষ থাকতে পারে। তবে আমার কাছে আরো সঠিক বলে মনে হয় বা আমি বলতে পছন্দ করি, যদি বিশ বছর এক সঙ্গে বসবাস করেও কাউকে চেনা না যায় তাহলে কারো মৃত্যুর চল্লিশ বছর পর তার ব্যাপারে অনুসন্ধান করাটা অগভীর থেকেই যেতে পারে। সীমিত তথ্য পাওয়ার একটা ঝুঁকি থেকে যায় তাতে। হ্যাঁ, এই মানুষটির সম্পর্কে পাওয়া তথ্য যে কেউই সীমিত বলতে পারে। অবশ্য অন্য অর্থে....।
তারপর মালান একটা ছুরি তুলে নিয়ে সেটাকে ছাগলের পনিরের ওপরে অদৃষ্টবাদীর মতো করে নামিয়ে বলল, ইয়ে, তুমি পনির খাবে না, না? এখনও এত মিতাহারী তুমি? তোমাকে খুশি করা খুব কঠিন।
তার আধো বোজা চোখের ওপর আবারো দুষ্টুমির আভা ছড়িয়ে পড়ল।
করমারি তার এই পুরনো বন্ধুকে বিশ বছর ধরে চেনে। তার পরিহাস সে সানন্দচিত্তেই গ্রহণ করে থাকে। সে বলল, আমাকে খুশি করার ব্যাপার নয়। বেশি খেলে আমার শরীর স্থূল হয়ে যায়। আর স্থূল হলেই তো রসাতল।
হ্যাঁ, তা তো বটেই। তা না হলে তো তুমি আমাদের বাকি সবার ওপর দিয়ে উড়তে পারো না।
করমারি নিচু ছাদঅলা সাদা রং করা ডাইনিং রুম বোঝাই সাদাসিধা অথচ সুদর্শন আসবাবপত্রের দিকে নজর রেখে বলল, বন্ধু, তুমি হয়তো সব সময়ই ভেবেছো, আমি উগ্র। অবশ্যই আমি উগ্র। তবে সব সময় নই এবং সবার সঙ্গে নই। যেমন তোমার সঙ্গে উগ্রতা দেখাতে একেবারেই অপারগ আমি।
মালান অন্য দিকে দৃষ্টি ফেরাল। তার মানে আবেগের মুহূর্তগুলোতে সে এরকমই করে থাকে। সে বলল, হ্যাঁ, সেরকমই দেখেছি। কিন্তু কারণটা কী?
করমারি শান্ত কণ্ঠে বলল, কারণ তোমার জন্য আমার ভালোবাসা আছে।
মালান ঠাণ্ডা করা ফলের বাটিটা নিজের দিকে টেনে নিল। মুখে কিছু বলল না।
করমারি বলেই চলল, যখন আমার বয়স খুব অল্প ছিল, প্রচণ্ড রকমের বোকা ছিলাম, একা ছিলাম। আলজিয়ার্সের সেই দিনগুলোর কথা তোমার মনে আছে? তখন তুমিই আমার দিকে মনোযোগ দিয়েছিলে আর এই জগতে আমার যা কিছু ভালো লাগতো সেসবের দরজাগুলো আমার জন্য খুলে দিয়েছিলে।
আরে না। তোমার নিজের যোগ্যতা ছিল বলেই।
অবশ্যই ছিল। কিন্তু যোগ্যতম মানুষের জন্য আরেকজন মানুষ দরকার হয় যিনি তাকে শুরু করিয়ে দেন। চলার পথে জীবন যে মানুষটাকে উপহারের মতো এনে হাজির করে সে মানুষটাকে তো চিরদিন ভালোবাসতেই হবে, শ্রদ্ধা করতেই হবে। এমনকি সেই মানুষটার মধ্যে দায়িত্ব বোধের ঘাটতি থাকলেও। আমার ত্রুটি হয়তো সেখানেই।
মালান বিনয়ের সঙ্গে বলল, হ্যাঁ, সেটাই।
আমি জানি তোমার পক্ষে এটা বিশ্বাস করা কঠিন। তবে মনে রেখো তোমার প্রতি আমার ভালোবাসা অন্ধ নয়। তোমারও ত্রুটি-বিচ্যুতি আছে, বেশ বড় ত্রুটিই আছে, অন্তত আমার দৃষ্টিতে।
লান তার মোটা ঠোঁট চাটতে লাগল। তাকে আগ্রহী মনে হচ্ছে। জিজ্ঞেস করল, কী দোষত্রুটি?
যেমন তুমি মিতব্যয়ী। অবশ্যই বলতে পারি, তুমি লোভের বশবর্তী হয়ে মিতব্যয়ী হওনি। তবে ভয় থেকে মিতব্যয়ী হয়েছ। ভয় মানে কপর্দকহীন হওয়ার ভয়। এটাও একটা ত্রুটি। আমি সাধারণত এই ত্রুটিটা পছন্দ করতে পারি না। তবে সর্বোপরি তুমি অলক্ষিত প্রণোদনা সম্পর্কে অন্যদেরকে সন্দেহ না করে পারো না। অন্যদেরও যে নিরপেক্ষ মতামত থাকতে পারে সে ব্যাপারে তুমি সহজাতভাবে অবিশ্বাসী।
মালান মদ শেষ করে বলল, শোনো, আমার কফি খাওয়া উচিৎ নয়। তবু...।
করমারি তবু বলেই চলল, যেমন ধরো তুমি কিছুতেই নিজেকে বিশ্বাস করাতে পারতে না। যদি আমি তোমাকে বলতাম, তুমি শুধু মুখ দিয়ে চাইলে আমার যা কিছু আছে সব আমি তোমাকে দিয়ে দিতে পারতাম, তবু পারতে না।
মালান তার বন্ধুর দিকে দ্বিধান্বিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বলল, আহা, আমি জানি তো, তুমি খুব উদার।
না, আমি উদার নই। যেসব বিষয় আমাকে ক্লান্ত-বিরক্ত করে সেসব বিষয়ে আমি সময় এবং শক্তি খরচের ব্যাপারে ব্যয়কুণ্ঠ। তবে আমি যা বলছি তা সত্যি। তুমি আমাকে বিশ্বাস করতে পারো না এবং এটাই তোমার ত্রুটি। একজন উঁচু মাপের মানুষ হয়েও এখানেই তুমি অসহায়। কারণ এটাই তোমার ভুল। আরেকটা কথা, এখন আমার যা কিছু আছে সব তোমার। তোমার আর এর কোনো দরকার নেই এবং এটা একটা উদাহরণ মাত্র। তবে আমি এটা অযৌক্তিকভাবে বেছে নিইনি। সত্যিই আমার সবকিছুই তোমার।
চোখ আধোবোঁজা রেখেই মালান বলল, সত্যিই তোমাকে ধন্যবাদ। আমি অভিভূত।
ঠিক আছে। আমি তোমাকে বিব্রত করছি। যারা খোলামেলা কথা বলে তাদের তোমার পছন্দ নয়। আমি শুধু বলতে চাই তোমার সব দোষত্রুটিসহই আমি তোমাকে ভালোবাসি। খুব কম মানুষকেই আমি ভালোবাসি কিংবা গভীরভাবে শ্রদ্ধা করি। অন্যদের ব্যাপারে বলব, তাদের প্রতি আমার উদাসীনতার জন্য আমি লজ্জিত বোধ করি। কিন্তু যাদেরকে আমি ভালোবাসি তাদেরকে ভালোবেসেই যাই; অন্য কিছু কিংবা অন্য কেউ এমন কি তারা নিজেরাও আমার এ ভালোবাসা থেকে নিরত রাখতে অক্ষম। এ সত্যটা বুঝতে আমার অনেক সময় লেগেছে। এখন আমি পরিষ্কারভাবেই জানি। আমার যা বলার বলা হয়েছে। তাহলে এবার আমাদের কথায় আসা যাক: আমার বাবার সম্পর্কে খোঁজ খবর করাটা তুমি সমর্থন করো না।
না, সেরকম নয়। বলতে গেলে, আমি সমর্থনই করি। আমার আশঙ্কা ছিল, তুমি হয়তো হতাশ হতে পারো। আমার এক বন্ধু এক মহিলার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে তাকে বিয়ে করার জন্য অন্যদের কাছ থেকে তার সম্পর্কে জানতে গিয়ে ভুল করে ফেলে।
(চলবে)