জলপাই রঙের ভালোবাসা
ওর নাম ইমন। গ্রামের নিম্নবিত্ত পরিবারের ছেলে। বাবা পুরোদস্তুর কৃষক। নিজের জমি-জমা নেই বললেই চলে। অন্যের বর্গা জমিতে চাষবাস করে সংসারটা চালায়। ইমন বাপের একটাই ছেলে। ছেলেটা বাবার স্বপ্ন সফল করার জন্য খুব চেষ্টা করছে। বলা যায়, জীবনের সাথে লড়াই করছে। কৃষক বাবার বড় স্বপ্ন; অনেক বড়। ইমনকে একদিন অনেক বড় মানুষ হতে হবে। বাবার পাহাড় সমান স্বপ্ন থাকলেও সামর্থ্য খুব অল্প। ছেলেটাকে ঠিকমতো যোগান দিতে পারে না। অভাবের সংসারই ঠিকমতো চলে না। বর্গা নেওয়া অন্যের জমি চাষ করে আর কত রোজগার হয়! জমির মালিককে দিতে হয়। সেঁচের পানি, সার আরও কত খরচ! তাই ইমন বাবাকে মাঠের কাজে সাহায্য করে সকাল-বিকাল। ইমন স্কুলে যায় আবার বিকেলে ফিরে এসে বাবাকে সাহায্য করে। বাপটা অশিক্ষিত হলে হবে কী লেখাপড়ার মর্ম সে বোঝে। স্কুলে যাওয়ার সময় হলে বাবাই তাগাদা দেয় স্কুলে যাওয়ার জন্য। ছেলেটা বাপের মত মাঠের কামলা হোক তা সে চায় না।
ইমনের মাও খুব কষ্ট করে। ঘর-গেরস্থালী দেখাশোনা করার পাশাপাশি ছাগল-মুরগি পোষে ছেলের জন্য। তারও খুব স্বপ্ন ছেলেটা তার অনেক বড় হবে। ইমনের বাবা রাতে খেতে বসে ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দেন আর বলেন, ‘তোর ম্যালা বড় মানুষ হওয়া লাগবি বাপ!’
ইমন এখন ত্রিশ বছর বয়সী এক যুবক। নিজেকে সে অসফল মানুষ মনে করে। তবে হাল ছাড়ে নি। বড় মানুষের সংজ্ঞা সে জানে না। বাবার স্বপ্নগুলোর হয়তো মৃত্যু হয়েছে। কিন্তু বাবা এখনো বেঁচে আছেন। বাবা চেয়েছিলেন ইমন বড় হয়ে বড় সরকারি চাকরি করবে। বাবার দৃষ্টিতে সেটিই হয়তো বড় মানুষের সংজ্ঞা। বাবার সে স্বপ্নে গুড়েবালি। বিএ পাশ করে একটি ওষুধ কোম্পানির বিক্রয় প্রতিনিধি সে। শহরে থাকে একটা ম্যাসে। মাসে দুয়েকবার সুযোগ করে বাড়ি আসে। বৃদ্ধ বাবা-মাকে দেখে যায়।
একটা মুখ সহসাই ইমনের চোখে ভেসে আসে। কিশোর বয়সের দুটি চোখ ইমনকে খুব ভাবায়। লাউয়ের কচি ফুলের মতো একটা চেহারা ইমনকে স্মৃতির অনুরণনে ভাসিয়ে নিয়ে যায়। একটা প্রায় অস্পষ্ট মুখ ইমনের ঘুমে ব্যঘাত ঘটায়। ইমন বুঝতে পারে না তার এমনটি কেন হচ্ছে। দুর্বায় জমে থাকা শিশিরের মত একটা নরম হাত যেন ইমনকে ছঁয়ে যায়। ইমন ভেসে যায় অন্য এক জগতে। ডুবে যাওয়া শেষ রাতের চাঁদের মত একটা মুখ ইমন কখনোই ভুলতে পারে না। যখন ইমন সম্ভিৎ ফিরে পায় তখন বাবার স্বপ্নের কথা মনে পড়ে। বাবার স্বপ্ন আর একটা মুখ একাকার হয়ে যায় ইমনের ঘুমুঘুমু চোখের সাথে; জীবনের সাথে।
মুখটা একজন কিশোরীর। হাইস্কুল জীবনে যাকে দেখার জন্য মনটা সবসময় ছটফট করতো। সেবার ইমনের বান্ধবী সুরভীর পাশে স্কুলের একটা অনুষ্ঠানে দেখেছিল সে। ইমন তখন এসএসসি পরীক্ষার্থী আর ওই মেয়েটা, যার নাম শোভা, অন্য একটা স্কুল থেকে এসে ইমনদের স্কুলে অষ্টম শ্রেণিতে ভর্তি হয়েছিল। এই প্রথম কোনো মেয়েকে দেখে ইমনের বুকটা নড়েচড়ে উঠল। এর কারণ ইমন জানে না। এর আগে কোনো মেয়ের জন্য ইমনের এমনটি লাগেনি। ইমনের কত বান্ধবী আছে সুরভী-মিম-রীতা ওদের জন্য এভাবে মনের টান অনুভব করেনি ইমন। কী যেন আছে মেয়েটার মধ্যে! সেই থেকে শুরু। শোভার জন্য ইমনের মনের গভীরে একটা বসতবাড়ী গড়ে ওঠে। সে যেন দিগন্তের মাঠে হাঁটছে। সবুজ মাঠের মধ্যে লাল রঙের একটা ফুটন্ত গোলাপ ইমনকে বার বার ডাকছে। ইমনের কিশোর মনে এ এক অন্যরকম অনুভূতি। এই অনুভূতির নাম কী ইমন তা জানে না। শোভা যেন কঁচি লাউয়ের ডগার মতো শুভ্র সুন্দর!
সুযোগ পেলেই শোভার পিছু নেয় ইমন। শোভার আশেপাশে ঘোরাঘুরি করে। কী যেন কী বলতে চায়! কী বলতে চায় ইমন নিজেও জানে না। শোভার কিশোরী মনও সব বোঝে। ওর মনটাও এক অজানা আনন্দে নেচে ওঠে। সেও হয়তো কিছু বলতে চায়। কিন্তু বলা হয়ে ওঠেনা। ইমন আর শোভার এসব কীর্তি দেখে সুরভী শুধু মিটমিট করে হাসে। সুরভী শোভার মামাতো বোন। শোভার ওর নানীর বাড়ি অর্থাৎ সুরভীদের বাড়িতেই থাকে। এতো কিছুর মধ্যেও ইমন বাবার স্বপ্নের কথা ভোলেনা। এসএসসি পরীক্ষা দেয়। ভাল রেজাল্টও করে। মফস্বলের একটা কলেজে ভর্তি হয়। কলেজে যায় আসে আর শোভার খোঁজ রাখে ইমন। শোভা আরও অনেক সুন্দর হয়ে উঠছে আজকাল।
একদিন কলেজ থেকে ফেরার সময় মাঝপথে একটা বাড়ির সামনে থেমে যায় ইমনের বাইসাইকেল। বাড়িটিতে উৎসবের আমেজ। একটা বিয়ে হচ্ছে। এটা কনের বাড়ি। বড় এসেছে কাঁচা ফুলে সাজানো একটা গাড়ি নিয়ে। এই বাড়িটি ইমনের খুব চেনা। অনেকবার এসেছে এখানে। এটা শোভার নানীর বাড়ি। কনেকে খুব ভালো করে চেনে ইমন। কতক্ষণ ঠায় দাঁড়িয়ে থাকার পর ইমনের মনে পড়ে বাবার কথা; বাবার স্বপ্নের কথা! ইমন বাইসাইকেলে চড়ে বসে। তার কানে বাঁজতে থাকে বাবার সে কথা, ‘তোর ম্যালা বড় মানুষ হওয়া লাগবি বাপ!’
এসএ/